ও আমার 'সাকিব'পঙ্খীরে....
আপনি শফিউল হতে চাইতেন না সে সময়।
চতুর্ভুজের চার বাহুর মতো করে চারজন ফিল্ডার ছুটে আসছিলেন। চতুর্ভুজ ত্রিভুজ হয়ে গেল, শফিউল হয়ে গেলেন ত্রিভুজের মধ্যমা। ক্যাচ বরাবর সরলরেখাতেই ছিলেন, ক্যাচ মুষ্ঠিবদ্ধও করলেন। কিভাবে কিভাবে যেন পড়ে গেল সেটা। মধ্যমা সরলরেখা থাকলো না, বক্ররেখা হয়ে গেল।
সাকিব এই ফাঁদটা পাতার জন্য এক বল আগেই একটা ছয় খেয়েছেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে, কামিন্স ক্যাচ তুলে দিয়েছেন, সেই ক্যাচ হাতে পুরেছেন শফিউল। ভার সামলাতে পড়ে গেছেন, পড়ে গেছে ক্যাচটাও।
সাকিব চিৎকার করলেন না। পা দিয়ে মাটিতে লাথি মারলেন না। হাত ঝাঁকিয়ে ঘুরলেন না। শুধু অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। সাকিবের চোখমুখের অনুবাদ করলে একটা শব্দই বেড়িয়ে আসে, হতাশা। কামিন্স-অ্যাগারের জুটি যেন 'ওয়াল'-এর ওপাশের 'হোয়াইট ওয়াকার'দের সঙ্গে লড়াই করে এসে 'নাইট ওয়াচ'-এর কাছে আটকে যাওয়ার মতো! শফিউলের ভুল সে 'নাইট ওয়াচ'কে আরও নাছোড়বান্দা করে দিল। কেউ সে সময় শফিউল হতে চায় না, কেউ সে সময় ক্যাচ মিস করতে চায় না।
সেই কামিন্স বোল্ড হলেন। ব্যাটে আটকালো না বল, প্যাডে আটকালো না। সাকিবকে কিছুতেই আটকানো গেল না। একহাত তুলে সন্তুষ্টির দৌড় শুরু করলেন, কেউ একজন পিঠে চড়ে বসলেন। সাকিব বাংলাদেশ দলটা বয়ে নিচ্ছেন, একজনের ভার কোনও ব্যাপার নাকি!
আপনি সে সময় পিঠে চড়া সেই ফিল্ডারটা হতে চাইতেন।
সুইপ করার ভঙ্গিমা। অবশ্য সুইপের জন্য স্ট্যান্সটা বড্ড নড়বড়ে। আশার কথা, সাকিব সুইপ করছেন না, সাকিবের পায়ে প্যাড নেই, হাতে গ্লাভস নেই, ব্যাট নেই। দুই হাতে ওপরের দিকে, দুই তর্জনি ঝাঁকাচ্ছেন। আম্পায়ারকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন। নাইজেল লং ‘সন্তুষ্ট’ হলেন। ভূমির সমান্তরালে আঙ্গুল তুললেন। তর্জনি। সাকিব উঠলেন, দুই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেল। দৌড় শুরু করলেন হঠাৎ করেই। যেন তিনি উসাইন বোল্ট, দৌড় শুরুর সংকেতটা পেয়েছেন, ‘স্টার্ট’ করতে একটু দেরি হয়েছে। সতীর্থদের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলেন, হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে। সাকিবকে আটকাতে পারবে কে! তিনি ‘ওয়ান্টেড’ ছবির জেমস ম্যাকাভয়ের ছোঁড়া সেই গুলি, দিক বদল করে লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত করে যা! সাকিব থামলেন, উদযাপনে মিশে গেলেন। ন্যাথান লায়ন ‘পাহারা’ দিতে এসেছিলেন, সাকিব নামের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে নিজেই পরাহুত হয়ে ফিরে গেলেন!
