• বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ২০১৫
  • " />

     

    'গুপ্তচর' হাথুরুসিংহের 'মিশন অস্ট্রেলিয়া'

    'গুপ্তচর' হাথুরুসিংহের 'মিশন অস্ট্রেলিয়া'    

    গত মাসে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-২ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ হারের পিছনে ট্রেভর বেলিসের ভূমিকা কতটুকু ছিল বলতে পারেন? না, অংকের খাতায় হিসেব করে এসব হয়তো পরিমাপ করা যায় না। তবে ইংলিশদের বর্তমান কোচ খেলোয়াড়ি জীবনে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে যুগকাল খেলেছেন, কোচিং জীবনের শুরুটাও বছর চারেক ঐ দলে কাটিয়েই; অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ দলটার অন্তত নয়জন খেলোয়াড়ের সাথে সে সময় সরাসরি কাজ করেছেন। বেলিস নিজে যতই এই সিরিজ জয়ে ওসবের প্রভাব ছোট করে দেখতে চান না কেন, প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা জানা থাকাটা খেলার মাঠে কতোটা কাজে দেয় তা বুঝতে বোধকরি বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর তাঁর সহকারী পল ফারব্রেস ও শিষ্য মঈন আলী তো রাখঢাক না রেখেই বলে দিয়েছেন, অজিদের ঘরের খবর ভালোই কাজে দিয়েছে তাঁদের!

     

    স্মরণাতীতকালে অস্ট্রেলিয়া দলকে এমন বিড়ম্বনায় আর পড়তে হয় নি। তবে দ্বিতীয়বারের মতো একই ঝক্কি পোহাতেও তাঁদেরকে খুব বেশী দিন দেরি করতে হচ্ছে না! আসছে মাসের বাংলাদেশ সফরেই আরেক ‘বেলিস’-এর মোকাবেলা করতে হবে স্মিথদের! হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন বাংলাদেশ দলের বর্তমান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও পেশাগত সূত্রে এই অস্ট্রেলিয়া দলের অন্তত অর্ধেক ক্রিকেটারকে খুব ভালো করে চেনেন। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলস ও বিগ ব্যাশে সিডনি থান্ডারের হয়ে কাজ করার সময় হাথুরুসিংহের তালিম নেয়াদের দলে আছেন অজি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ, নাথান লায়ন, মিচেল স্টার্ক, উসমান খাজা, পিটার নেভিল, প্যাট কামিন্স ও স্টিভ ও’কেফ।

     

    নিউসাউথ ওয়েলসের সহকারী কোচ থাকাকালীন দলের খেলোয়াড়দের পরামর্শ দিচ্ছেন হাথুরুসিংহে। ছবিঃ গেটি ইমেজেস।

     

    পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে যাওয়া দলটার এতগুলো খেলোয়াড় পরিচিত! বাংলাদেশ কি তবে কোন বাড়তি সুবিধে পাবে কোচের কাছ থেকে? “হ্যাঁ-ও আবার না-ও”, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জবাবটা এভাবেই দেন হাথুরু।

     

    সুবিধেটা কেমন হতে পারে? “আপনি তাঁদের সম্পর্কে, তাঁদের খেলার ধরন সম্পর্কে সামান্য কিছুও যদি জানেন তাহলে কিছু সাহায্য তো আপনার দলকে আপনি করতেই পারবেন। কিন্তু... ” কিন্তু কি? “তাঁরা বেশ ভালো খেলোয়াড়, মানসম্পন্ন খেলোয়াড়। সুতরাং নিজেদের খেলার নাড়িনক্ষত্র তাঁদেরই সবচেয়ে ভালো জানা।”

     

    ভালোমন্দটা আরও খোলাসা করেই ব্যাখ্যা দিলেন লঙ্কান বংশোদ্ভূত কোচ, ”আপনি যদি বাকি খেলোয়াড়দের সম্পর্কেও একটা লম্বা সময় ধরে জানেন, তাঁদের শক্তি কোথায়, কোথায় দুর্বলতা কিংবা কোনটা তাঁদের কাজে আসে, কোনটা আসে না এসব বিস্তারিত জানেন তবেই সেগুলো কাজে লাগাতে পারবেন। তারপরও কথা থাকে, ওসব খেলোয়াড়েরাও তো তাঁদের শক্তি-সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল।

     

    শুধু কি জানলেই হবে? সেটার যথাযথ প্রয়োগও যে প্রয়োজন সেদিকে আলোকপাত করতে ভুললেন না বাংলাদেশ বস, “একটা নির্দিষ্ট দিনে আপনি কিভাবে এগোবেন সেটার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আপনি যেটা চাইছেন সেটা করার মতো সামর্থ্য যদি আপনার খেলোয়াড়দের থাকে তবেই তো সুবিধের প্রশ্ন আসে।”

     

    ১৫ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে বাংলাদেশ দল ৯৩টি টেস্ট খেলে জিতেছে মাত্র ৭টিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা ৪টিতেই হেরেছে, ৩টিতে আবার ইনিংস ব্যবধানে।

     

    তবে ‘এই’ বাংলাদেশ আর ‘সেই’ বাংলাদেশ যে এক নয় সেটা ক্রিকেটের সামান্য খোঁজখবর রাখা মানুষটিও এখন জানেন। হতে পারে এখনও টাইগারদের সাফল্যের গল্পগুলো কেবলই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে, অধিকাংশ আবার নিজেদের মাঠে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে শুরু হওয়া জয়যাত্রায় চলতি বছর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ঘরের মাঠে পরপর তিনটি ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তবে একদিনের ক্রিকেটে অব্যাহত সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে মুশফিকরা এখন পাঁচ দিনের ক্রিকেটেও নিজেদের চেনাতে বদ্ধ পরিকর।

