এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভকে হারিয়ে ফাইনালের আশা বাঁচিয়ে রাখল আবাহনী
ম্যাচশেষে পুরো আবাহনী দল মাঠেই তুলে ফেলল সেলফি। ক্যামেরাটা ধরলেন অধিনায়ক শহীদুল আলম সোহেল। খেলোয়াড়দের মতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হাজির হাজার পাঁচেক সমর্থকও খুশি। আবাহনী সেমিফাইনালের প্লে-অফে উঠেই ইতিহাস গড়ে ফেলেছিল। এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভকে হারিয়ে আরও একটি ইতিহাস রচনার দিকে এবার এগিয়ে গেল আবাহনী। সাত গোলের নাটকীয় ম্যাচে আবাহনী জিতেছে ৪-৩ গোলে। ২৮ আগস্ট দ্বিতীয় লেগে পিয়ংইয়ংয়ে আবাহনীকে করতে হবে অন্তত ড্র, তাহলেই প্রথমবারের মতো জোনাল ফাইনালে উঠে যাবে আকাশি-হলুদরা।
উত্তর কোরিয়ার চ্যাম্পিয়ন এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ। এএফসি কাপে গতবার ফাইনালেও উঠেছিল তারা। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তো বটেই, এই ম্যাচের আগে আবাহনীর প্রতিপক্ষ ছিল ইনজুরি আর নিষেধাজ্ঞাও। মামুনুল ইসলাম, ইসাদের ছাড়াই দল সাজাতে হয়েছিল আবাহনী কোচ থমাস মারিয়া লেমোসকে। একাদশে ফিরেছিলেন মামুন মিয়া, আর অভিষেক হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ডিফেন্ডার লি তায়েমিনের। মৌসুমে প্রথমবারের মতো থ্রি ম্যান ব্যাক লাইনে দুই উইংব্যাক নিয়ে খেলা শুরু করেছিল আবাহনী।
এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভের বিপক্ষে শুরুটাই আবাহনীর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটা। লং থ্রো থেকে প্রথম দশ মিনিটে দুইবার এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভের রক্ষণে ভয় চড়িয়ে দিল আবাহনী। এর মধ্যে মামুন মিয়া একবার ভালো জায়গায় বল পেয়েও মারলেন ওপর দিয়ে। ক্রেভেন্স বেলফোর্ট দুইবার গোলরক্ষক আন তে সংকে নেয়ারপোস্টে ভালো সেভ করতে বাধ্য করলেন। এতো কিছুর পরও ম্যাচের প্রথম আধঘন্টা আবাহনীকে পার করতে হলো গোলশূন্যভাবে।
মামুনুল ইসলামের জায়গায় মিডফিল্ডে সুযোগ পেয়েছিলেন সোহেল রানা। ৩৩ মিনিটে গোল থেকে প্রায় ২৫ গজ দূরে বল পেলেন তিনি। বাম পায়ে সেখান থেকেই শট করলেন, গোলার মতো গিয়ে সেটা জড়াল এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভের জালে। দুর্দান্ত শুরুর পুরো ফায়দাটা ততোক্ষণে পাওয়া গেল আবাহনীর।
কিন্তু লিডটা ধরে রাখা হলো না দুই মিনিটও। গোল দেওয়ার পরপরই গোল হজমের জন্য সবচেয়ে মোক্ষম সময়, পুরনো প্রবাদটা সত্যি করে ছাড়ল এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ। সোহেল রানার গোলটাই ফেরত দিলেন জং হিয়োক চো। ও হিয়োক চলের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাকহিল তাকে সুবিধা করে দিল অনেকটা। চো গোল করলেন আরেকটু সামনে থেকে, আর সোহেল রানার মতো বাম পায়ে নয়, ডান পায়ে। এটুকুই পার্থক্য। আর বাকিটা একেবারে হুবহু।
প্রথমার্ধটা অবশ্য খুব বেশি আক্ষেপে পোড়াল না আবাহনীকে। সেই গোল হজমের প্রবাদটা এবার টুয়েন্টি ফাইভকে মনে করিয়ে দিলেন নাবিব নেওয়াজ জীবন। আগের গোলে সোহেল রানাকে ব্যাকহিলটা দিয়েছিলেন তিনি। লং থ্রো থেকে আবাহনীর আক্রমণ ক্লিয়ার করেছিল এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ। ডিবক্সের বাইরেই বল পেয়েছিলেন ওয়ালি ফয়সাল। ডান পায়ের এলোমেলো শট এপ্রিল টুয়েন্টিফাইভ ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে ভাগ্যক্রমে ডিবক্সের মাথায় পেয়ে গেলেন জীবন। দুই স্টেপ সামনে এগিয়ে এগিয়ে আসা গোলরক্ষককে সুযোগ না দিয়েই সরাসরি গোল করে ব্যবধান ২-১ করেন বাংলাদেশ ফরোয়ার্ড।
প্রথমার্ধে এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভকে লং থ্রো আর সেট পিস থেকে ভুগিয়ে যাচ্ছিল আবাহনী। বিশেষ করে রায়হান হাসানের লং থ্রোই ছিল বাংলাদেশের বেশিরভাগ আক্রমণের উৎস। রায়হান অবশ্য এদিন খেলেছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের রোলে। থ্রোয়ের পাশাপাশি প্রায় পুরোটা সময়ই নিখুঁত ছিলেন তিনি।
