তামিমের ক্যারিয়ারে ট্রিপল সেঞ্চুরির 'ইস্ট-উইন্ড'
“ইস্ট উইন্ড ইজ কামিং, শার্লক!”
বিবিসির শার্লককে ওপরের বাক্যটা বলে ভয় দেখানো হতো। ‘ইস্ট-উইন্ড বা পুবের বাতাস’ আদতে কী, শার্লক সেটি জানতেন না। মাইক্রফট হোমস রূপক অর্থে এটি বলে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিতেন কিনা, শার্লক হোমস জানতেন না সেটিও। যখন জানলেন, সেই ‘ইস্ট উইন্ড’কে সামলানোর ভারটা নিতে হলো তাকেই।
ইস্ট উইন্ড ঠিক ভয়ের ব্যাপার নয়, মুখোমুখি হয়ে সামলানোর ব্যাপার।
তামিম ইকবালের কাছে ট্রিপল সেঞ্চুরি ছিল যেন ইস্ট-উইন্ডের মতো। ঠিক ভয় পেতেন, তা বলা মুশকিল। নাসির হোসেন ৫ রান দূরে থেমেছিলেন, ১১ রান দূরে থেমেছিলেন মার্শাল আইয়ুব। এতদিন একমাত্র বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে এই মাইলফলক ছিল রকিবুল হাসানের, প্রায় ১৩ বছর আগে যিনি ৬০০-এর বেশি বল খেলে করেছিলেন অপরাজিত ৩১৩ রান। তামিম বিস্মিত হতেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতো- “শালার কতো ধৈর্য্য” যে ৩০০ করে ফেলে!
আর রকিবুল বলছিলেন, আদতে এমন ‘মাইলফলক’-এর জন্য একটু ভাগ্য লাগে।
রকিবুল তামিমের বন্ধু। তামিম এখন জানেন, ৩০০ করলে কেমন লাগে। ৩০০-এর কাছাকাছি যেতে কতোখানি ভার নিতে হয়, কী সামলাতে হয়।
****
যেন রেসের ট্র্যাকে একেকটা ল্যাপ পার করা। ব্যাটিংয়ের মাইলফলকগুলি হয়তো এমনই। তবে রেসে আপনি জানেন, এরপর কতো ল্যাপ বাকি, ল্যাপ রেকর্ড আলাদা করে গড়লেও মোট সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। কোন ল্যাপ কীভাবে পার করলেন, প্রতিপক্ষ, নিজের টাইমিং, কৌশল- সব মিলিয়ে নির্ধারিত হবে আপনি কোথায় থাকলেন।
ব্যাটিংয়ের মাইলফলক অবশ্য ল্যাপ দিয়ে নির্ধারিত নয়। কখনও সেশনের হিসাব, কখনও দিন, কখনও ব্যাটিং, অথবা কখনও মাইলফলক বা রেকর্ড ছুঁতে বা পেরিয়ে যেতে আর কতো রান বাকি- এক্ষেত্রে ল্যাপের দৈর্ঘ্য-আকার-আকৃতি-পরিস্থিতি- বদলে যায় অনেক কিছুই। আপনি বলতে পারেন, ব্যাটিংয়ে ল্যাপটা অসীম, কয়বার এই ল্যাপ চক্কর দেবেন- সেটি ঠিক করার ভার আপনার।
মাঝে মাঝে খুব সরল ব্যাটিং তাই কাজে দেবে আপনার এসব ল্যাপ পেরিয়ে ট্র্যাক শেষ করতে। তামিম এ ইনিংসে যা করলেন।
প্রথম দিন দুই বলের জন্য নেমেছিলেন, তবে ছিলেন নন-স্ট্রাইক প্রান্তে। পরদিন লাঞ্চের আগে ফিফটি, চা-বিরতির আগে দেড়শ, শেষ সেশনে ২০০ পেরিয়ে যাওয়া- তামিম ল্যাপগুলি পেরুলেন। এদিন ট্রিপল থেকে আরও ৭৮ রান দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে সেটি না হওয়ার যেন কারণ ছিল না।
স্কোরকার্ড কথা কয়!
