• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    ব্রাজিলের কাছে হেরেও যখন স্বপ্ন দেখার সাহস জুটেছে আর্জেন্টিনার

    ব্রাজিলের কাছে হেরেও যখন স্বপ্ন দেখার সাহস জুটেছে আর্জেন্টিনার    

    ব্রাজিলের কাছে সেমিফাইনালে হেরে কোপা আমেরিকা থেকে বাদ পড়েছে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির আজন্ম স্বপ্ন পূরণ হয়নি এবারও। আকাশি-সাদা জার্সি আপনি মেসির মাথা নিচু করা ছবি দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সে ছবি আরও একবার দেখেছেন, আরও একবার তার ব্যর্থতাই শিরোনাম হয়েছে। ব্যর্থ আর্জেন্টিনাতেও আপনার অভ্যস্ততা নতুন কিছু নয়। শিরোপা না জেতা হয়ত এখনও ব্যর্থতাই আর্জেন্টাইনদের জন্য। কিন্তু এবার কি আসলেও শিরোপা জেতার মতো অবস্থায় ছিল আর্জেন্টিনা?

    আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি। ১২ দলের টুর্নামেন্টে একমাত্র অন্তবর্তীকালীন কোচ নিয়ে টুর্নামেন্টে এসেছিল আর্জেন্টিনা। স্কালোনির কোচিং অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তার ক্যারিয়ার শুরুই আর্জেন্টিনা জাতীয় দল দিয়ে। এর আগে ছিলেন সহকারি কোচ। এমন প্রোফাইল নিয়ে আর্জেন্টিনার মতো দলের কোচ স্কালোনিকে কেন করা হলো সে প্রশ্ন আপনার জাগতেই পারে। সহজ জবাব, স্কালোনির বেতন কম। তাই তাকে কোচ করা আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের।

    আপনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের আর্থিক দৈন্যতার গল্প শোনা লোক। আর্জেন্টিনার আর্থিক দৈন্যদশা আপনাকে ভাবানোর কথা নয়। কিন্তু অনিয়ম আর পরিকল্পনার অভাবে আর্জেন্টিনার মতো ঐতিহ্যবাহী দলও ভুগতে পারে সেটা আবার সম্ভব কী করে?

    পরিকল্পনার অভাব যেমন ভোগাতে পারে। ভুল পরিকল্পনা ভোগাতে পারে আরও বেশি। এই আর্জেন্টিনা সেই ভুল পরিকল্পনার খেসারত দিচ্ছে শুধু। আর শিরোনামে উঠে আসছে মেসিদের ব্যর্থতা। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায়ের গল্পটা জানা সবার। এরপর তখনকার কোচ হোর্হে সাম্পাওলিকে বিদায় দিতে পকেট ফাঁকা হয়েছে এএফএর। সাম্পাওলিকে কোচ করে আনা হয়েছিল ২০১৭ সালে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তখন ধুঁকছিল আর্জেন্টিনা। এক বছরের ব্যবধানে সাম্পাওলি ছিলেন আর্জেন্টিনার তৃতীয় কোচ।

    সাম্পাওলি যে এভাবে ব্যর্থ হবেন সেটা অবশ্য ধারণা করাও কঠিন ছিল। তবে সিদ্ধান্তটা একটু তাড়াহুড়ো করেই নিয়েছিল আর্জেন্টিনা। জেরার্ডো টাটা মার্টিনোর অধীনে পর পর দুইবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারের পর কোচ বদলানো ছাড়াও উপায় ছিল না। তখন আনা হলো এদ্গার্দো বাউজাকে। টানা তিন ফাইনালে হারা ‘বুড়ো আর্জেন্টিনা’ দলকে তিনিও অনুপ্রাণিত করতে পারলেন না। বাছাইপর্ব উতরাতে তাই আট মাসের মাথায় আবারও তোড় জোড় আর্জেন্টিনার। কোচ বদল, এলেন সাম্পাওলি।

