• প্রমীলা এশিয়া কাপ
  • " />

     

    রূপকথা, চুপকথা আর সালমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪৪ গজ

    রূপকথা, চুপকথা আর সালমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪৪ গজ    

    সানজিদার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শট হতে পারতো সেটা। 

    বলটা স্লটে ছিল, তুলেও মেরেছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেকটি ঐতিহাসিক, বাঁকবদলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছয়গুলোর একটি হতে পারত সেটা। সীমানার একটু ভেতরে ভেদা কৃষ্ণামূর্তির হাতে ধরা পড়লেন সানজিদা। যে শটটা আনন্দে ভাসাতে পারতো বাংলাদেশকে, সে শটটাই উচ্চকিত করলো কুয়ালালামপুরের কিনরারা ওভালের ভারতীয় দর্শকদের। টেলিভিশনে কান না পাতলেও আপনি শুনতে পেতেন, ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’! সালমা যেন মানতেই পারছিলেন না, ডাগ-আউটে মাথাটা নিচু হয়ে গেল তার আরেকবার। 

    পরের বলে রান-আউট রুমানা। জাহানারা প্রথম রানটা দৌড়ালেন বেশ দ্রুত, তিনি যখন স্ট্রাইক প্রান্তে পৌঁছে গেছেন, রুমানা সবে মধ্যক্রিজ পেরিয়েছেন। রাজ্যের ক্লান্তি যেন এসে ভর করেছে তাকে। জাহানারা ওপাশে ডাকছেন, সে ডাকে রুমানা যেন সাড়া দিতে গেলেন অবচেতন মনেই। ঘুরে ক্রিজ থেকে বেড়িয়েছেন সবে, থ্রো এসে জমা পড়েছে বোলার হারমানপ্রিত কৌরের হাতে। ভারত অধিনায়ক কৌর, এ ম্যাচে অন্য সব ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের চেয়ে আলাদা কৌর, বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে খেয়ে ফেলা কৌর-দানবের হাতে রান-আউট রুমানা। রুমানা, বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। রুমানা, যার মা মেয়ের ক্রিকেটে ঠিক বাধা দেন না, আবার ঠিক পছন্দও করেন না। এমনকি তিনি যে বাংলাদেশ অধিনায়ক, বলে বেড়ান না সেটাও। 

    এবার সালমাকেই নামতে হবে। সালমা, বাংলাদেশের প্রথম মেয়ে ক্রিকেট তারকা। সালমা, বাংলাদেশের অধিনায়ক। তিনি অবশ্য নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে। তার জীবন তখন এসে নেমেছে বাইশ দুগুণে চুয়াল্লিশ গজে। এই চুয়াল্লিশ গজ তিনি পেরুতে পারলেই অসীম দৈর্ঘ্যের এক রূপকথার সেলুলয়েডের বন্দি হয়ে যাবে বাংলাদেশ! 


    ****

    দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে থাকতেই নতুন কোচ পেল বাংলাদেশ। আনজু জেইন। সে সফরটা বাংলাদেশ নিয়েছিল শিক্ষা-সফর হিসেবে। তা শিক্ষাটা মন্দ হয়নি। ওয়ানডেতে যেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, নিজেদের সঙ্গেই, এক ওয়ানডে থেকে আরেক ওয়ানডেতে কম স্কোরের। গ্রাফটা নামছিলই শুধুই, মুখ থুবড়েও পড়েছিল। টি-টোয়েন্টিতে পারফরম্যান্সের গ্রাফটা একটু মুখ ওপরে তুললো, তবে পুরো সফরে ৮-০ ব্যবধানটা কমাতে পারলো না বাংলাদেশ। 

    ডেভিড ক্যাপেল গেলেন, জেইন দায়িত্ব নিলেন। প্রথম মিশন এশিয়া কাপ। 

    ছেলেদের ক্রিকেটের মতো র‍্যাংকিংটা নয় মেয়েদের। আলাদা ফরম্যাটে আলাদা র‍্যাংকিং নেই, সব ফরম্যাট মিলিয়ে একটাই র‍্যাংকিং। সেখানেও পুরুষদের প্রভাব আছে, যে দশটি দেশ টেস্ট খেলে তাদের ক্রিকেটে, জিম্বাবুয়ে ছাড়া সবাই আছে র‍্যাংকিংয়ে। বাড়তি হিসেবে আবার আছে টেস্টের নতুন দেশ আয়ারল্যান্ড। 

