• " />

     

    তাঁরা কেউ গোলরক্ষক হতে চান নি!

    তাঁরা কেউ গোলরক্ষক হতে চান নি!    

    গোলবার সামলেই তাঁরা দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, অথচ তাঁদের অনেকেরই দাবী 'শখ' করে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন নি! ফিফা ডটকমের সাথে আলাপচারিতায় ক’জন নামী তারকা ফুটবলার শুনিয়েছেন তাঁদের গোলরক্ষক হয়ে ওঠার গল্প।

     

    “আমি কখনই গোলকিপার হতে চাই নি, হতে বাধ্য হয়েছিলাম।” গোলদ্বারের প্রহরী হওয়ার গল্প জানতে চাইতেই এমন জবাব আসে ‘৭৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রধান গোলরক্ষক ড্যানিয়েল কারনেভালির কাছ থেকে। সঙ্গে রসিকতা করতেও ছাড়লেন না ৬৮ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন, “আমি তো ফরোয়ার্ড ছিলাম, খেলতাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো...কাউকে বল দিতে চাইতাম না আর কি!” বলের প্রতি এমন প্রীতির জন্যই কিনা শেষপর্যন্ত গোল বাঁচানোই হয়ে গেলো তাঁর কাজ! “মর্নিং স্টার ক্লাবের সতীর্থরা একদিন এসে বলল, ড্যানিয়েল তুমি এখন থেকে কিপিং করবে!”

     

    ড্যানিয়েল কারনেভালি

     

    ফুটবল দুনিয়ায় ড্যানিয়েলের মতো এমন ‘ঠেকায় পড়ে’ গোলরক্ষার দায়িত্ব পালন করাদের তালিকাটা খুব ছোট নয়। বহু নামী গোলরক্ষকই আউটফিল্ডে ক্যারিয়ার শুরু করে ঘটনা-দুর্ঘটনায় কিংবা ভাগ্যের ফেরে একদিন নিজেকে গোলপোস্টের সামনে আবিষ্কার করে বসেন! সত্যি বলতে, গোটা পৃথিবীতেই ফুটবল পাগল তরুণদের মধ্যে গোল বাঁচানোর চেয়ে গোল করায় আগ্রহীদের দলটাই ঢের বেশী ভারি।

     

    ডেভিড ডি গিয়া

     

    স্প্যানিশ জাতীয় দল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলরক্ষক ডেভিড ডি গিয়া শোনাচ্ছিলেন তেমনই এক গল্প। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলের সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্লাভসজোড়া হাতে তুলে নিয়েছিলেন স্রেফ বন্ধুদের ‘ঝগড়া’ থামাতে! “কেউ সেদিন গোলকীপার হতে চাইছিল না। তাই বাধ্য হয়ে আমি তাদের চুপ করতে বলে নিজেই গোলপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাজটায় আমি দক্ষও ছিলাম, ভালোও লাগতো। এই নিয়ে যখন এতো সমস্যা তখন…।”

     

     

    ‘নিরস’ কাজটায় এমন নির্লিপ্ত ভালোলাগা অবশ্য সবাই খুঁজে পান না। এক যুগের বেশী সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রমীলা দলের গোলবার সামলেও হোপ সোলো প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করেন কেন তিনি গোলকিপার হয়েছিলেন, “আউটফিল্ডে দারুণ খেলতাম। সবসময় গোল করতাম। এভাবে বদলে যাওয়াটা খুব সহজ ছিল না। তবে একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, দোটানায় ভোগার কোন সুযোগ থাকলো না।” রসিকতার সুরেও খানিকটা আক্ষেপ কি ছিল না?