    কোচ হিসেবে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। হাইপ্রেসিং, হাই এনার্জি, প্রতিপক্ষকে নিজেদের অর্ধে চেপে ধরে রাখা- সাম্পাওলির দলের বৈশিষ্ট এসব। কিন্তু সাম্পাওলি ব্রান্ডের ফুটবল খেলতে হাতে যে ধরনের খেলোয়াড় থাকা দরকার ছিল, সেটাই ছিল না সাম্পাওলির কাছে। কোনোমতে রাশিয়া বিশ্বকাপে পা রেখে এরপর তাই আর বেশিদূর যাওয়া হয়নি আর্জেন্টিনার। এরপর সাম্পাওলির বিদায় ছিল অবশ্যম্ভাবী। তার সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করতে গিয়ে এমনিতেই অভাবে থাকা এফএকে  মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। কোচ হিসেবে তাই ‘সস্তা’ একজনকেই দরকার ছিল আর্জেন্টিনার।

    রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছিল তাদের বুড়িয়ে যাওয়া দলটাই। গতি, ক্ষীপ্রতা কোনোটাই ছিল না। মিডফিল্ড আর ডিফেন্সের অবস্থা যা তা। আর্জেন্টিনার করারও আর তেমন কিছু ছিল না। বয়সভিত্তিক দল থেকে একের পর এক খেলোয়াড় উঠে আসার নিয়মটাই তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে আর্জেন্টিনায়। অথচ অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি শিরোপা নেই অন্য কোনো দেশের। ১৯৮৬ সালের পর ৫ বার অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টাইন যুবারা। তাই মেসি, রিকেলমে, আইমার, তেভেজ, আগুয়েরো, মাসচেরানোর মতো খেলোয়াড়দের পেতে কখনও সমস্যা হয়নি তাদের। কিন্তু এই দেশটাই গত ১১ বছর ধরে যুব বিশ্বকাপে শিরোপাশূন্য। শেষ ৫ আসরে মধ্যে দুইবার বিশ্বকাপেই বাছাই করতে পারেনি তারা। সেরা সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনাল, আর বাকি দুইবার প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়।

    সবকিছু জেনেও সাম্পাওলির নিয়োগ তাই আর্জেন্টিনার অদূরদর্শীতার পরিনাম মাত্র। স্কালোনি আর্জেন্টিনার সাবেক রাইটব্যাক। কোচ হিসেবে তিনি আনকোরা তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল আরও আনকোরা এক দলের। স্কালোনি সেই দল নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। প্রথমে পাঁচ মাসের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে। পরে কোপা আমেরিকা পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয় তার। এ সময়ে ৬২ জন খেলোয়াড় ডেকেছেন তিনি। দলকে খেলিয়েছেন চার, পাঁচ রকমের ফর্মেশনে। এবারের কোপা শুরু হওয়ার সময়েও নিজের সেরা দলটা জানা ছিল না স্কালোনির।


     

    সেটা হয়ত এখনও তিনি জানেন না। তবে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচটা একটা আশার রেখা দিয়ে গেছে আর্জেন্টিনার অন্ধকার আকাশে। প্রথমবারের মতো টানা দুই ম্যাচে একই দল নামিয়েছিলেন স্কালোনি, কোয়ার্টার ফাইনালে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে খেলা একাদশটাই খেলেছে ব্রাজিলের বিপক্ষে। প্রতিপক্ষ স্বাগতিক দেশ, টুর্নামেন্ট ফেভারিট, আর এই ব্রাজিল সম্ভবত সাম্প্রতিক ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। কিন্তু সেই দলটার বিপক্ষেই স্কালোনির পরীক্ষা-নিরীক্ষা কাজে লেগেছে প্রায় পুরোটাই।

    এতোদিন মাঠের মাঝে দিয়ে আক্রমণ চালানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল আর্জেন্টিনা। সে পরিকল্পনা প্রায় সফল ব্রাজিলের বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচে কলম্বিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ফাঁকা মিডফিল্ডের ছবিটা আপনার চোখ এড়িয়ে না গেলে ব্রাজিলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার খেলা আপনাকে অবাক করারই কথা। আর্জেন্টিনা ম্যাচটা ২-০ গোলে হেরেছে বটে, কিন্তু এমন আর্জেন্টিনার এমন ফ্লুইড পাসিং ফুটবল আপনি শেষ দেখেছেন কবে? সেটাও এক কোপার সেমিফাইনালে। ২০১৬ কোপা আমেরিকা সেন্টানারিওর সেমিফাইনালের পর সম্ভবত নিজেদের সেরা ম্যাচটা আর্জেন্টিনা খেলাছে ব্রাজিলের বিপক্ষে। আর এর মাঝের সময়টায় মিডফিল্ডে টানা ৫টি পাস নির্ভুলভাবে খেলতেও ভুগেছে আর্জেন্টিনা।

