• " />

     

    একজন দুঃখী রাজকুমারের গল্প

    একজন দুঃখী রাজকুমারের গল্প    

    .

    ২০০৮ ইউরো ফাইনালের অন্তিম মূহূর্তের খেলা চলছে তখন। প্রথমার্ধে ফার্নান্দো তোরেসের গোলে ৪৪ বছর পর আন্তর্জাতিক শিরোপাজয়ের স্বপ্নে বিভোর স্পেন। এমন সময় বাঁ-প্রান্ত থেকে ক্রস করলেন লুকাস পোডলস্কি। হাওয়ায় ভাসতে থাকা বলে হেড করে ডিবক্সের বাইরের দিকে পাঠালেন মিরোস্লাভ ক্লোসা।

    ক্ষণিকের জন্য যেন সময় থেমে গেল। মাঠে উপস্থিত জার্মান সমর্থকদের কেউই তখন বসে নেই। ক্লোসার বাড়ানো পাসে ভলি করলেন তিনি। দর্শকসারিতে গুটিকয়েকজনকে হাত উঁচু করে উদযাপন শুরুও করে দিয়েছেন বলে। জায়গা থেকে নড়ার কথা চিন্তাও করলেন না ইকার ক্যাসিয়াস। করবেনই বা কীভাবে? বল যে তার নাগালেরও ঢের বাইরে! অস্ট্রিয়ার আর্ন্সট-হ্যাপেল স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার পঞ্চাশেক মানুষের মাঝেও তখন পিনপতন নীরবতা...

    কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকালেন না। বল চলে গেল গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে। কিছুক্ষণ বাদেই পুয়োল-ক্যাসিয়াসরা মেতে উঠলেন শিরোপার উল্লাসে। হাঁটু গেড়ে তখন মাঠের ঠিক মাঝখানে বসে রইলেন একজন। শুন্যদৃষ্টি, কান্না লুকোনোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অধিনায়করা কি কাঁদে নাকি আবার? এমন তো নয় যে এবারই প্রথম তীরে এসে তরী ডুবলো তার...

    তিনি মাইকেল বালাক। জার্মান ফুটবল যদি কোনো ঠাকুরমার ঝুলি হতো, তিনি হতেন তার দুঃখী রাজপুত্র। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জার্মান ফুটবলকে প্রায় একা টানলেও প্রতিবারই ফিরেছেন খালি হাতেই; হতাশা আর বেদনায়।

     

    তরুণ মাইকেল বালাক

     

    .

    বালাকের ক্যারিয়ারের শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না মোটেও।  মাত্র সাত বছর বয়সেই জন্মস্থান গোরলিতজের ক্লাব চেমনিৎজার এফসির একাডেমীতে যোগ দেন। বাবার স্বপ্ন, ছেলে একদিন বড়মাপের ফুটবলার হবে। কিন্তু ইঞ্জুরিতে প্রায় ধূলিস্যাৎই হতে বসেছিল স্টেফান বালাকের স্বপ্ন। বয়সভিত্তিক দলে হাঁটুর গুরুতর এক ইঞ্জুরিতে পড়ার পর ডাক্তার বললেন, ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা ভুলে যেতে। পিতা ভেঙ্গে পড়লেও বালাক আশা হারাননি। আর তখনই তার জীবনে দেবদূত হয়ে আসেন বর্তমানে চেমনিৎজার এফসির বয়সভিত্তিক দলের কোচ উলাস কুটনারের।

    মাসের পর মাস বালুতে বল ছাড়া ট্রেনিং, নিয়মমাফিক হাঁটুর যত্ন- বালাককে মাঠে ফেরাতে কোনো কমতি রাখেননি কুটনার। সতীর্থরা মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেও খেলতে না পারার দুঃখকেই শক্তিতে পরিণত করেন বালাক। শেষমেশ প্রায় বছরখানেকের রিহ্যাবের পর ডাক্তারদের সবুজ সংকেত নিয়ে ফুটবলে ফিরলেন তিনি। চাপে ভেঙ্গে না পড়ার দুর্দান্ত ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছিলেন তিনি।

    চেমনিৎজারের পর ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে কাইজারস্লটার্নে যোগ দেন বালাক। প্রথম বিভাগে ফিরেই বুন্দেসলিগার শিরোপা ঘরে তোলে ক্লাবটি। এর বছর দুয়েক পর পাড়ি জমান আরেক জার্মান ক্লাব বায়ার লেভারকুসেনে। খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা এখানে কাটালেও এই লেভারকুসেন থেকেই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হতে থাকেন বালাক।

     

    ৩.