     

    হোপ সোলো

     

     

    সোলোর বিশ্বাস সামান্য প্রশিক্ষণেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলে এখনও মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর সামর্থ্য তিনি রাখেন। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়েই আর পিছন ফিরতে চান না।

     

     

    সোলোর মতো অবশ্য নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগটুকুও পান নি ২০১৩ সালের বর্ষসেরা প্রমীলা ফুটবলার নাদিন অ্যাঞ্জেরার। জার্মান এই নারী হাতজোড়া গ্লাভসবন্দী করেছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। সেদিন তাঁর দলের নিয়মিত গোলরক্ষক অনুপস্থিত ছিল। “আমার কীপিং দেখে সবাই খুব উৎসাহ দিল। কিন্তু তখনও আমি ফরোয়ার্ডই হতে চাইতাম। শেষপর্যন্ত সবার পরামর্শ মেনে গোলকিপারই হলাম, খুব আগ্রহ নিয়ে না অবশ্যই!”

     

    নাদিন অ্যাঞ্জেরার

     

    বছর দুয়েকের মধ্যে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অ্যাঞ্জেরারের অভিষেক হয় সেই গোলপোস্টের নীচেই। ২০০৭ সালে জার্মানিকে প্রমীলা বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দেন পুরো টুর্নামেন্টে একটিও গোল হজম না করে!

     

     

    বার্সেলোনার সাবেক গোলরক্ষক ভিক্টর ভালদেস ২০১০ সালে বিশ্বকাপ জেতেন স্পেনের হয়ে। ওই আসরের ক’মাস আগেই তিনি বলছিলেন ২৪ ফুট বাই ৮ ফুটের দুর্গ পাহারা দেয়ার চাপটা কেমন, “সপ্তাহের পর সপ্তাহ এই কাজটা করে যাওয়া চরম দুর্ভোগের। মাঝে মাঝে এতোটাই কষ্ট লাগে যে আমি নিজের জীবনটা ভিন্নভাবে কল্পনা করতে চেষ্টা করি। আমার স্বপ্ন ছিল আউটফিল্ডে খেলার।”

     

    কখন কি ভুল করে বসেন এই ভয়ে ১৮ বছর বয়সে নাকি তিনি খেলাটাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন! তবে সত্যি সত্যিই গ্লাভসজোড়া তুলে রাখার অনেক আগে দুনিয়া তাঁকে চিনে গেছে সময়ের অন্যতম সেরা গোলরক্ষকদের একজন হিসেবেই।

     

    ভিক্টর ভালদেস

     

    গেলো বিশ্বকাপে পর্তুগাল দলের গোলরক্ষক বেতো অকপটেই স্বীকার করেন যে তরুণ বয়সে গোলগাল ছিলেন বলে ফুটবল মাঠের এই পজিশনটাই তাঁর নিজের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছিল!

     

     

    বার্সেলোনার বর্তমান দলে গোলরক্ষক হিসেবে আছেন মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগান। মেসির মতো তারকাও বলের উপর যার পায়ের কারুকাজে মুগ্ধ! সেই স্টেগান গোলপোস্টের নীচে জায়গা বেছে নিয়েছিলেন আরও অদ্ভুত কারণে, তাঁর হাঁটা নাকি কেমন ছিল!

     

     

    আর চেলসির থিবো কোর্তোয়া গোলকিপিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন যেদিন তিনি আবিষ্কার করেন যে ডাইভ দেয়ায় তিনি দারুণ দক্ষ! “বাড়ির বাগানে আমাদের একটা বিচ ভলিবলের কোর্ট ছিল। সেখানে বলের জন্য ডাইভ দিতে দিতে ফুটবল মাঠেও আমি একই কাজ করতে শুরু করলাম। দলের বাকিরা যখন আমাকে ডিফেন্স আর গোলপোস্টের মধ্যে একটা বেছে নিতে বললো, আমি সানন্দে দ্বিতীয়টাই নিলাম!”