     

    আর এই হঠাৎ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সামনে আগামী মাসের দুই টেস্টের সিরিজে প্রতিপক্ষ পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাওয়া এক ভঙ্গুর অস্ট্রেলিয়াই। প্রায় একসাথে রায়ান হ্যারিস, মাইকেল ক্লার্ক, ক্রিস রজার্স, শেন ওয়াটসন ও ব্র্যাড হাডিনের অবসরে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলটার বয়স কমে গেছে আচমকাই। সঙ্গে দুই নিয়মিত পেসার মিচেল জনসন আর জশ হ্যাজলউডের বিশ্রাম আর ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার চোট নিয়ে ছিটকে পড়ায় পুরো স্কোয়াড মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার এই দলটির খেলা টেস্টের সংখ্যা মাত্র ২০৭!

     

    একদিকে নিজেদের উত্থান আর বিপরীত দিকে অস্ট্রেলিয়া দলের অনভিজ্ঞতা। ঘরের মাঠের সিরিজে টাইগারদের ঘিরে প্রত্যাশার পারদটা তাই চড়ে যেতে কোন বাস্তবতার ধার ধারছে না। সাফল্যের সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়ে প্রত্যাশার চাপ। তবে হাথুরুসিংহের দাবী ক্রিকেট পাগল দেশের মানুষের এই পাহাড়সম চাপ গত ক’মাস ধরে বেশ মুন্সিয়ানার সাথেই সামাল দিচ্ছে তাঁর শিষ্যরা।

     

     

    তুলনামূলক ‘অনভিজ্ঞ’ অস্ট্রেলিয়াকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়াটা ‘ইতিবাচক’ মনে করলেও কোনভাবেই আত্মপ্রসাদে ভুগতে চান না হাথুরুসিংহে, “আজ থেকে বছর-দেড় বছর আগের অস্ট্রেলিয়া দলের চেয়ে এই অস্ট্রেলিয়াকে মোকাবেলা করাটা তুলনামূলকভাবে স্বস্তিদায়ক। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে এই দলটার কেবল ব্যাটসম্যানরাই অবসরে গেছেন, বোলাররা নন। জনসন-হ্যাজলউডকে ছাড়াই তাঁদের বোলিং আক্রমণ ঢের ভালো আছে। প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্করা কি করার ক্ষমতা রাখে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আর দুই বছরে নাথান লায়নও অনেক বদলে গেছে। তাঁর আত্মবিশ্বাসের পারদ এখন চড়া। ও’কেফের সামর্থ্য সম্পর্কেও আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।”

     

    তবে কি নিজেদের সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখছেন বাংলাদেশ কোচ? “এটা চ্যালেঞ্জই হতে যাচ্ছে। যদি আমরা তাঁদের ২০ উইকেট নিতে পারি, তবে আসলেই চাপে ফেলে দিতে পারব। খেলোয়াড়দের জন্যও এই সিরিজ নিজেদেরকে প্রমাণের সুযোগ,  বিশ্বসেরাদের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার সময়। ছেলেরা সবাই জানে অস্ট্রেলিয়া বলে কোন কথা নয়, যে দলই আসুক না কেন তাঁদেরকে এখন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে।”

     

    অজি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের মতো বাংলাদেশ কোচ হাথুরুসিংহেও মনে করেন উপমহাদেশের পরিবেশে মানিয়ে নেয়াটাই অস্ট্রেলীয়দের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে। নিজেদের মতো করে বানানো স্পিন স্বর্গে বাউন্সের অভাব তো থাকবেই; সঙ্গে ৩০ ডিগ্রীর উপর তাপমাত্রা, বাতাসে ৮০ শতাংশ আর্দ্রতা...ভোগান্তির কারণ হবে সবই। এশিয়ায় খেলা সর্বশেষ ১৫টি টেস্টের মধ্যে কেবল ১টিতে জয় পেয়েছে ব্যাগি গ্রিনরা। সেটিও ২০১১ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে, গলে। হেরেছে সর্বশেষ ছয়টিতেই।

     

    ঘোষিত অস্ট্রেলিয়া দলের মাত্র ৪ জন সদস্য এর আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। অধিকাংশেরই ভারত সফরের অভিজ্ঞতা থাকলেও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে অভিজ্ঞতা খুব একটা কাজে দেবে না বলেই বিশ্বাস হাথুরুর, “এখানকার পরিবেশ নতুন অভিজ্ঞতাই দেবে তাঁদের। জানি না সেটা শেষ পর্যন্ত কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা। ওটা নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের উপর। তবে অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম হবে এটুকু বলতেই পারি। এখানকার জীবনধরণ, খাওয়াদাওয়াসহ সবকিছুই আলাদা। আর রাস্তায় গাড়ি চালানোর প্রশ্ন আসলে তো কথাই নেই!”

     

    পরিবেশের ভিন্নতাটুকু বোঝাতে নিজেকেই উদাহরণ হিসেবে টানলেন ৪৭ বছর বয়সী লঙ্কান, “আমি তো শ্রীলংকা থেকেই এসেছি। কিন্তু এক শ্রীলংকানের জন্যেও এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পৃথিবী।”

     

    ইঙ্গিতটা ঠিক কোনদিকে করলেন বাংলাদেশ কোচ...বোঝা গেল কি?