    ‘কপালে নাই আসলে’। ১৯৯৭ থেকে ২০০২- এই সময়টায় লেভারকুসেনের শোচনীয় পরিণতি যেন বহুল ব্যবহৃত এই উপমাটিকেই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৯৯-০০ মৌসুমের শেষ ম্যাচে বালাকেরই আত্মঘাতী গোলে হেরে লিগশিরোপা হাতছাড়া হয় তাদের। কিন্তু ভাগ্য যে ঠিক কতটা কঠিন- তা লেভারকুসেন হাড়ে হাড়ে টের পায় ২০০১-০২ মৌসুমে।

     

    জিদানের সেই গোলে ম্লান বালাকের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্ন

     

    লিগের মাত্র তিন ম্যাচ বাকি থাকতে ডর্টমুন্ডের থেকে পাঁচ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল লেভারকুসেন। কিন্তু শেষ তিন ম্যাচের দুটিতে হেরে ডর্টমুন্ডকে রীতিমত লিগটা উপহারই দিয়ে দেয় তারা। জার্মান কাপেও শালকের কাছে হেরে যায় ৪-২ গোলে। লেভারকুসেনের একের পর এক শিরোপা হাতছাড়া করার কারণে ইংলিশ মিডিয়া বিদ্রূপ করে ক্লাবটির নাম দেয় ‘নেভারকুসেন’। তবে লেভারকুসেনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক হার ছিল সেবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। রূপকথার মত এক মৌসুম কাটিয়ে ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে যায় তারা। ম্যাচ শেষে জিদানদের উদযাপনের সময় মাঠে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন বালাক। এই একটি দৃশ্যই যেন তার ক্যারিয়ারের প্রতিচ্ছবি। এমন এক নৌকোর মাঝি তিনি, যার তরী ডুবে যায় প্রতিবারই; তীরে আর ফিরতে পারে না।

    কেবল ক্লাব নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বালাকের গল্পটা এত কাছে তবু এত দূরের। ২০০২ বিশ্বকাপে জার্মানিকে প্রায় একাই ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেমিতে তার গোলেই জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়াকে হারালেও হলুদ কার্ড দেখায় ফাইনাল মিস করেন তিনি। ইয়োকোহামা স্টেডিয়ামে সেদিন ‘দর্শক’ হয়েই রোনালদোদের কাছে জার্মানদের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখতে হয়েছিল বালাককে।

    ২০০২ সালে চারটি শিরোপা হাতছাড়া করলেও সেবার ইউরোপের সেরা মিডফিল্ডারের পাশাপাশি বর্ষসেরা জার্মান ফুটবলারের খেতাবেও ভূষিত হয়েছিল বালাক। তবে সেসব সান্ত্বনা মেটাতে পারেনি বালাকের অপূর্ণতা। 

     

    ৪.

    বালাকের পরিণতি দেখে মার্সেলো লিপ্পি একবার বলেছিলেন, “আমার কাছে মনে হয় কোনো অশুভ শক্তির কু-নজর পড়েছে তার ওপর। নাহলে কেনইবা এমনটা হচ্ছে?” উত্তরটা আজ অব্দি কেউ জানেন না, স্বয়ং বালাকও হয়তো না। কিন্তু ক্যারিয়ারজুড়ে ‘অভাগা’ বালাক যে হতাশা-বিষণ্নতার গ্রাসে ফুটবল থেকে হারিয়ে যাননি- এটাই কি বেশি নয়?