আপনি লায়নের ব্যাট হতে চাইতেন না তখন।
ম্যাট রেনশর শরীরটা ক্ষণিকের জন্য ঝাঁকি দিল। মুমূর্ষু রোগি যেন শেষ মুহুর্তে অক্সিজেন পেয়েছেন। সৌম্যর হাতে আঘাত করে বল উঠে গেছে। সাকিব বল করেই ‘চেস্ট-অন’ স্টাইলে দাঁড়িয়ে যান, এবারও তাই করলেন। রেনশ যখন অক্সিজেন পাচ্ছেন, সাকিবের আঙ্গুলটা নেমে আসছে। যে আঙ্গুলটা উদযাপনের জন্য উঠেছিল, সেটা ক্ষণিকের জন্য নিরাশ হয়ে গেল। রেনশর অক্সিজেন ফুরিয়ে এল, সৌম্য হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে গিয়েই বলটা ধরলেন। রেনশর আশা ফুরিয়ে এসেছে, সাকিব উদ্বাহু দাঁড়িয়ে। দুই আঙ্গুল তুলে। ক্যামেরা জন্য পোজ? ক্যামেরা সাকিবকে খুঁজে ফেরে, সাকিব ক্যামেরার দিকে তাকান না।
তবে আপনি হয়তো সে সময় ক্যামেরা হতে চাইতেন। সাকিবকে ধরে রাখতে চাইতেন।
ম্যাক্সওয়েল তেড়েফুঁড়ে এসেছেন। সাকিবকে মারবেন, সাকিবকে দূর-সুদূরে পাঠাবেন। মধ্যপথেই বুঝলেন, ভুলটা হয়ে গেছে! সাকিব তার লেংথ কমিয়ে ফেলেছেন, এগিয়ে এসেও যা ম্যাক্সির নাগালের বাইরে। বলটা পড়বে, তীক্ষ্ণ একটা টার্ন নেবে। ম্যাক্সওয়েল বোকা বনলেন। সাকিব কোনও এক নাম না জানা নাচের মুদ্রার মতো করে এক হাত ওপরে, এক হাত নিচে করে ছুটলেন। কেউ একজন পিঠে চড়ে বসলেন। সাব্বিরই হয়তো। আপনি তখন সাব্বির হতে চাইতেন না?
হ্যাজলউড ক্যাচ দিয়েছেন। ইমরুল ধরেছেন। সাকিব এক হাতের আঙ্গুল ওপরে তুলেছেন। ১৭তম বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট হয়ে গেছে সাকিবের, অলরাউন্ডার সাকিবের রেকর্ডটা আরেকবার সমৃদ্ধ হয়েছে। সাকিব এক হাতে ক্যাপ নিলেন, আরেকহাত থাকলো উঁচুতেই। আবেগে ভেসে যান, কিন্তু বাস্তবতা ভোলেন না। উল্লাসে মাতেন, পরের কাজটা মাথায় থাকে।
আপনি একবার নাইজেল লংয়ের জায়গাতেই নিজেকে কল্পনা করে নিলেন হয়তো! সাকিব আপনার কাছ থেকে তার ক্যাপটা নিচ্ছেন, ভাবা যায়!
উসমান খাওয়াজার মুখে হাসি। আগের ইনিংসে তার মানসিক বিভ্রাট হয়েছিল। বিখ্যাত মানসিক চিকিৎসক গোপিকান্ত রায়ও (তাকে চিনবেন না, রংপুরে বসতেন একসময়) খাওয়াজার বিভ্রাট ধরতে ঘাম ছুটাতেন। সেই খাওয়াজার মুখে হাসি, সাকিব কিছু একটা বললেন, হাসিটা বেড়ে গেল। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নামছেন, মাথার ওপর লম্বা লিডের বোঝা না থাকলেও মাঝারি লিডের বোঝা আছে। সাকিবের ফ্লাইট বুঝলেন না, সাকিবের লেংথ বুঝলেন না, বলের বাউন্স তো আরও পরের কথা। সুইপ করলেন, উঠে গেল, তাইজুল সে সময় ভুল করতে পারেন না। খাওয়াজার মানসিক বিভ্রাটের সমাধান হলো কিনা, সেটা প্রশ্ন থাকতে পারে, সাকিবের কী হলো, বড় প্রশ্ন এটাই। খাওয়াজার দিকে তেড়েফুঁড়ে গেলেন, কিছু একটা বললেন। পেছন থেকে আম্পায়ার আলিম দার ইশারায় কিছু একটা বললেন সাকিবকে, সাকিবের সেসব শোনার সময় নেই। ন্যাথান ম্যাককালামকে বোল্ড করেও সাকিব উদযাপনে ক্ষীপ্রতা এনেছিলেন। বাংলাওয়াশে। অথবা ওয়াহাব রিয়াজের সঙ্গে সেই বাক-বিতন্ডায়। হাত দেখিয়ে দেয়া সেই সরে পড়ার সঙ্কেতে। যেখানেই হোক, পাড়ায় ঝগড়া লাগলে একজনকে হয়তো জাপটে রাখা যায়, মুখ তো আর বন্ধ করা যায় না!
