সৌম্য-মোসাদ্দেকে মালাহাইডেই হলো শাপমোচন
স্কোর
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৪ ওভারে ১৫২/১ ( হোপ ৭৪, আমব্রিস ৬৯*; মিরাজ ১/২২)
বাংলাদেশ ২২.৫ ওভারে ২১৩/৫ (সৌম্য ৬৬, মোসাদ্দেক ৫২*, মুশফিক ৩৬, মাহমুদউল্লাহ ১৯*, তামিম ১৮, মিঠুন ১৭; রেফার ২/১৩, গ্যাব্রিয়েল ২/৩০) (লক্ষ্য ২১০, ২৪ ওভারে)
ফলঃ বাংলাদেশ ডিএল মেথডে ৫ উইকেটে জয়ী
১৭ মে, ২০১৯। লিখে রাখুন এই দিনটি। হয়তো বাংলাদেশ অনেক ফাইনাল জিতবে, হয়তো বিসিবির ট্রফিকেস ভরে উঠবে আরও অনেক শিরোপায়; কিন্তু প্রথম সবকিছুই যে মনে থাকে সারাজীবন! ছয়বারের স্বপ্নভঙ্গের পর মালাহাইডেই যে খুলল ফাইনালের গেরো!
আজ আর মাঠে ছুটে যাওয়া হলো না, মাহমুদউল্লাহ- মোসাদ্দেকদের আলিঙ্গন করতে আজ মিরাজরা ছুটে গেলেন না। মাঠের পাশেই ডাগআউটে সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন, উৎকন্ঠার শেষে সবার মুখে যুদ্ধজয়ের স্মিত হাসি। মাশরাফি-মিঠুন-মুশফিকরা জড়িয়ে ধরলেন নিজেদের। বুকের ওপর থেকে একটা পাষাণভারও কি নেমে গেল না সবার?
আর কেউ না জানুক, মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ তো জানেন এই জয়ের মর্ম। হতে পারে প্রায় খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজকে না হারানোটাই হতে পারত অঘটন। হতে পারে, বৃষ্টিতে ওভার কমে আসার পর হয়তো সেটা শাপেবর হয়েছে। কিন্তু একটা ফাইনালে জয়ের জন্য যে অপেক্ষা, সেটা ফুরানোর আনন্দের কাছে কি কিছুর তুলনা হয়? মাশরাফি ম্যাচ শেষে যেভাবে সৌম্যকে বুকে টেনে নিলেন, মোসাদ্দেক যেভাবে হারিয়ে গেলেন সবার উদযাপনে- এই ফাইনাল বাংলাদেশ দলের কাছে কতটা বড়, এরপর সেটা বোধ হয় না বললেও চলে।
নিয়তিই বোধ হয় ঠিক করে রেখেছিল, এই ম্যাচে অন্য কিছু হবে। আগের তিন ম্যাচে তেমন একটা ঘামই ঝরাতে হয়নি বাংলাদেশকে। এই ম্যাচে যে কাজটা সহজ হবে না, সেই চিত্রনাট্য যেন লেখা হয়েছিল ম্যাচের প্রথম থেকেই। এই প্রথম টসে জিতলেন মাশরাফি, আগে বোলিং নেওয়ার প্রমাণিত সাফল্য থেকে সরতে চাইলেন না। শেই হোপ আর সুনীল আমব্রিস প্রথম ৫ ওভার শেষে ছিলেন বেশ সতর্ক। এরপরেই যেন দুজনের ব্যাটে ছুটতে লাগল স্ট্রোকের ফল্গুধারা। মালাহাইডের আকাশ কালো হয়ে আসছে তখন, সেই সঙ্গে মেঘ জমতে শুরু করেছে বাংলাদেশের আকাশেও। হঠাৎ করে লাইন হারিয়ে ফেললেন বোলাররা, বিশেষ করে মোস্তাফিজুর রহমান যেন খুঁজেই পাচ্ছিলেন না নিজেকে। প্রথম তিন ওভারে দশের বেশি গড়ে রান দিলেন। ২০ ওভারে প্রায় সাত গড়ে রান তুলতে লাগল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পূর্বাভাস অনুযায়ী ততক্ষণে মালাহাইডে নেমে এসেছ বৃষ্টি। শুরুতে ঝিরঝিরে, খানিক পরেই তা জোরালো হলো। সেই বৃষ্টি থাকার কথা ছিল না বেশিক্ষণ, কিন্তু খেয়ালি ডাবলিনের মর্জি বোঝার সাধ্য কি ক্রিকেটের? কমে গেলেও সেই বৃষ্টি যেন আর থামেই না। এর মধ্যে খবর এসে গেছে, ম্যাচ শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়ে গেলে গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে থাকার সুবাদে শিরোপা বাংলাদেশেরই হবে। মাশরাফি নিশ্চয় সেরকম কিছু চাননি। যুদ্ধ ছাড়া মুকুট জয় করা গেলে সেটার আবার মূল্য কীসের?
এরপর একটু একটু করে সরে যেতে থাকল মেঘ, নীলের রেখা ফুটতে শুরু করল মালাহাইডের দিগন্তে। বৃষ্টিও থেমে গেল, ম্যাচ নেমে এলো ২৪ ওভারে। এরপর মিরাজ আর মোস্তাফিজ দুর্দান্ত বল করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৫২ রানের বেশি করতে দিলেন না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, হোপের উইকেট নিয়ে মিরাজ দিয়েছেন ডিএল মেথডে বড় একটা সুবিধা। ২৪ ওভার শেষে বাংলাদেশের লক্ষ্যটা নেমে এলো ২১০ রানে। এক অর্থে টি-টোয়েন্টিই।
সৌম্য সরকার ঠিক করলেন, ঠিক আছে তবে তা-ই হোক। দারুণ ফর্মে ছিলেন টুর্নামেন্টে, তবে আজ দরকার ছিল স্পেশাল কিছুর। শুরু থেকেই নিজের চ্যানেলে বল পেয়ে খেলছিলেন অবিশ্বাস্য সব শট। হোল্ডার, রোচ, গ্যাব্রিয়েলদের পুল করে আছড়ে ফেললেন সীমানার ওপারে, আবার কখনো দুজনের ঠিক ফাঁকে খুঁজে পেলেন বাউন্ডারি। এর মধ্যে তামিমের সহজ একটা ক্যাচ ফেলে দিয়েছেন নার্স, যদিও সেটার জন্য বড় মূল্য দিতে হয়নি। তামিম মারতে গিয়ে ফিরে গেছেন ১৮ রানে। সৌম্য অবশ্য খুনে মেজাজেই, ২৭ বলে পেয়ে গেছেন ফিফটি। বাংলাদেশের ওয়ানডেতে যা পঞ্চম দ্রুততম। সাব্বির ফিরে গেছেন কোনো রান করে, তবে অন্য পাশে মুশফিক প্রথম বল থেকেই ছন্দে। সৌম্যর সঙ্গে মিলে বাংলাদেশকে রেকর্ড বলে এনে দিলেন ১০০ রান।
এরপর সৌম্য মারতে গিয়েই ফিরলেন ৪১ বলে ৬৬ রানে। দুজনের ৪৯ রানের জুটি ভাঙল, জয় তখনও বেশ দূরে। তবে বাংলাদেশ বড় ধাক্কাটা খেল মুশফিকের আউটে, ২২ বলে ৩৬ রানে ফিরে গেলেন তিনি। তখনও ১০ ওভারে ৭৬ রান দরকার, মিঠুনও টিকলেন না বেশিক্ষণ। ক্রিজে মাহমুদউল্লাহ-মোসাদ্দেক। মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে বলে হচ্ছিল না একদমই, মোসাদ্দেকের অবশ্য শুরু থেকেই হচ্ছিল ঠিকঠাক। তবে রান রেট নয়ে চলে যাচ্ছিল, শেষ ৪ ওভারে দরকার হলো ৩৯ রান।
রোচের দ্বিতীয় বলে মোসাদ্দেক মারলেন ছয়, সেই ওভার থেকে এলো ১২ রান। কে জানত, এরপরেই মোসাদ্দেকের ব্যাট হয়ে উঠবে ভীমের গদা, শুরু হয়ে যাবে সৈকতে সন্ত্রাস? বাকি ২৭ রান এভাবে হেলায় নিয়ে নেবেন? ৬,৬,৪,৬- ফাবিয়ান অ্যালেনের প্রথম চার বলো এরকম। এর মধ্যে প্রথম ছয় সুইচ হিটে, বাকি দুইটি ছয় ইনসাইড আউট করে। মোসাদ্দেক ফিফটি পেলেন ২৩ বলে, বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে যা তৃতীয় দ্রুততম। আর চার মেরে কাজটা সারলেন মাহমুদউল্লাহ। ছয় বার ফাইনালের পর সপ্তমবারে এসে খুলল গেরো।
২১ বছর আগে এই দিনে কেনিয়াকে হারিয়ে ওয়ানডেতে প্রথম জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। ক্রিকেটবিধাতার হয়তো ইশারা ছিল, এমন দিনেই হবে শাপমোচন।