    সে র‍্যাংকিংয়ের চারে ভারত। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে তারাই। পাকিস্তান সাতে, শ্রীলঙ্কা আটে, নয়ে বাংলাদেশ। শুধু র‍্যাংকিং নয়, টি-টোয়েন্টিতেও বাংলাদেশের এশিয়ার কাপের আগের রেকর্ড ছিল নেহায়েতই পরাজয়ের। 

    ৩৫ ম্যাচে ৩ জয়, বাংলাদেশের জয়ের শতাংশ ছিল ৮.৫৭ ভাগ। ভারতের সেটি ৪৭.৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩৫.৬৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ২৪.৬৭ শতাংশ। বাংলাদেশের পর সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলেছে যে শ্রীলঙ্কা, তারাও খেলেছিল ৭৭টি টি-টোয়েন্টি। 

    এ চারটি দেশ ছাড়া থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া খেলেছে এশিয়া কাপে, আন্ডারডগ বাংলাদেশের দৃষ্টিসীমায় ছিল শুধুই এ দুইটি জয়ই? জেইন কী ভেবেছিলেন? 


    ****


    দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর এশিয়া কাপ, এরপর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ, তবে মূল লক্ষ্য ছিল নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির বাছাইপর্ব। সেদিকেই চোখ, এশিয়া কাপ তো আরেকটা শিক্ষা সফর! 

    প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে রীতিমতো উড়ে গেল বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের পারফরম্যান্সটাই যেন এলো মালয়েশিয়াই। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে বাংলাদেশের সামনে পাকিস্তান। তাদেরকে স্তব্ধ করে দিল বাংলাদেশ। আপসেট। 

    এরপর ভারত। এশিয়া কাপের আগের সব আসরের চ্যাম্পিয়ন। এশিয়া কাপে একটিও ম্যাচ না হারা ভারত। গত বছর বিশ্বকাপ কাঁপানো ভারত। 

    ব্যাটিংয়ে সেখানেও জ্বলে উঠলেন হারমানপ্রিত। সঙ্গে দীপ্তি শর্মা। ভারত এ টুর্নামেন্টের পরিষ্কার ফেবারিট, একচ্ছত্র অধিপতি। 

    ভারত পরে শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দেবে। তুলোধুনো করবে শ্রীলঙ্কাকে। 

    আর বাংলাদেশের সামনে ১৪২ রানের লক্ষ্য, ৪৯ রানেই নেই ৩ উইকেট। 

    এরপর ফারজানা, সঙ্গে রুমানা। তখন পর্যন্ত তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জুটির অংশ ছিলেন তারা। ৩৬ বলে ৫৪, এরপর ২৪ বলে ৩২ প্রয়োজন। রুমানা-ফারজানা আলোচনা করছিলেন, এই ম্যাচটা তাদের হয়েই গেছে। শুধু শান্ত থাকতে হবে আগেরদিনের মতো। 

    নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয়টা সেদিন পেয়েছিলেন রুমানা। এদিনের আগে। 


    ****

    দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে তামিম ইকবালের কাছ থেকে একটা ব্যাট উপহার পেয়েছিলেন রুমানা। এদেশে মেয়েদের ক্রিকেটের দৈন্যদশাটা ফুটে উঠেছিল তামিমের দারুণ সেই আচরণেও! রুমানারা যে নিজেদের কিট কেনার মতো টাকা-পয়সাও পান না খুব একটা! 

