পেস ব্যাটারি- নতুন দিন?

"বিশ্ব-ক্রিকেটে কখনোই খুব একটা প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা রাখতে পারেনি বাংলাদেশের 'পেস ডিপার্টমেন্ট', বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে বেশিরভাগ সময়েই স্পিনারদের আড়ালে চাপা পড়ে ছিলেন টাইগার পেসাররা। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু চিত্র, পাইপলাইনে থাকা পেসাররা ও পেস ডিপার্টমেন্টের কাঠামো বিশ্লেষণ করে আলোর রেখা খুঁজেছেন আরেফিন নাদভী"
চলে আসছে বহু আগে থেকে, এইতো ক’টা মাস আগেও এমনই ছিল চিত্রটা, পেসাররা দলে আসছেন যাচ্ছেন, থিতু একটা পেস আক্রমণ গড়ে তোলার চেষ্টাটা বিফলেই থেকে যাচ্ছে বারবার। একজনকে কয়েক ম্যাচের জন্যে সুযোগ দেওয়া হল তো কয়েক ম্যাচ আবার অন্য কাউকে। একমাত্র মাশরাফি ছাড়া জাতীয় দলে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে পারেননি কেউই। একথা ঠিক যে আর কেউ স্থায়ী অবস্থান তৈরি করার মত পারফরমেন্স দেখাতেও পারছিলেন না। তবে এর দায়ভার যে শুধুমাত্র ক্রিকেটারদের উপরই বর্তায় না, এমন কথাও অতীতে বহুবার উঠেছে।
এবারের বিশ্বকাপ আবার নতুন করে উসকে দিয়েছে আগুনটা। উপযোগী ক্ষেত্র পেলে যে বড় কিছু করে দেখানোর সাধ্য টাইগার পেসারদের মধ্যে আছে, আরও একবার প্রমাণ করলেন তাঁরা। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার উইকেটগুলো কিন্তু সচরাচর যেমন দেখা যায়, অতটা পেস সহায়ক করেও প্রস্তুত করা হয়নি। তবে ওটুকুই যথেষ্ট ছিল রুবেল, তাসকিনদের জন্য। গতির ঝড় তুলে বড় বড় ব্যাটসম্যানদেরও অপ্রস্তুত করেছেন, ফেলেছেন বাউন্সার বা ইয়র্কারের ফাঁদে। মাশরাফির কথা তো নতুন করে বলার কিছুই নেই।
পেস উপযোগী উইকেট বানানোর পরিকল্পনা অবশ্য ইতিমধ্যেই শুরু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), কিছুদিনের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে কোথায় কিভাবে গতি ও বাউন্স সমৃদ্ধ পিচ স্থাপন করা যায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তারা। কতদিনের মধ্যে পূর্নাঙ্গ কাজ সম্পন্ন হয়, দীর্ঘসূত্রিতা পেয়ে বসে কিনা, সেটা একটা দেখার বিষয়। তবে বিসিবির এই প্রকল্প কাগজে-কলমে থাকা অবস্থাতেই সম্ভবত নতুন একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
যেমনটা বলা হচ্ছিল, ক’মাস আগের চিত্রও ছিল এমন, এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে- তবে কি একটা বিশ্বকাপই রাতারাতি বদলে দিল পেস আক্রমণ? ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। একটা টুর্নামেন্ট কখনোই একটা দলকে আমূল বদলে দিতে পারে না। বাংলাদেশ দলের পেস ব্যাটারিটা আসলে ‘চার্জ’ হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই, এবং এখনও হচ্ছে। বিশ্বকাপে আসলে সেটারই একটা ছোট্ট ঝলক দেখা গেছে মাত্র।
রুবেলের কথাই ধরা যাক। প্রথম যখন এলেন জাতীয় দলে, লাইন-লেংথের অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না, শুধু গতিই ছিল তাঁর সম্বল। সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে লাইন ও লেংথের ভুলগুলো শুধরেছেন তিনি, তবে এর জন্য গতির ব্যাপারে আপোস করেননি মোটেই। মাশরাফির মত আজ তিনিও পেস আক্রমণে ‘অটোমেটিক চয়েস’। বিশ্বকাপের ফর্মটা যে একদমই পড়েনি, তাঁর প্রমাণ দিয়েছেন সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগ (বিসিএল)-এ, তিন ম্যাচ খেলে একটি দুটি নয়, তুলে নিয়েছেন নয়-নয়টি উইকেট। তাসকিন আহমেদ, জাতীয় দলে ঢোকার আগে থেকেই আলোচিত হয়ে আসছিলেন সদ্য কৈশোর পেরুনো এই পেসার। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ নয়টি উইকেট তাঁর ঝুলিতে, বিসিএল-এর দুই ম্যাচ খেলে পেয়েছেন পাঁচ উইকেট। ছন্দময় ও আগ্রাসী বোলিং অ্যাকশন, দুরন্ত গতি- সবকিছুই ইঙ্গিত করে পূর্নাঙ্গ একজন ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠার দিকে। এটা ঠিক যে, সে লক্ষ্যে আরও কিছুটা পথ অতিক্রম করতে হবে তাসকিনকে। তবে দলে স্থায়ী জায়গা করে নিতে খুব বেশি সময় যে তাঁর লাগবে না, এমনটাই মনে করেন সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা।
একটা থিতু পেস আক্রমণ গড়ার খুব কাছাকাছি যে চলে এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট, তাঁর বড় প্রমাণ দলের বাইরে থাকা পেসারদেরও অনবরত চাপ প্রয়োগ। শফিউল, আল আমিনরা প্রায় সবসময়ই ভালো করেন ঘরোয়া লীগগুলোতে। নাজমুল বা মোহাম্মদ শরিফও নিয়মিত পারফরমার। গেল জাতীয় লীগে গতির ঝড় তুলে আলোচনায় এসেছেন মোহাম্মদ শহীদ। তবে এঁদের সবাইকে টেক্কা দিয়ে পাকিস্তান সিরিজের ওয়ানডে স্কোয়াডে জায়গা করে নিয়েছেন আবুল হাসান। এতে অবশ্য তাঁর বোলিং পারফমেন্সের একক ভূমিকা নেই, ব্যাট হাতে তাঁর অবদানও নিয়ামকের কাজ করেছে এ অন্তর্ভুক্তির পেছনে। তবে বল হাতেও যথেষ্ট কৃতিত্ব তিনি দেখিয়েছেন জাতীয় লীগ ও সদ্যসমাপ্ত বিসিএল-এ। বিসিএল-এ নিয়েছেন সাত উইকেট। মূল একাদশের পেস ব্যাটারিতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে তাসকিনের সাথে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির স্বাদ পাওয়া এ পেসারের।
সব মিলিয়ে নতুন একটা নতুন দিগন্তের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশের ‘পেস ডিপার্টমেন্ট’। কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব ক্রিকেটে সদর্পে ছড়ি ঘোরাবে না টাইগারদের পেস ব্যাটারি?