    দুর্দিনেও লিয়ান্দ্রো পারেদেস, লো সেলসো, হুয়ান ফয়েথ, রদ্রিগো ডি পল, লাউতারো মার্টিনেজদেরকে নিয়ে আপনি আশা দেখতে পারেন। পারেদেস অনেকদিন ধরেই নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এই কোপার পর নিজের পক্ষে শক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তাকে এখন আর বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই আর্জেন্টিনার। ফয়েথের বয়স ২১, খেলছেন টটেনহাম হটস্পারে। মাউরিসিও পচেত্তিনর অধীনে তিনি উন্নতি করবেন আরও সেই আশায় আপনি থাকতে পারেন। ডিফেন্সে মনোযোগ আছে তার, ধীর স্থির থাকেন বেশির ভাগ সময়, প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার অদ্ভুত দক্ষতাও আছে। মোট কথায় বিশ্বমানের ডিফেন্ডার হওয়ার সবরকম গুণ আছে ফয়েথের। অবশ্য ভুলও করেন চোখে লাগার মতো, তবে বয়স কম বলে আপাতত মাফ পেয়ে যেত পারেন। ডি পলকে স্কালোনির সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বলতে পারেন। যে চার ম্যাচ খেলেছেন, ভুল করেছেন অল্পই। শারীরিক দিক থেকে বেশ শক্ত সামর্থ্য, তাই শক্তির সঞ্চার করেন মিডফিল্ডে। দলকে সাহায্য করেছেন রক্ষণেও। ৪-৩-৩ ফর্মেশনের যে মূল ভিত্তি, তাতে ডি পল দারুণ এক সংযোজন এই আর্জেন্টিনা দলে। মেসি-মার্টিনেজ-আগুয়েরো মিলে দারুণ এক আক্রমণ সাজিয়েছিলেন ব্রাজিলের বিপক্ষে, ডি পল শুধু বলটা মেরেছেন বাইরে দিয়েই। এমন গোছানো আক্রমণ গত তিন বছরে দেখেনি আর্জেন্টিনার ফুটবল।

    মার্টিনেজকে নিয়ে আর্জেন্টিনায় প্রত্যাশা বহুদিন ধরে। আর্জেন্টিনায় তাকে ডাকা হত ষাড় নামে। খেলার ধরনেও মিল আছে। সবচেয়ে বড় কথা মেসি আর আগুয়েরোর সঙ্গে তার সমন্বয়টা আক্রমণে কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে আর্জেন্টিনার চেহারা। ২১ বছর বয়সীকে নিয়ে স্বপ্ন আর্জেন্টিনা দেখতেই পারে।

    কোপা শুরুর আগে স্কালোনি বলেছিলেন শিরোপা জিতলে কোচিংই ছেড়ে দেবেন তিনি। স্কালোনি জানতেন শিরোপা এই দলের জন্য বাস্তব কোনো স্বপ্ন নয়। তিনি আসলে এসেছিলেন নতুন দল গড়ার প্রক্রিয়াটা আরেকটু এগিয়ে দিতে। সফল হয়েছেন না ব্যর্থ সেটা বিতর্কের জন্য তোলা থাক, কিন্তু আশার রেখা যে এই দল দেখিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কয়েকদিন আগে  সেটাও তো দেখছিল না অমানিশায় আটকে পড়া আর্জেন্টিনার ফুটবল। এই দলেও ঘাটতি আছে আরও অনেক। হাতের সঙ্গে পায়েও সমান দক্ষ এমন একজন গোলরক্ষকের অভাব হাহাকার তুলেছে।  নিকোলাস অটামেন্ডি ফুরিয়ে গেছেন বহু আগেই। অন্তত আরও একজন সেন্টারব্যাক ও রাইটব্যাকের খোঁজ নতুন করে চালাতে হবে স্কালোনিকে। আর পারেদেস দেখিয়েছেন তিনি সৃজনশীল ভূমিকায় যতখানি ভালো রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ততোটাই নড়বড়ে। জাতে তিনি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নন। তার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে তাই একজন বিশ্বমানের সেন্টার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের বিকল্প নেই আর্জেন্টিনার কাছে। সেটা কবে পাবে আর্জেন্টিনা, সে প্রশ্নের জবাব অজানাই।

