দুই ধরনের মোমেন্টামের এক উপপাদ্য ও একজন দাসুন শানাকা
মোমেন্টাম, মোমেন্টাম। একটা ভরবেগ- পদার্থবিদ্যার টার্ম- একটা গতিশীল বস্তুর ভর ও বেগের গুণফলের পরিমাপ। আরেকটা প্রেরণা- বা উদ্দীপনা বা চালিকাশক্তি- এক বা একাধিক ঘটনার কারণে কোনও কিছুর গতি বা কার্যকারীতায় পরিবর্তন আসা।
ক্রিকেটে দুই ধরনের মোমেন্টামের উপস্থিতিই আছে। পদার্থবিদ্যার মোমেন্টাম তো ক্রিকেটের একদম মূল ব্যাপারগুলির একটি- বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে- একটা ড্রাইভ বা কাট কতোখানি নিঁখুত তা নির্ভর করছে ওই মোমেন্টাম কতো ভালভাবে ব্যাটসম্যান ‘শিফট’ করাতে পারলেন। টাইমিং, এর আগে শরীরের ঝুঁকে যাওয়া বা পায়ের অবস্থান, অথবা মাথার পজিশনের সঙ্গে কনুই-কবজির দিক- সবই তো বলের মোমেন্টাম বা ভরবেগ ঠিকঠাক বদলানোর জন্যই।
আরেক মোমেন্টামের বিস্তৃতি আগেরটির চেয়ে বেশি না হলেও কম নয়। হতে পারে যে কোনও একটা ডেলিভারি, একটা এক্সট্রা, একটা ক্যাচ অথবা একটা ফিল্ডিং। হতে পারে একটা স্পেল, একটা ওভারে ব্যাটসম্যানের খেলা শট, বা আম্পায়ারের কোনও ভুল সিদ্ধান্ত। এই মোমেন্টাম বা উদ্দীপনা বা চালিকাশক্তি বদলে যেতে পারে মুহুর্তেই। এক দল এই মোমেন্টামের ছোঁয়ায় তখন এগিয়ে যায় আরেক দলের চেয়ে।
একটা ছয়ের ক্ষেত্রে টেকনিক বা পাওয়ারের সঙ্গে তাই জড়িয়ে থাকে মোমেন্টাম বা ভরবেগ। দাসুন শানাকা এই মোমেন্টামের সর্বোচ্চ প্রয়োগটা এদিন করলেন গুণে গুণে নয়বার। এর মধ্যে আটবারই শেষ ৩ ওভারে গিয়ে, যে ১৮ বলে উঠল ৬৫ রান। আর তাতেই বদলে গেল কুমিল্লা-রংপুর ম্যাচের মোমেন্টামটা, ওই দ্বিতীয় মোমেন্টামটা।
শানাকা এদিন মিশে থাকলেন দুই মোমেন্টামেই।
ছয়ের বৃষ্টি নামালেন প্রথমে। গ্রেগরি-মোস্তাফিজ-জুনাইদদের উড়িয়ে মারলেন- মানে তাদের মোমেন্টাম বদলে নিয়ে ফেললেন গ্যালারিতে- মানে তাদেরকে নয়, তাদের করা বলগুলিকে। এমন ছয় মারার রহস্য জানতে চাইলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টেকনিকের কথাই বললেন এই শ্রীলঙ্কান, “শুধু শক্তি তো না। টেকনিকও। আমার (শরীর নড়িয়ে) শরীরে দিকে তাকিয়ে দেখেন- কেমন হ্যাংলা আমি। (আসলে) টেকনিক ছয়ের জন্য ভূমিকা রাখে। শক্তি আসে অনুশীলন থেকে। কঠোর পরিশ্রম করি। তারই ফল।”
পরে রংপুর ব্যাটসম্যান জহুরুল ইসলামও বললেন ঠিক এমন কথাই, “(ছয় মারার ক্ষেত্রে) অবশ্যই টেকনিক জরুরী। পাওয়ার হিটার যতোই হোক, টেকনিকে গলদ থাকলে হবে না। ওকে দেখে মনে হয়নি খুব জোরে মেরেছে। ভিতটা ভাল ছিল, টাইমিং ভাল ছিল। অনেক বড় ছয় মারতে পারে বা শারীরিক আকৃতিতে ক্রিস গেইল, কার্লোস ব্রাথওয়েটদের মতো মনে হয় না বাইরে থেকে দেখে। শরীরের দিক দিয়ে তো আমাদের মতোই। তবে ব্যাট সুইং ভাল। টেকনিক ভাল। সেটাই কাজে এসেছে তার।”
আর শানাকা বললেন, ছয়ের জন্য বাড়তি অনুশীলন তিনি করেন না, মানে শুধুই বড় শটের জন্য করেন না। করলে করেন আরও গোড়ার কাজ- টেকনিকের কাজ, “ছয়ের অনুশীলন করি না। আমি টেকনিক নিয়েই কাজ করি। যখন শুরু করেছিলাম, টেকনিক অতটা ভাল ছিল না। পরে আমার সাথে যায় এমন একটিতে স্থির হয়েছি। খেলা ভাল করতে এমন করেছি।”
ফিফটির পর শানাকা/বিসিবি
এদিনও শুরুতে থাকতে চেয়েছেন স্থির। তার মতে, এ উইকেটে এটিরই দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি, “আমাদের (আগের) ব্যাটসম্যানরা উইকেট ভালভাবে পড়তে পারেনি। কিছুক্ষণ থাকলে পারত। আমি ১০-১২ বল খরচ করেছি উইকেট বুঝতে। এভাবেই সাফল্য পেয়েছি।”
মোস্তাফিজকে একবার পাঠিয়েছেন গ্যালারির বাইরে, মানে তার করা বলটিকে মোমেন্টাম বদলে দিয়ে। সব মিলিয়ে ইনিংসটি উপভোগ করেছেন শুধু, “তিন-চারবার খেলেছি আমি তার বিপক্ষে এ নিয়ে। আমি জানি, তার পরিকল্পনা। আমি তার আলগা বলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
শানাকা যখন নিজেকে উপভোগ করছিলেন, কুমিল্লা তখন পেয়ে যাচ্ছিল ম্যাচের মোমেন্টাম, ওই পরের মোমেন্টাম। আর রংপুর ছিটকে যাচ্ছিল ম্যাচ থেকে। জহুরুল স্বীকার করলেন সেটি, লক্ষ্য আদতে অতটা বড় ছিল না, তবে শানাকার ওই ৩ ওভারের ঝড়েই বদলে গেছে সব, “আশা করেছিলাম, ওদের রান ১৩৫-৪০ হবে, প্রথম ১৬ ওভার যেমন ছিল। ওই অতিরিক্ত ৩০-৪০ রান নিয়ে পরে আমাদের ব্যাটসম্যানরা বেশি ভেবে ফেলেছে। উইকেট ভাল ছিল, পাওয়ারপ্লেতে ভাল শুরু করতে পারতাম, তাহলে মিডল অর্ডার তাড়া করতে পারত, আমাদের সেই সামর্থ্য ছিল- মোহাম্মদ নবি, লুইস গ্রেগরিরা ছিল।”
তবে, “মোমেন্টামের খেলা। (মোস্তাফিজেরও, ১৯তম ওভারে) প্রথম দুইটা ছয় খাওয়ার পর যে কোনও বোলারের মতোই মাথা কাজ করেনি। হুট করে অমন দুইটা ছয় খাওয়ার পর তার সেট-আপ বদলে গেছে, পরিকল্পনার বাইরে চলে গেছে। প্রথম ১৬ ওভার (আদতে ১৭ ওভার) আমরা খুব ভাল অবস্থানে ছিলাম, এরপরই হঠাৎ করে মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলি। এবং সেটা ব্যাটিংয়েও বয়ে নিয়ে যাই।”
শানাকা যখন তার বিশ্বস্ত টেকনিক দিয়ে মোমেন্টাম বদলে দিচ্ছিলেন ক্রিকেট বলের, তখন বদলে যাচ্ছিল ম্যাচের মোমেন্টাম।
প্রমাণিত।