     

    থিবো কোর্তোয়া
     


    জাল বাঁচিয়ে তাঁরাও জাল কাঁপান…

     

     

    গোল করার স্বপ্ন যতই থাকুক, একবার গ্লাভসজোড়া বেছে নিলে সে স্বপ্ন মনের গহীনেই রেখে দিতে হয় বেশীরভাগ গোলরক্ষককে। তবে সবাই এই দলে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। মেক্সিকোর সাবেক কীপার জর্গে ক্যাম্পোস তেমনই একজন। গোল বাঁচানোটাই কর্তব্যজ্ঞান করে নেয়ার আগে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রথম মৌসুমে স্ট্রাইকার হিসেবে করেছিলেন ১৪ গোল।

     

    জর্গে ক্যাম্পোস

     

    ‘৯৪ আর ‘৯৮-এ মেক্সিকোর গোলদ্বারে প্রথম পছন্দ হলেও নিজের প্রথম প্রেম পুরোপুরি ভুলে যান নি কখনই। খেলার মাঝে আচমকাই তাঁকে প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গে আবিষ্কার করলেও তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। আটলান্টের বিপক্ষে এক ম্যাচে তো বাইসাইকেল কিকেও গোল করে বসেছিলেন!

     

     

    ফুটবলটা দিনে দিনে এমন শিল্প হয়ে গেছে যাদের গুণে তাঁদেরই আরেকজন ইটালির আট্টিলিও রেরে। প্রতিভাবান এই মিডফিল্ডার একদিন অনুশীলনে দেরি করে আসায় কোচের দেয়া শাস্তি হিসেবে ঠাই পান গোলপোস্টের নীচে। সেদিন এতোটাই ভালো কারিশ্মা দেখিয়ে বসেন যে বেশ কিছুদিনের জন্য গ্লাভসজোড়া হাতে তুলে নেন। ১৯০৬ সালে এসি মিলানকে একটা শিরোপাও জেতাতে সাহায্য করেন। নতুন কোচ এসে অবশ্য তাঁকে মিডফিল্ডে ফিরিয়ে নেন।

     

     

    এই প্রজন্মের ফুটবল দর্শক অবশ্য ‘গোল স্কোরার’ গোলকিপার হিসেবে সবচেয়ে বেশী চেনে প্যারাগুয়ের লুইস চিলাভার্টকেই। গোলরক্ষকদের ব্যাপারে তাঁর ধারণাটা শুনুন, “দক্ষিণ অ্যামেরিকার কোন বাচ্চাই গোলকিপার হতে চায় না। এখানে এই কাজের দায়িত্ব চাপে অকর্মা, মোটাসোটা ছেলেগুলোর কাঁধে, কখনও কখনও বলের মালিক বাচ্চাটাকেও পাঠানো হয়।”

     

    ফ্রি কিক নিচ্ছেন চিলাভার্ট

     

    চিলাভার্টকে অবশ্য এসবের কোনটাই গোলপোস্টের নীচে পাঠায় নি! মনেপ্রাণে তিনি সবসময়ই একজন স্ট্রাইকার, ডেড বলে তাঁর জাদুকরী দক্ষতার জন্যই যাকে মনে রাখবে বিশ্ব।

     

     

    ওয়েস্টহ্যাম ইউনাইটেডের স্প্যানিশ গোলরক্ষক আদ্রিয়ান ৯ বছর বয়স পর্যন্ত খেলতেন আক্রমণভাগেই। গোলরক্ষকদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যটা উঠে এলো তাঁর দার্শনিক বয়ানেই, “আমরা প্রত্যেক গোলরক্ষকই এমন একেকজন ফুটবলার যা আমরা হয়ে উঠতে পারি নি।”

     

     

    তাঁর দল অবশ্য সম্প্রতি তাঁকে শৈশব স্মৃতি ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ করে দিয়েছিল। এফএ কাপের এক ম্যাচে এভারটনের বিপক্ষে পেনাল্টি শ্যুট আউটে গোল করার পর স্মিতহাস্যে ২৮ বছর বয়সী স্প্যানিশম্যানের প্রতিক্রিয়া, “আরেকটা সুযোগ পেলে মন্দ লাগবে না!”

     

    এফএ কাপে দলের হয়ে গোল করার পর আদ্রিয়ান

     

    আদ্রিয়ানের এই সরল স্বীকারোক্তি হয়তো প্রতিটি গোলরক্ষকের মনের কথাই। গোল বাঁচানোটা পেশা হতে পারে, কিন্তু গোল করার যে নেশা তা কি এতো সহজেই কাটিয়ে ওঠার!