আপনি সে সময় আলিম দার হয়ে একটু ‘অভিভাবক’ বনে যেতে চাইতেন নাকি!
তবে আপনি সৌম্য হতে চাইতেন না একটু পর। ‘প্রথম বাজিতেই শালা মাত করে দিতাম’ সংলাপটা আপনার মনে পড়ে যেতো হয়তো, সাকিব যে প্রথম ওভারে এসেই ওয়ার্নারের উইকেট পেতে পারতেন। সৌম্য ক্যাচটা বুঝলেন না। সৌম্য, কী ভাবছিলেন আপনি? নাকি মনমরা হয়ে ছিলেন?
সৌম্য হাত সরিয়ে নিলেন। মাথা সরিয়ে নিলেন। বলকে দেখে চমকে গেলেন। সাকিব ‘প্রথম বাজিতেই মাত’ করতে পারলেন না।
আপনি পরদিন সৌম্য হতে চাইতেন। তার মতো দুইবার চেষ্টা করে দুইটি ক্যাচ নিতে চাইতেন অবশ্য।
সেই ওয়ার্নার সুইপ করতে গিয়েছিলেন। সাকিবের কমিয়ে ফেলা লেংথ দেখে ওয়ার্নারের ব্যাট পুলের দিকে মনোযোগ দিতে চাইল। ৭২০পি 'রিজোলোউশন' এর ভিডিও ফাইলকে নাহয় 'থ্রিজিপি' করতে পারেন, 'থ্রিজিপি' থেকে উল্টোটা করলে কী আর হয়! সাকিবের টার্ন করা বলে ওয়ার্নারের করতে না চাওয়া সুইপ বা করতে চাওয়া পুল ব্যর্থ। আলিম দার সময় নিলেন না, সাকিব দারের মতো কোনও আম্পায়ারের মতো করেই দুই হাত তুলে ছয়ের সঙ্কেত দিতে দিতে, উল্লাস করতে করতে এগিয়ে আসলেন। ওয়ার্নারের চোখমুখে দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর ছাপ, রিভিউটা নিলেন কোনও মিরাকলের আশায়। মিরাকল হলো না।
স্মিথকে আউট করে সাকিব দিলেন ওয়াইডের সঙ্কেত, দুই হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই। নো-বল পরখ করে দেখা হলো, রিভিউ বাদেও এ ম্যাচে অন্তত দুইবার করা হলো এমন। সাকিবের পা জায়গামতো ছিল, স্মিথ জায়গামতো থাকতে পারলেন না।
দার আরেকবার আউট দিলেন। প্রথম ইনিংসে রিভিউ নিলে বেঁচে যেতেন ওয়েড, দ্বিতীয় ইনিংসে এসে ভুল শোধরাতে চাইলেন। সাকিব ততক্ষণে নেচে নিয়েছেন একচোট। সাকিবের সে নাচের ভিডিও বা জিফ পরে ভাইরাল হবে। ফেসবুকের কোনও এক ইমোজির সঙ্গে মিল খুঁজে বের করবে লোকে। আপাতত ওয়েডের রিভিউয়ের দিকে নজর সবার।
আপনি সাকিবের নাচের সঙ্গী হতে চাইতেন। আপনারও হয়তো তখন নাচতে ইচ্ছা করছিল, আমার মতোই।
