দ্য গ্রেট এসকেপ : যে উল্লাস ছড়িয়ে গেল সবখানে
এমন খবর প্রতিদিন আসে না। এই যুদ্ধপ্রবণ, ধ্বংসপ্রবণ পৃথিবীতে মানবতার জয়গান প্রতিদিন গায় না সবাই। সবাই একসঙ্গে মাতে না উল্লাসে। মানুষ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে, বেড়েছে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ। ফুটবল বিশ্বকাপের মতো ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এও দেখুন, একদলের উল্লাসে মিশে যায় আরেক দলের কান্না। পেছনে থাকে কতোকিছু- রাজনীতি, সংগ্রাম, বৈষম্য, হতাশা।
অথচ এই এমনদিনে, সবাই মেতেছে সবার উল্লাসে। ১৩টি প্রাণ ১৮ দিন আটকে থাকার পর বেরিয়ে এসেছে এক দুর্গম গুহা থেকে। এই যে সভ্যতার এতো এতো উত্তরণ, এর সুফল তো আর প্রতিদিন পায় না মানুষ! আমাদের বাংলাদেশেও দেখুন। এক সড়কেই কতো প্রান ঝড়ে যায়, তবুও সেই সুদূর থাইল্যান্ডের চরম বর্ষায় এই ১৩ জনের “মুক্ত” হওয়ার খবরে আপনি আরেকবার মনে করতে পারেন, মনুষ্য পৃথিবীতে আসলে মানবতার চেয়ে বড় কোনও সম্বল নেই!
চিয়াং রাই হাসপাতালের বাইরে উল্লাসে মেতেছেন থাই জনগণ। বাঁশি বাজছে, মানুষের মুখে হাসি। আনন্দের অশ্রু। উল্লাসে মেতেছে তো পুরো বিশ্বই। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটা গুহায় আটকে পড়া ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচের সবাইকে সফলভাবে উদ্ধার করা হয়েছে। বিবিসির সাংবাদিক হাওয়ার্ড জনসন তার সামাজিক প্রোফাইলে শেয়ার করেছেন এক মহিলার ছবি, ঠান্ডা শরবত এনেছেন তিনি সাংবাদিকদের জন্য। ফেসবুক-টুইটার-ইন্সটাগ্রাম, উল্লাস সবখানেই।
চিয়ান রাইয়ের প্রভিন্সিয়াল প্রেস অফিসের এক কর্মকর্তা রাচাপোল এনগামগ্রাবুয়ান আবেগতাড়িত হয়ে বলছেন, “আমার জীবনে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। সারাজীবন মনে রাখব আমি।”
“এমন সময় গেছে, আমি কেঁদেছি। খুশী আমি, অনেক খুশী। থাই জনগণ একে অপরকে এতোটা ভালবাসে!”
থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ও-চা বলেছেন, উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সবার জন্য একটা উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন তিনি।
সেই উদ্ধারকাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীরা তার আগেই গান ধরেছেন, থিসারা মে থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্প- টুইট করছেন সবাই। স্মরণ করছেন এ উদ্ধারকাজে জীবন দেওয়া সাবেক থাই নৌবাহিনীর সদস্য সামান কুনানকে। এই কিশোররা একটা ফুটবল ক্লাবের সদস্য বলে ফুটবল দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগটা সরাসরিই।
ফিফা এরই মধ্যে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে তাদের। অবশ্য আপাতত সেটা সম্ভব নয়। তবে ১১ তারিখের সেমিফাইনালে থাইল্যান্ডের সমর্থন পেতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড।
আটকে পড়ার নয় দিন পর থাইল্যান্ডের কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচ প্রথম যে বাইরের পৃথিবীর কারও কন্ঠস্বর শুনেছিলেন, সেটা ব্রিটিশ ডাইভার জন ভোলানঠেনের।
“তোমরা কয়জন?” তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তেরোজন? দারুণ?”
নিখোঁজ তেরোজন যে জীবিত, এবং তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে, এটার প্রমাণ ছিল তা। ভোলানঠেন ও রিচার্ড স্ট্যানটনের সঙ্গে ব্রিটিশ গুহা বিশেষজ্ঞ রবার্ট হার্পারকে ডেকে পাঠিয়েছিল থাই কর্তৃপক্ষ। ফুটবল দলটি হারিয়ে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় থাইল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন এই বৃটিশ দলের তিন সদস্য।
এর কৃতজ্ঞতাবশতই ইংল্যান্ডকে সমর্থন দিবে থাইল্যান্ড, জনসনকে এমনই জানিয়েছেন চিয়ান রাই হাসপাতালের বাইরে থাকা ৬৪ বছর বয়সী সাবেক থাই সরকারী কর্মকর্তা ম্যানোপ সুকসার্দ। কিশোরদের উদ্ধারের খবর নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের পৌঁছানোটা দেখতে এসেছেন তিনি।
সামান কুনানের প্রতি শ্রদ্ধা
মৌসুম শুরু হলে গোটা ফুটবল দলকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আর ইংলিশ ডিফেন্ডার কাইল ওয়াকার টুইট করেছেন, এই কিশোরদের জন্য ইংল্যান্ডের শার্ট পাঠাতে চান তিনি। আরও অনেকেই অনেক কিছু বলবেন। ঘন্টা কয়েক পরে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও হয়তো এমন কিছু হবে, থাইল্যান্ডের সেই কিশোরদের নিয়ে।
উদ্ধারকাজের এক কর্মী বুঝতেই পারছেন না কিভাবে সম্ভব হলো এটা, “আমরা নিশ্চিত নই, এটা মিরাকল। নাকি বিজ্ঞানের কারবার!”
এমন খবর প্রতিদিন আসে না। এমন উল্লাসে প্রতিদিন মাতে না মানুষ! প্রতিদিন আসলে মানুষ মনে রাখতে পারে না- মানবতার চেয়ে বড় কিছু নেই তাদের পৃথিবীতে।
তথ্যসূত্র- বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান