কেউ কথা রাখে, দশ বছর পর
মুশফিকুর রহিম আধশোয়া। কোচিং স্টাফের কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। মুশফিক নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। খানিক বাদে উঠে দাঁড়ালেন। আশ্রয় নিলেন সাকিব আল হাসানের বুকে। এরপর হাউমাউ কান্না। সাকিব কাঁদবেন না বলে পণ করেছেন যেন, দাঁতে দাঁত চেপে রাখতে হচ্ছে। সেই পণ হয়তো ভেঙে গেছে কিছুক্ষণ বাদেই।
নাসির হোসেন জার্সিটা তুলে নিয়ে চোখমুখ মোছেন। একপাশে ঠাঁই বসে মাশরাফি বিন মুর্তজা। সে ম্যাচে খেলেননি এনামুল হক বিজয়। কাঁদছেন তিনি।
মিরপুর থেকে ৩০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে রায়সাহেব বাড়ির পাশে বড় পর্দার সামনের জটলাটা তখন ভেঙেছে আইজাজ চিমার শেষ ওভারের পর। কেউ শাপশাপান্ত করছেন। কাকে করছেন, নিশ্চিত না। খানিক বাদে সব নিস্তব্ধ।
রায়সাহেব বাড়ি থেকে ছয় রাস্তার মোড় থেকে রামনগর তখন এক সমুদ্র দূরে।
অথচ আপনি ভেবেছিলেন, হয়তো সাকিবরা আপনাকে কথা দিয়েছেন। সেটা হবে সাকিব আল হাসানের এশিয়া কাপ। হয়তো তামিম ইকবালের আঙুল গুণে গুণে চার দেখানো আপনাকে দিয়েছে অন্যরকম আত্মবিশাস। সে এশিয়া কাপ হতে পারতো সাকিবের, হতে পারতো তামিমের, হতে পারতো আপনার। সেসব না হয়ে আপনি ভেসেছেন এক সমুদ্র কান্নায়।
যেন কেউ কথা রাখে না।
****
চার বছর পর।
আরেকটা এশিয়া কাপ।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দুহাত মেলে ছুটেছেন, পাশে পাশে মাশরাফি। কেউ এসে শুয়ে পড়লেন রিয়াদের ওপর, কেউ জড়িয়ে ধরছেন মাশরাফিকে। সেসব হয়তো পরে দেখেছেন আপনি, কোন জরুরী কাজে সেদিন আপনাকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল। আপনি ধরে নিলেন, এবার আপনি কথাটা পেয়ে গেছেন। মাশরাফির হাতে আপনি ট্রফিটা দেখবেন। আপনি ফাইনাল দেখেছিলেন। সেই এশিয়া কাপের গল্প হতে পারতো রিয়াদ আর মাশরাফির সেই উল্লাসের। অথচ ফাইনালে গিয়ে বিরাট কোহলি গর্জন করে উঠলেন, তাতে স্তব্ধ হয়ে গেল মিরপুর। শিখর ধাওয়ান, রবীন্দ্র জাদেজারা সেলফি তোলেন, রিয়াদ-মাশরাফি কোথাও যেন হারিয়ে যান।
মাশরাফিরা উল্লাসে মাতেন, ২০১৮ এর মাঝামাঝি এসে। মিরপুরের ড্রেসিংরুমে। তাদের চোখ টেলিভিশনে। সেখানে জাহানারা আলম। সালমা খাতুন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২২ গজ সেদিন পেরিয়ে যান জাহানারা, তারা হন এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন।
সৌম্যর আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে। নিদাহাসে সৌম্য কেঁদেছিলেন। এদিন যেন তিনি আপনাকে কথা দিচ্ছেন, আজ হবে। ক্রিকেট আয়ারল্যান্ড
আবার আসে আরেকটা এশিয়া কাপ। আবার ছেলেদের পালা। মেয়েদের সেই শিরোপা হয়তো তাদের অনুপ্রেরণা। তামিম ইকবাল এক হাতে ব্যাটিং করে ঢুকে যান ক্রিকেট রূপকথায়। অথচ তার এশিয়া কাপ মাতানোর কথা ছিল, অন্যরকম এক বছর যাচ্ছিল তার। তিনি দেশে ফিরে আসেন, সাকিব ফিরে আসেন। মুশফিক থাকেন। আবার ফাইনালের খপ্পড়ে বাংলাদেশ। লিটন-মিরাজের অদ্ভুত ওপেনিং জুটি কাজে আসে না। বাংলাদেশ ট্রফি জেতে না। বাংলাদেশ ফাইনাল জেতে না।
বাংলাদেশ ফাইনালে যাওয়ার আগে ট্রফি জেতার কথা দিলেও যেন রাখে না। আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন সেটা। কারও মাথায় ট্রফি নিয়ে উল্লাসের দৃশ্য আপনি দেখেন না, মুশফিকরা নাদের আলি হয়ে যান।
তার আগেই আসে দীনেশ কার্তিকের সেই ছয়টা।
আপনার হয়তো এখনও মনে হয়, সেদিন সৌম্য সরকারের বলে বিজয় শঙ্কর না আউট হলেও পারতেন। তাহলেই যে স্ট্রাইকটা পান না দীনেশ কার্তিক। তাহলেই যে এক্সট্রা-কাভার অঞ্চলটা আপনাকে ভয় দেখাতে পারে না। তাহলে সৌম্য কাঁদেন না।
গ্রীনলাইফ হাসপাতালের এক কেবিনে দুই বন্ধুতে মিলে কার্টুন দেখে সে রাতটা পার না করে হয়তো গল্প করা যেতো সেদিন এক ফাইনালের। তবে বাংলাদেশ ফাইনাল জেতে না। ওয়ানডেতে না। টি-টোয়েন্টিতে না।
যে না জেতার শুরুটা হয়েছিল ২০০৯ সালে।
সে টুর্নামেন্টেই অভিষেক হওয়া রুবেল হোসেনের বুকে হাত দিয়ে সাহস দিচ্ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
কেরামত ভাইয়ের দোকান তখন উত্তেজনায় কাঁপছে। সেলুলয়েডের মতো করে তখন ভেসে উঠছে কয়েকটা ছবি। পরদিন পত্রিকার সামনের পাতা। একটা গ্রুপ ছবি। সামনে একটা ট্রফি। সামনে একটা চ্যাম্পিয়ন ব্যানার। আপনি অন্য দলের এমন ছবি দেখে ভেবেছেন, ‘দেখিস, একদিন আমরাও’!
হয়তো প্রথম ইনিংস দেখে কেউ আর দেখতে চাননি দ্বিতীয় ইনিংস। হোস্টেলে দুপুরের খাবার খেতে খেতে খবর পেয়েছেন, নাজমুল শ্রীলঙ্কার সঙ্গে উলটাপালটা কিছু করছেন।
কদিন পর এসএসসি পরীক্ষা ভুলে ভোঁ দৌড়। আপনার নিজের সাইকেল আর আপনার গতির তারতম্য হয়ে যায়, পারলে আপনি আগে আগে উড়ে যান সাইকেল ফেলে।
এরপর সেই ছবিটার স্বপ্ন।
মুরালিধরন সেই ছবি মুছে দিলেন, মুরালিধরন সব উড়িয়ে দিলেন। তার সেই অদ্ভুত হাসিটা আজও আপনার গায়ে জ্বালা ধরায়।
গত বছরের শুরুর তিনজাতি নিয়ে অফিসে বেশ হই-হুল্লোড়। তখনকার মার্কেটিংয়ের ভাই প্রোমো বানাবেন, আগের সব ফাইনাল নিয়ে। বেশ উৎসাহ দিয়ে ভয়েস-ওভার দিলেন, বাঘের ডেরায় স্বাগতম নামে হ্যাশট্যাগ বানানো হলো। যে কয়টা ম্যাচ প্রেসবক্সে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আপনার, সেই ফাইনালটা ছিল তার একটা।
সাকিবের আঙুলটা কেমন করে মুচড়ে যায়। মুচড়ে যায় বাংলাদেশ দল। থমকে যায় তারা ফাইনালে। বাংলাদেশ ফাইনাল জেতে না। একটা ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের শিরোপা চেয়েছিলেন আপনি শুধু, ১০৮টা নয়। এরপরই তো নিদাহাস ট্রফি আসে। এশিয়া কাপ আসে।
****
আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে এই টুর্নামেন্ট বিশ্বকাপের আগে একটা প্রস্তুতি। আবার আরেকটা ফাইনাল। শুক্রবার বলে অফিসে শুধু কন্টেন্টের দুজন। ইফতার নিয়ে দোটানা, সে এক ঝামেলা। ফ্রিজ থেকে আনা খাবার গরম করে চালিয়ে দেওয়ার আয়োজন। মালাহাইডে বৃষ্টি নামে। ইফতারে সুবিধা হয়।
বৃষ্টি থামে না মালাহাইডে। ঢাকায়ও বৃষ্টি নামে। হঠাৎ কালবৈশাখি। চা খেতে বের হতে চেয়ে আটকে যেতে হয়। মালাহাইডের বৃষ্টি না থামলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। ফাইনাল না জিতেও চ্যাম্পিয়ন, এ যেন যুদ্ধ না জিতে মাথায় মুকুট পরা।
বাসায় টিভি কার্ডের ক্যাবল সংযোগটা নেই, কোথাও লোডশেডিং হয়েছে। একটু পর সেটা আসে। বিনা-যুদ্ধে শিরোপার প্রেক্ষাপটটা বদলে যায়।
বোলাররা বাজে দিনটা শেষ ২৩ বলে পুষিয়ে দিতে চান। ২৪ ওভারে ২১০ রানের লক্ষ্য আসে। ২০০৯ এর সেই সিরিজের কথা মনে পড়ে আপনার। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সাকিবের ইনিংসটা। যেদিন শুধু জিতলে চলতো না, একটা নির্দিষ্ট রান-রেটে জিততে হতো।
এবারও যেন তেমনই কিছু। পার্থক্য হলো, ম্যাচটাই ছোট হয়ে এসেছে।
অ্যালেনকে পাড়ার পর্যায়ে নামিয়ে এনে নিজেকে বিশ্বপর্যায়ে নিয়ে যান মোসাদ্দেক। ফেসবুক
সৌম্যর আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে। নিদাহাসে সৌম্য কেঁদেছিলেন। এদিন যেন তিনি আপনাকে কথা দিচ্ছেন, আজ হবে। তামিম শুরুতে সৌম্যর ব্যাটিংয়ের দর্শক হলেও পরে যেন নিজ দায়িত্বের চাপটা এসে ভর করে তার ওপর। দ্বিতীয় জীবনটা কাজে লাগাতে পারেন না।
সাব্বির আসেন। সেই এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর মাহমুদউল্লাহর কাছে সবার আগে ছুটে এসেছিলেন সাব্বির। তেমন দ্রুতই ফিরে যান এদিন।
মুশফিক শুরু করেন। দারুণ সব আন-অর্থোডক্স শট খেলছিলেন, অর্থোডক্স একটা ফ্লিকে গড়বড় হয়ে গেল সব। এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্তটা বিপক্ষে যায়। মিঠুন কেন যেন রিভার্স সুইপ করতে চান, চাপ কমাতে গিয়ে বাড়িয়ে ফেলেন।
এতো কাছে এতো দূরের গল্পটা উঁকি মারে। সব জিতেও ফাইনাল না জেতার আক্ষেপটা দাঁড়িয়ে থাকে সামনে, একটু পরই হামলে পড়বে সেটা। আর আপনি তখন কথা না রাখার লাইনগুলো ভাববেন।
তবে আপনি জানেন, একটা বড় ওভার বদলে দিতে পারে সব।
ফ্যাবিয়েন অ্যালেনকে পাড়ার বোলারের পর্যায়ে নামিয়ে এনে নিজে বিশ্বপর্যায়ে নিয়ে যান মোসাদ্দেক। ক্যারিয়ারের প্রথম বলে উইকেট নিয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেই ম্যাচটা শেষ হয়েছিল তার ব্যাটে। আজ মাহমুদউল্লাহ আনুষ্ঠানিকতা সারার আগেই মোসাদ্দেক কাজটা করে রেখেছেন।
আশপাশ থেকে হুল্লোড় ভেসে আসে।
এরপর। মুশফিকুর রহিম আধশোয়া। তার মাথার ওপর একটা ট্রফি। সৌম্য বসে পড়েছেন। কাঁদছেন না। ছবির পোজ দিচ্ছেন। ওপরে একপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে রেখেছেন রুবেল হোসেন। তামিম একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন। মাশরাফি আরেকপাশে দাঁড়িয়ে, লিটনের কাঁধে হাত। একটু আগে একে একে সবাই বাধা পড়েছিলেন তার আলিঙ্গনে। সাকিব খেলেননি, তবে তার হাসিটা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে অনেক কিছু। রাব্বি ভি চিহ্ন দেখাচ্ছেন, এ সিরিজে এক ম্যাচও খেলেননি তিনি।
হয়তো এটা বিশ্বকাপের আগে নেহায়েত একটা সিরিজ, যেটিকে সবাই নিয়েছে প্রস্তুতি হিসেবেই। তবে এটা দশ বছর আগে যে ছবিটা ভেসে উঠে মিলিয়ে গিয়েছিল, সেটাকে ফিরিয়ে আনার সিরিজ। এবার সেটা মিলিয়ে যায় না। অনেক্ষণ পরও ফেসবুক স্ক্রল করলে টাইমলাইনে ভেসে বেড়ায়।
কেরামত ভাইয়ের দোকানে, রায়সাহেব বাড়ির বড় পর্দার সামনে, কলাবাগানের পুরোনো অফিসে, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক বছরের অভিমান জমাট বেঁধে উড়ে যেতে চায়। হয়তো আপনি সেসব বুক-পকেটে সযতনে রেখে দিতে চান, সেসব আপনাকে কেউ ফিরিয়ে দেবে না বলে।
এখন আপনি জানেন, কেউ কথা রাখে। হয়তো সেটার জন্য শুধু দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়।