তামিম নিজে ভাবতে পারেননি, এ ম্যাচে এই মাইলফলকে যেতে পারবেন তিনি। রকিবুলের মনে হয়েছিল তেমন। তামিমের ব্যাটিংয়ের স্টাইল বলছিল এমন। তার রেকর্ড ভাঙার পর তামিমকে গিয়ে বলেছিলেন, “লারার রেকর্ডটাই ভেঙে দে”!
তামিম তার ব্যাটিং সরল করে ফেলেছিলেন, “আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। উইকেটে বল সেভাবে ঘুরছিল না, বাড়তি কিছুই হচ্ছিল না। তো আমার কাছে মনে হয়েছে আমি নিজেকে ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করেছি। তিনশ রান করার পর আমি সুযোগ নিয়েছি। এর আগে আমার মনে হয় না আমার বিশেষ কিছু করার ছিল। আমি ব্যাটিং করে গেছি। ক্রিকেটীয় শটস খেলে গিয়েছি। সব সময় চেষ্টা করছিলাম যে আমি চার মারব। ছয় মারার কোনো চিন্তা ছিল না।”
তিনশ ছোঁয়ার আগে তামিম ৪০টি চার মেরেছেন। ছয় মারেননি একটিও।
****
প্রথম শ্রেণিতে এর আগে ট্রিপল সেঞ্চুরি ছিল ২২৯টি। ৩৫০-এর ওপরে আছে ৩৮টি। তামিমের সমান ৩৩৪ রানের ইনিংসও আছে তিনটি। তামিম যে দুইয়ে ব্যাটিং করেছেন, সেখানেই এর চেয়ে বড় ইনিংস আছে ১৩টি। তাহলে তামিমের ইনিংস আদতে তাৎপর্যপূর্ণ কেন?
১৩ বছর ধরে একটি রেকর্ড টিকে থাকা এবং এরপর সেটি ভেঙে দেওয়া- মাহাত্ম্য তো আছেই। অবশ্য তামিমের উদযাপনে তেমন কিছু থাকলো না। এমনকি হেলমেটটাও খুললেন না। তিনশ আর ৩১৩ পেরিয়ে যাওয়ার পর ব্যাটটা তুললেন ড্রেসিংরুমের দিকে, ৩০০-এর সিঙ্গেলটা নিতে যেন গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন একটু- এই যা। দিনের খেলা শেষে বিসিবি কেক আনলো, রকিবুলকে পাশে রেখে সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে সেটি কাটলেন তামিম। বিসিএলে মিডিয়া পেলো বাড়তি নজর।
তামিম বলছেন, তিনশ মানেই ব্যাপারটা বিশেষ কিছু, “এটা স্পেশাল ইনিংস। তিনশ করা যেকোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কঠিন। আবার যেকোনো পর্যায়েই এটি করা কঠিন। যদি সহজ হতো তাহলে প্রত্যেক মাসে দেখতেন যে, একজন করে তিনশ করছে। এটা খুবই স্পেশাল। আমার হৃদয়ে খুব বড় জায়গায় এটা থাকবে।”
তবে তামিমকে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি দিচ্ছে তার খেলার ধরনটি, “অবশ্যই এটা দারুণ অনুভূতি। তিনশ করা… সত্যি কথা আমি কোনোদিন চিন্তা করিনি তিনশ করার। স্বপ্ন অবশ্যই থাকে। এ ম্যাচে হয়ে যাবে সেটা কখনো ভাবিনি। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা, সেটা হলো আমি কীভাবে ব্যাটিং করেছি। এটা না যে আমি কতো রান করেছি বা আমি ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছি…সবচেয়ে বেশি স্বস্তি ছিল আমি যেভাবে ব্যাটিং করেছি। আমি এতে খুশি, আশা করি আমি এভাবেই খেলে যেতে পারব।”
'স্পেশাল ইনিংস', 'স্পেশাল ছবি'