    তবে ব্রাজিলের কাছে হারেও আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় আশার জায়গা সেই মেসি। সঙ্গে সার্জিও আগুয়েরোও। প্রথমে আগুয়েরোর কথায় আসা যাক। বড় টুর্নামেন্টে তাকে ঘিরে আর্জেন্টিনার প্রত্যাশা থাকে অনেক। প্রথম ম্যাচে একাদশেও থাকেন, কিন্তু বাজে এক পারফরম্যান্সে পরে জায়গা হারান। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি সেটার। কলম্বিয়ার কাছে হারের পর বাদ পড়েছিলেন একাদশ থেকে। এরপর প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর দ্বিতীয়ার্ধে আগুয়েরোর দ্বারস্থ হন স্কালোনি। সে ম্যাচে আর্জেন্টিনার পাওয়া পেনাল্টিতে বড় অবদান ছিল আগুয়েরোর। তিনি নামার পর মার্টিনেজ-মেসি-আগুয়েরোর সমন্বয় পরের দুই ম্যাচেও গোল পেতে সাহায্য করেছে আর্জেন্টিনাকে। ব্রাজিলের বিপক্ষে ফ্রি কিক থেকে আগুয়েরো গোল পাননি কেবল বারপোস্টের কারণে। মেসি-আগুয়েরোর যে টেলিপ্যাথিক সম্পর্কের কথা রূপকথার মতো শোনা যেত সেটার দেখা মিলেছে এবার। আগুয়েরো শুধু জানান দিয়েছেন, যথেষ্ট সময় আর আত্মবিশ্বাস থাকলে ক্লাবের খেলাটা তিনি জাতীয় দলেও খেলতে পারেন।

    মেসি পার করেছেন অদ্ভুত এক টুর্নামেন্ট। একমাত্র ব্রাজিলের বিপক্ষেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনিও বারপোস্টে বাধা পেয়ে গোল পাননি। পুরো টুর্নামেন্টে এক গোল, নামের পাশে নেই কোনো অ্যাসিস্টও। মেসির জন্য মাঠের পারফরম্যান্সকে সবমিলিয়ে ব্যর্থই বলতে হবে। কিন্তু এবারের কোপা থেকে মেসি যা পুঁজি করে নিয়ে যাচ্ছেন সেটাই বদলে পারে আর্জেন্টিনাকে।

    মেসি নিজেও জানতেন এই দলটাকে দিয়ে শিরোপা জেতা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি কিছু। ২০২০ এ ঘরের মাঠে আবারও কোপা আমেরিকা। মার্চ থেকে শুরু বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। তার আগে একটা দল দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারার কথা আর্জেন্টিনার। এবারের আসরে চাইলেই নিজেকে বাইরে রাখতে পারতেন তিনি। বিশ্বকাপের পর বিরতি দিয়ে মার্চে ফিরলেন, এক ম্যাচ খেললেন। আর্জেন্টিনা হারলো, এরপর আবার কোপার আগে ফিরলেন। যখন ফিরলেন তখন নতুন রূপে ফিরলেন। ক্লাবের হয়ে আরও একবার নাটকীয় ব্যর্থতার পর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হয়নি মেসির। ব্যর্থতা যে ক্লাব ক্যারিয়ারেও ঘিরে ধরতে পারে সে অনুভূতি এতোদিন অজানা ছিল তার। পরপর দুই বছর একই ঘটনার পর এবার আর্জেন্টিনার ক্যাম্প বরং আরও আপন মনে হলো বোধ হয় তার কাছে। কোপার ট্রেনিংয়ে আর্জেন্টিনার প্রায় প্রত্যেকটা ছবি ঘেটে দেখুন। এমন উৎফুল্ল মেসিকে শেষ কবে দেখেছিল আর্জেন্টিনা? যিনি অল্পতেই ভেঙে পড়তেন বলে দুর্নাম, গ্লানি মেনে নিতে পারেননি দেখে যিনি ২৯ বছর বয়সে অবসরে গিয়েছিলেন জাতীয় দলের হয়ে- তিনি এমন দুঃসময়েও এতোটা নিরাবেগ থাকেন কী করে?

    মেসি অন্তত এবার একটা বদনাম ঘুচিয়েছেন। মাঠে বারবার কথা বলেছেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে। নেতৃত্বগুনের ঘাটতিটা হয়ত পুরোপুরি সেভাবে কখনই কাটিয়ে ওঠা হবে না তার। কিন্তু এই ৩২ বছর বয়সে এসেও তার মতো একজন নতুন কিছু নতুন করে শেখার চেষ্টা করছেন এটাও তার সতীর্থদের জন্য কম অনুপ্রেরণার হয় কী করে? কলম্বিয়ার বিপক্ষে হারের পর বললেন, এটা এমন বড় কিছু নয়, সামনের দিকে তাকাতে হবে। হারলেন বটে, কিন্তু হার মানতে রাজি হলেন না মেসি। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে দুইটি পেনাল্টি পেতে পারত তার দল। ভিএআর মাঠের রেফারির সিদ্ধান্ত কেন বদলায়নি সেটা বিতর্ক সাপেক্ষ। পেনাল্টি দুইটি পেলেও আর্জেন্টিনার ভাগ্য কতোখানি ফিরত সেটাও অজানা। মেসি সাধারণত অভিযোগ করেন না। মাঠের দুর্গতি নিয়ে শুরু করলেন, থামলেন শেষ ম্যাচে রেফারি আর দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল সংস্থাকে ধুয়ে দিয়ে। মেসির অভিযোগ আপনি ফেলতে পারবেন না। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল গভর্নিং বডিতে সরাসরি ব্রাজিলিয়ানদের প্রভাবকেও দুষেছেন তিনি। টিভি রিপ্লে দেখে আপনি ওই দুইটি ঘটনাকেও বাদ দিয়ে দিতে পারবেন না। অধিনায়ক হিসেবে যতোখানি করার দরকার ছিল মেসি প্রায় পুরোটাই করেছেন এবার। এমন সরব উপস্থিতিই এতোদিন তার কাছ থেকে চেয়ে আসছিলেন আর্জেন্টাইনরা। ব্রাজিলের কাছে হারলেও তাই বরাবরের মতো মেসির মুন্ডুপাত হয়নি এবার তাই সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা, মেসি ব্যর্থতাকে সঙ্গী করতে শিখে গেছেন।

    একটা অন্ধকার গুহায় হাতে থাকা আলোর মশাল আর্জেন্টিনা হারিয়ে ফেলেছিল টানা তিন ফাইনাল হেরে। আপনি যখন ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাবেন তখন স্বপ্ন দেখতেও সাহস হবে না। এক ম্যাচের ভিত্তিতে এতোকিছু বিচার করে ফেলা আদিখ্যেতা হতে পারে। কিন্তু সে ম্যাচের প্রতিপক্ষের নামটাও মনে রাখতে হবে।  আর্জেন্টিনা ম্যাচটা তো প্রায় নিজেদের করে ফেলেছিল। প্রায় তিনটি ফাইনালও তো জিতে ফেলেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু তখনকার সেই ‘প্রায়’ আর এখনকার ‘প্রায়’ শব্দ দুইটির মাহাত্ম্য এক নয়। নতুন করে ভেঙে গড়ার খেলায় এইটুকু হাতছানি দরকার ছিল আর্জেন্টিনার। গুহার শেষ মাথায় আলোর ঝলকানি হয়ত এখনও দেখা যায়নি, কিন্তু আলোর রেখা একটু একটু জ্বলতে শুরু করেছে। তাতে অন্তত নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহসটুকু সঙ্গী হয়েছে নতুন আর্জেন্টিনার।