উত্তর কোরিয়ার ক্লাব দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য দারুণ শুরু করল। তাতে কিছুটা এলোমেলো আবাহনী পড়ে গেল চাপে। প্রথম দশ মিনিটেই সন ফিল ইয়ং ডিবক্সের ভেতর ঢুকে মারলেন বাইরে দিয়ে, রিম চল মিনের হেড অল্পের জন্য গেল বাইরে দিয়ে। কিন্তু তাকে বেশিক্ষণ গোলবঞ্চিত থাকতে হলো না। ৫৪ মিনিটে ডিবক্সের ভেতর থ্রু পাস রিসিভ করে গোলার মতো শটে গোল করে আরও একবার আবাহনীকে ঝামেলায় ফেলে দিলেন স্ট্রাইকার চল মিন।
জবাব, পালটা জবাবের ম্যাচে এরপর বেলফোর্ট-সানডে জাদু দেখল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। মিডফিল্ড থেকে দৌড় শুরু করলেন বেলফোর্ট। দুইজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে একাই চলে গেলেন ডিবক্সের কাছকাছি। বেলফোর্ট বলটা যতক্ষনে স্কয়ার করলেন ততোক্ষানে প্রায় ফাঁকায় চলে গিয়েছেন নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার। সানডে এরপর বল নিয়ে আরও সামনে এগুলেন, ১০ গজ দূর থেকে দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে নিশ্চিত করলেন তার সামনে নেই আর কেউ। দারুণ কম্পোজারের পর এরপর একরকম ফাঁকা বারেই আর ভুল করলেন না সানডে। ৫৭ মিনিটে আবাহনী ৩, ২ এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভরে।
এ গোলের রেশ না কাটতেই চার মিনিট বাদে আরেকবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে নাচিয়ে তোলেন সানডে। টুটুল হোসেন বাদশার ডিফেন্স থেকে দেওয়া লং বল রিসিভ করে সানডে ঢুকে গেলেন ডিবক্সের ভেতর। গোলরক্ষকের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে নিচু শটে বটম কর্নারে বল জড়ালেন জালে।
ম্যাচের বাকি তখনও প্রায় আধঘন্টা। জয়টা তাই তখনও নিশ্চিত হলো না। এরপরের সময়টা খেলা হল আবাহনীর রক্ষণ বনাম এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভের আক্রমণ। ৭৭ মিনিটে কর্নার থেকে কপাল পুড়ল আবাহনীর। কর্নার থেকে বাম প্রান্তে বল পেয়েছিলেন চো জং হিওক, এরপর করলেন ক্রস। গোলরক্ষক শহীদুলকে আফসোকে পুড়িয়ে হেডে বদলি সং রক পার্ক করলেন লক্ষ্যভেদ।
দলের মূল স্ট্রাইকার কিম ইউ সংকে ছাড়াই একাদশ সাজিয়েছিল এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ কোচ। শেষদিকে তাকে নামিয়ে দিয়ে আবাহনীর রক্ষণে কাজ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। অভিষিক্ত লি দ্বিতীয়ার্ধে দারুণ এক ব্লক করেছিলেন। পুরো ম্যাচে অবশ্য তার দুই সঙ্গী বাদশা ও মামুনও খুব বেশি ভুল করলেন না। তবে ইনজুরি সময়ে বারপোস্টে আন ইল বোমের হেড বারপোস্টে লেগে ফেরত না গেলে আবাহনীর আফসোস বেড়ে যেত আরেকটু। শেষ পর্যন্ত ওই আক্রমণে বিফলে গেছে এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ। এরপরই একরাশ স্বস্তি পেয়েছে আবাহনী।
তিনবার এএফসি কাপে খেলে প্রতিবারই অন্তত সেমিফাইনালে খেলেছে এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ। এবার ছয় ম্যাচে গোল হজম করেছিল মাত্র দুইটি। আর আবাহনী তাদের এক ম্যাচেই দিল এক হালি গোল। অনেক কিছু বিপক্ষে থাকলেও তাই শক্তিশালী এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভের বিপক্ষে জয়টা তাই অ্যাওয়ে গোলের মারপ্যাঁচ ছাপিয়ে অনেক বেশি তৃপ্তির আবাহনী জন্য।
একাদশ
আবাহনী
শহীদুল আলম, রায়হান হাসান, ওয়ালি ফয়সাল, টুটুল বাদশা, লি টায়েমিন, সোহেল রানা, নাবিব নেওয়াজ, সানডে চিজোবা, মামুন মিয়া, সাদ উদ্দিন, ক্রেভেন্স বেলফোর্ট
এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ
আন তে সং, জিন মিয়ং, চুং হিওক, পাক সং রক, আন সং ইল, ও হিওক চল, সন ফিয়ল ইল, চল সু, চো জং হিওক, ওম চল সং, রিম চল মিন