কাঁটা হয়ে ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। ম্যাক্সওয়েল ভয়ঙ্কর, ম্যাক্সওয়েল মারতে শুরু করলে খবর আছে। অস্ট্রেলিয়া ভয়ঙ্কর, তারা হারার আগে হারে না, টেইল-এন্ডাররাও সহজে মানে না! লাঞ্চের পর প্রথম বলটা নিচু হলো। ম্যাক্সওয়েল বেশি উঁচুতে ছিলেন। তার ব্যাট নেমে আসতে পারলো না। ভারত সফরে তার সেঞ্চুরির টাইমিংটা অসাধারণ ছিল, এ বলে ব্যাট নেমে আসার টাইমিংটা জুতসই হলো না। বল ফাঁকি দিয়ে চলে গেল, ম্যাক্সিকে চলে যেতে হলো। দ্বিতীয়বার ম্যাচে দশের কোটা পূর্ণ করলেন সাকিব। এরপর সাকিব উড়তে চাইলেন। পাখা মেলে, 'কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা' গাইতে গাইতে। নাসির এসে ঘাড়ে চড়ে বসলেন। আহা, আপনি যদি সে সময় নাসির হতে পারতেন! আপনি তখন বলতেন, 'ও আমার উড়ালপঙ্খীরে...'।
বুকের একপাশে জমে থাকা ভয়টা ‘টুকি, টুকি’ বলে উঁকি দিচ্ছিল?
আরেকটি ফতুল্লা যদি হয়ে যায়! আরেকটি মুলতান যদি ফিরে আসে! আরেকটি ওয়েলিংটন অথবা চট্টগ্রামের আফসোসে যদি পুড়তে হয়! ভয়টা থাকতেই পারে। তাইজুলের ছিল না হয়তো। আরও আগেই সাকিব অনেক্ষণ এসে কথা বলেছেন, সে কথার পরমুহুর্তেই তাইজুল উইকেট নিয়েছেন। সাকিব অনেকক্ষণ কথা বলেছেন, প্রায়ই বলেন। সাকিব অধিনায়ক নন, সাকিব সহ-অধিনায়ক নন। তবে দূর থেকে দেখলে মাঝেই মাঝেই মনে হবে, সাকিব কেউ একজন। এদিনও হয়েছিল।
সেই তাইজুলের নিচু হওয়া বলে হ্যাজলউড ব্যাট বাড়িয়ে খেলতে গেলেন। ব্যাটের আগে প্যাড গেলো, কতো বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদেরই তো এই ভুল হলো, আর তিনি তো ব্যাটিং অর্ডারের ‘গোলাম’! তাইজুল আবেদন করলেন। সুইপের ভঙ্গিমায়। সাকিবের মতো করে।
নাইজেল লং আউট দিলেন। তাইজুল দুইহাত মেলে দাঁড়ালেন, কিছুটা সাকিবের মতো করে। সাকিব এসে তাইজুলের পাশে দাঁড়ালেন। কিছু একটা বললেন। তাইজুল সাকিবের কোলে উঠে গেলেন। সাকিবের বুকে হারিয়ে যেতে চাইলেন যেন। সাকিব মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ‘পাগল ছেলে, বড় হবি যা’!
তামিম তাইজুলকে অভিনন্দন জানিয়ে সাকিবকে জড়িয়ে ধরলেন। তামিমের দুইটি ইনিংস বাদ দিলে বাংলাদেশের জয়টাও বাদ দিতে হয়, তবুও জানেন, এই সাকিব না থাকলে অনেক কিছুই থাকে না বাংলাদেশের।
একটিবারের জন্য আপনি তাইজুল হতে চাইতেন তখন। অথবা তামিম। অথবা অন্য কেউ। একটিবার আপনি সাকিবকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইতেন তখন।
আপনি গাইতেন, ‘তোর হইবে মেঘের উপ্রে বাসা….’।
সাকিব আপনার উড়ালপঙ্খী। সাকিব আমার উড়ালপঙ্খী। সাকিব উড়াল দিয়ে যান। আমরা সাকিবকে দেখি।