আগেরদিন ২২২ রান হওয়ার পর মুমিনুল বলেছিলেন, তিনি আশা করেন তামিম যাতে ইনিংস ঘোষণা করা পর্যন্ত খেলেন। এবং ততক্ষণ তামিম খেললে তার ৩০০ হয়ে যাবে। তামিম অবশ্য ৩০০-এর কথা মাথাতেই আনেননি আগে, “সত্যি ২৬০-৭০ হওয়ার পরও কিন্তু আমি এটা নিয়ে ভাবছিলাম না। ২৮০ ছোঁয়ার পর আমি এটা নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমি যদি ওটা চিন্তা করি তাহলে আমার পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হয়তো আমি একটু অন্যভাবে খেলার চেষ্টা করবো। ‘সিম্পল’ থাকার চেষ্টাটা করবো। এটা আমার হয়ে কাজ করেছে। এটা ভালো ছিল।”
তামিম ‘সিম্পল’ থেকেছেন। পুরো ইনিংসে বারদুয়েক তার বিপক্ষে এলবিডব্লিউর আবেদন করেছিলেন সেন্ট্রালের বোলাররা, একটি বোলারস ব্যাকড্রাইভ গেছে বোলারের নাগালের বাইরে দিয়ে। তামিমকে আউট করার কাছাকাছি এতটুকুই যেতে পেরেছিলেন তার প্রতিপক্ষ দলের বোলাররা।
****
ক্যারিয়ারে ৯০তম প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলছেন তামিম। ২০০৫ সালে অভিষেক, টেস্টে অভিষেক ২০০৮ সালে। ২০১৫ সালে এর আগ পর্যন্ত একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটি করেছিলেন, খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে। প্রথম শ্রেণিতে ১৫০-পেরিয়েছেন এর আগে ৪ বার।
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে লম্বা ইনিংস খেলবেন- এমন তালিকা করলে তামিম কি সবার ওপরে থাকবেন আপনার কাছে?
এর আগে ৪টি দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন, এ ম্যাচের আগে সবচেয়ে কম ৩২.৩৩ গড় ছিল তার বিসিএলে এই ইস্ট জোনের হয়ে। নিজ বিভাগ চট্টগ্রামের হয়ে জাতীয় লিগে তার গড়টা সবচেয়ে বেশি ছিল- ৫৫.৫৫। এই ইনিংসের পর তামিমের আপাতত ইস্ট জোনের হয়ে গড় ১০৭.৭৫।
তামিম ২২২ রানে অপরাজিত থেকে দিন শেষ করার পরও ভাবেননি ট্রিপল সেঞ্চুরির কথা। হয়তো জাতীয় লিগে এক রাউন্ড খেলার পর, মাঝে দুটি টেস্ট সিরিজ মিস করার পর আবার দীর্ঘ সংস্করণে ফেরার কথাই ভাবছিলেন।
২৯৮-এ দাঁড়িয়ে ৯ টি বলে রান নিলেন, তখন কি ভাবনায় ছিল ট্রিপল? নিশ্চয়ই। ২৯৯-এ দাঁড়িয়ে অবশ্য একটি বল রান ছাড়া গেল তার। এরপরই শুভাগতর বলে সেই সিঙ্গেল। তামিমের ক্যারিয়ারের ‘ইস্ট উইন্ড’টা এলো।
“প্রথমত আমি অভিনন্দন জানিয়েছি। আপনারা মনে হয় জানেন আমরা একসঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছি”, বলছিলেন রকিবুল, “আমাদের একসঙ্গে যাত্রা অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে। সেদিক থেকে তামিম আমার অন্যতম সেরা বন্ধু। আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনারা সবাই স্বাক্ষী, তামিম আজকে যেভাবে খেলেছে, এটা তার প্রাপ্য।”
ট্রিপলের ‘ইস্ট-উইন্ড’টা নিশ্চয়ই ধ্বংসাত্মক নয়, তামিমের কাছে মনে হয়েছে রোমাঞ্চকর।