     

    পর্তুগালকে হারিয়ে ইউরো '০৮-এর সেমি নিশ্চিত করার উল্লাসে জার্মান অধিনায়ক বালাক

     

    “যার জন্য করি চুরি, সে-ই বলে চোর”। জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ ’০৬-এর সেমি থেকে বিদায় এবং ইউরো ’০৮-এ আবারও রানার্স আপ হওয়ার পর বালাককেই ক্রুশে চড়ান খোদ জার্মান সমর্থকরা এবং ফেডারেশনের হর্তাকর্তারা! এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মোটামুটি গড়পড়তা দলকে একা টানার পরও এমন প্রতিদানে প্রচন্ড হতাশ হন বালাক। শরণাপন্ন হন ছেলেবেলার প্রিয় গুরু কুটনারের, জানান অবসরের চিন্তাভাবনা। কুটনার তখন তাকে মনে করিয়ে দেন সেই ছেলেবেলার কথা, যখন ছোট্ট বালাক বলতেন, “একদিন জার্মানির অধিনায়ক হয়ে মাঠে নামবো আমি”। কুটনারের উদ্দীপনাতেই প্রবল মানসিক চাপের পরেও অবসরের চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলেন বালাক।

    ২০০২ এবং ২০০৮- এই দুটি বছর বালাকের ভাষ্যমতে ছিল ‘নারকীয়’। ২০০৮-এ ইউরোর পাশাপাশি ইউসিএল ফাইনালেও চেলসির হয়ে রানার আপ হন তিনি। আবারও হাতছাড়া হয় একজন ফুটবলারের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা দুই অর্জন। অনেকের মতে, জার্সি নম্বর ‘১৩’ হওয়াতেই ক্যারিয়ারজুড়েই দুর্ভাগা ছিলেন তিনি।

     

    .

    জার্মানির হয়ে মাত্র ৯৮ ম্যাচে ৪২ গোল করেছিলেন বালাক, তিনবার হয়েছিলেন জার্মানির বর্ষসেরা ফুটবলার। জন্মটা যেন ভুল সময়েই হয়েছে তার। না পেয়েছেন রুডি ভোলারদের স্বর্ণযুগকে, না পেয়েছেন হালের ওজিলদের। তার সময়ে জার্মানিতে বিশ্বমানের খেলোয়াড়ই ছিল হাতেগোনা। এজন্যই বিখ্যাত জার্মান লেখক উডো মুরাস একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, “বালাক ছিলেন জার্মান ফুটবলের দুঃসময়ের একমাত্র আশার আলো”।

    ক্যারিয়ারজুড়ে সবসময়ই দেশের কথাটাই চিন্তা করেছেন আগে। দলের প্রয়োজনে খেলেছেন প্রায় সব পজিশনেই। ২০১০ সালে গুরুতর ইঞ্জুরিতে পড়ে বিশ্বকাপ মিস করেন বালাক। সেই সাথে কোচ জোয়াকিম লো এবং অধিনায়ক ফিলিপ লামের সাথে মন কষাকষির কারণে আর জার্মানদের সাদা জার্সি গায়ে চাপানো হয়নি তার। জাতীয় দলের হয়ে ৯৮-এ আটকে যাওয়া ম্যাচের সংখ্যাটাকে ‘সেঞ্চুরি’তে নিতে তাকে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দিয়েছিল জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। কিন্তু সেই প্রস্তাবকে ‘হাস্যকর এবং দায়সারা’ বলে উড়িয়ে দেন অভিমানী বালাক।

    একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জার্মান ফুটবলকে পথ দেখিয়েছিলেন তিনিই। তিনবার শিরোপাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে হার মানতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এরপরও হাল ছাড়েননি একবারের জন্যও। পেলের ‘সেরা ১২৫ জীবন্ত কিংবদন্তী’ লিস্টে বালাকের অন্তর্ভুক্তিই প্রমাণ করে, ঠিক কতটা বড়মাপের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের সময়ের সেরাদের একজন হয়েও শেষ পর্যন্ত ট্রয়ের হেক্টর বা মহাভারত্যের কর্ণের মতোই হয়ে গেছেন ট্র্যাজেডির নায়ক। সেই অপ্রাপ্তি যতটা না বালাকের, তার চেয়ে বোধ হয় অনেক বেশি ফুটবলের।