    তারা আলোচনায় আসেন তাদের ম্যাচ-ফির লজ্জাজনক অংকতে। ভারতের মেয়েরা তাদের ১৮ গুণ বার্ষিক বেতন পান। ইংল্যান্ডের মেয়েদের ক্ষেত্রে তা ২২ গুণ, আর অস্ট্রেলিয়ার জন্য সেটি ৩২ গুণ।

    তার ওপর র‍্যাংকিংয়ের নয় নম্বর দল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগই মেলেনা সেভাবে! পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা সে সুযোগ পেয়ে তরতর করে ওপরে ওঠে, বাংলাদেশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। 

    আইসিসির একটা প্রোগ্রামের আওতায় গত উইমেনস বিগ-ব্যাশে গিয়েছিলেন দুইজন বাংলাদেশী, রুমানা ও খাদিজা। স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল, মিচলে স্টার্কদের সঙ্গে নেটে সময় কাটিয়েছেন। আর মেয়েদের ক্রিকেটের বড় বড় নামগুলোকে দেখেছেন সামনে থেকে। তাদের কেউ কেউ বন্ধুও হয়ে গেছেন রুমানাদের। 

    অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার খবর শুনে ভাবলেশহীন রুমানার মা শুধু বলেছিলেন, নামাজটা যাতে ঠিকঠাক পড়েন তিনি। আর কেঁদেছিলেন খাদিজার বাবা। 

    ****

    অ্যানা স্রাবসোল যখন উড়ছিলেন লন্ডনের আকাশে, জাহানারা আলম তখন কী করছিলেন? মিথালি রাজ মুখ লুকোচ্ছিলেন নীচু হয়ে, এদিনের সালমা খাতুনের মতো করে। 

    ভারত মেয়েদের ক্রিকেটে বেশ বড় নাম, সেই ভারতেও নতুন করে ক্রিকেট জেগেছিল লন্ডনের ওই ফাইনালের আগে-পরে। ভারত বাংলাদেশের কাছে একবার ভড়কে গেল, এই টুর্নামেন্টেই। 

    ফাইনালের আগে তাই নিশ্চিতভাবেই চাপে ছিল ভারত। ফাইনালেও বাংলাদেশের নতুন ক্রিকেটের চাপে পিষ্ট হলো তাদের ব্যাটিং লাইন-আপ। 

    মিথালি রাজ। স্মৃতি মানধানা। দীপ্তি শর্মা। হারমানপ্রিত কৌর। অনুজা পাতিল। ভেদা কৃষ্ণামূর্তি। বিশ্বকাপের আগে পরে করে বিশ্ব ক্রিকেটে এরা বড় নাম। 

    রুমানা আহমেদ, খাদিজা তুল কুবরা, জাহানারা আলমদের মুখোমুখি হয়ে আগের দিন কাজটা সেরে রেখেছিলেন তারা। এদিন পারলেন না। এক কৌর ছাড়া। একা হাতে টানলেন ভারতকে। আর ম্যাচশেষে কৌর বললেন, যেভাবে চাপ সামলানোর দরকার ছিল, সেটা তারা পারেননি। বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ভারত এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশের সামনে চাপে পড়ে গেছে! 
     

    ****

    জাহানারা যেন অন্য জগতে তখন। শান্ত। সালমার উদ্বেগ, রুমানার হতাশা, সানজিদার আফসোস- কিছুই ছুঁয়ে যাচ্ছে না তাকে। তিনি শুধু জানেন, কী করতে হবে। জানেন, ইতিহাসের কোথায় দাঁড়িয়ে তিনি। এই ১-২ রানের ঘোরটোপে তো কম আটকা পড়েনি বাংলাদেশ। এই ২২ বা ৪৪ গজ তো কমবার দীর্ঘ থেকে অসীমে মিলিয়ে যায়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য। 

    কোনও এক ড্রেসিংরুমে টিভি-পর্দায় চোখ তামিম-মাশরাফিদের। আরও দূরে কোথাও হয়তো টিভি-পর্দায় তাকিয়ে রুমানার মা, খাদিজার বাবা। 

    ভাবলেশহীন জাহানারা ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এলেন। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শটটা খেললেন মিড-উইকেটে। 

    সালমা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪৪ গজ পথটা পাড়ি দিলেন। টিভি-পর্দার সামনে উল্লাসে মত্ত মাশরাফি-তামিম-লিটন-মুস্তাফিজ-মেহেদিরা। রুমানার মা হয়তো তখন অশ্রু ফেলছেন, খাদিজার বাবার মতো করেই। 

     

    তথ্যসূত্র- ইএসপিএন ক্রিকইনফো, স্টার স্পোর্টস 

    ছবি- এসিসি, এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল