নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে বাংলাদেশের যুবারা
নিউজিল্যান্ড অ-১৯ ২১১-৮, ৫০ ওভার
বাংলাদেশ অ-১৯ ২১৫-৫, ৪৪.১ ওভার
বাংলাদেশ অ-১৯ ৫ উইকেটে জয়ী
আল-শাহরিয়ার-হান্নান সরকার অথবা মোহাম্মদ আশরাফুল-রাজিন সালেহরা আটকে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। বয়সভিত্তিক দলের ‘সোনালী প্রজন্ম’- মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরা অন্যতম ‘ফেভারিট’ হয়েও ফিরেছিলেন ৫ম হয়ে। মেহেদি হাসান মিরাজ, নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন দাস, ইয়াসির আলি রাব্বিরা হয়েছিলেন ৯ম। মিরাজের নেতৃত্বেই সাইফ হাসান, সাইফউদ্দিনরা আটকে গিয়েছিলেন সেমিফাইনালে, দেশের মাটিতে হয়েছিলেন তৃতীয়। গতবার সাইফ-হাসান মাহমুদরা ফিরেছিলেন ৬ষ্ঠ হয়ে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের বিশ্বকাপে তারা রাজপুত্তুর হয়ে উঠতে পারেননি ঠিক বাংলাদেশের। আকবর আলি- মাহমুদুল হাসান জয়রা গড়লেন ইতিহাস- প্রথম বাংলাদেশ দল হিসেবে অ-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে চলে গেছেন তারা, পচেফস্ট্রুমের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে উড়িয়ে। কোনো বৈশ্বিক আসরে ছেলেদের ক্রিকেট দল এই প্রথম ফাইনালে উঠল।
শেষদিকের ঝড়ে নিউজিল্যান্ড গিয়েছিল ২১১ পর্যন্ত, সেমিফাইনালের চাপ বা অতীত রেকর্ড হয়তো একটু চোখ রাঙাচ্ছিল বাংলাদেশকে। তবে মাহমুদুল হাসান জয় সেসবকে পাত্তা দিলেন না, অ-১৯ পর্যায়ে তিনি দেখালেন যে কোনও সিনিয়র লেভেলের ক্রিকেটারের মতোই স্নায়ু। করলেন সেঞ্চুরি, তাও আবার ৩২ রানে ২ উইকেট চলে যাওয়ার পর। প্রথমে তৌহিদ হৃদয়ের সঙ্গে ৬৮ রানের জুটিতে শঙ্কা কাটালেন মোটামুটি, শাহাদত হোসেনের সঙ্গে আরও ১০১ রানের জুটিতে স্বপ্নের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন তিনি। এরপর শামিম হোসেনকে নিয়ে সারলেন আনুষ্ঠানিকতা।
৬ষ্ঠ ওভারে প্রথম আঘাত হেনেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান ক্লার্ক, তানজিদ হাসান ইমন ক্যাচ দিয়েছিলেন থার্ডম্যানে। এরপর ডেভিড হ্যানককের দ্রুতগতির বলটা ছেড়ে দিতে গিয়েও গ্লাভড হয়েছিলেন তানজিদ হাসান। চাপটা যেন জেঁকে বসতে চাচ্ছিল। ইনফর্ম হৃদয় আর জয় সেসব চাপ উড়িয়ে দিলেন। প্রথম ৮ ওভারে ৩১ রান তোলা বাংলাদেশ ২০ ওভার শেষে গেল ৯০ রানের শক্ত ভিতে। আদিত্য অশোকের দারুণ এক ডেলিভারিতে বেরিয়ে এসে পরাস্ত হলেন হৃদয়, ৪৭ বলে ৪০ রান করে। তবে এর আগে যেন শাহাদত হোসেনের হাতে ব্যাটনটা তুলে দিয়ে গেলেন, জয়ের সহকারী ভূমিকায় এগিয়ে যাওয়ার।
জয় নিজের প্রথম ৫০ বলে করেছিলেন ৩৩ রান, ফিফটিতে গিয়েছিলেন ৭৭ বলে। টাশকফকে চার মেরে সেঞ্চুরিতে গেলেন ১২৬ বলে। সেমিফাইনাল-ফাইনালে টানা পাঁচটি ভারতীয় ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরির ধারা ভাঙলেন তিনি, এর আগেই তো গড়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম স্বর্ণালী এক অধ্যায়। সেঞ্চুরির পরের বলেই ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন, তবে শাহাদাত-শামিম এরপর সময় নেননি বেশি।
এর আগে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ২৬তম ওভারে ৭৪ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরও নিউজিল্যান্ড ১১ রান পর্যন্ত গিয়েছিল মূলত বেকহ্যাম হুইলার-গ্রিনঅলের ৮৩ বলে ৭৫ রানের ইনিংসে। তার ইনিংস বাদ দিলে নিকোলাস লিডস্টোনের ৭৪ বলে ৪৪ রান আছে নিউজিল্যান্ডের, তবে বাকি গল্পটা বাংলাদেশ বোলারদের।
অবশ্য কন্ডিশনের সুবিধা পেসারদের দিয়ে কাজে লাগানোর চেয়ে স্পিনারদের ওপরই ভরসা করেছে তারা। শুরুতেই একদিক থেকে স্পিনার শামিম হোসেনকে এনেছিলেন আকবর আলি। প্রথম ব্রেকথ্রুটাও দিয়েছিলেন তিনিই। শামিমের অফস্টাম্পের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে এজড হয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছেন রাইস মাইরু। প্রথম ওভারে শরিফুলের বোলিংয়ে যেটির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, নিউজিল্যান্ডের রানের জন্য সংগ্রাম এরপর অফিশিয়ালি শুরু হয়ে গেল।
৬ষ্ঠ ওভারে গিয়ে প্রথম বাউন্ডারি পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড, প্রথম দুই ওভারে শরিফুলের কাছ থেকে ব্যাটে কোনও রান নিতে পারেনি কিউইরা। প্রথম পাওয়ারপ্লেতে তারা তুলেছিল মাত্র ২৬ রান। বোলিংয়ে এসে প্রথম ২ ওভার মেইডেন করেছিলেন ফারগাস লেলম্যানকে, তবে সেই চাপের শিকার হয়েছেন ওলি হোয়াইট। স্টাম্পের একটু বাইরের বলটা পাঞ্চ করতে গিয়ে এজড হয়েছেন তিনি, উইকেটের পেছনে তীক্ষ্ণ ক্যাচ নিয়েছেন আকবর।
ইনিংসের পরের ধাপে ১০ ওভারে আর ২৯ রান তুলেছে নিউজিল্যান্ড, এবার সংগ্রাম করছিলেন লেলম্যান ও নিকোলাস লিডস্টোন। ২১তম ওভারে তাদের সংগ্রামের অধ্যায়ের ইতি টেনেছেন শামিম, অবশ্য এটি যতোটা শামিমের উইকেট, ততোটা ভাগ আছে মাহমুদুল হাসান জয়েরও। শর্ট বলে পেছনের পায়ে ভর করে টেনে পুল করেছিলেন লেলম্যান, শর্ট মিডউইকেটে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ ক্যাচ নিয়েছেন জয়।
জেসি টাশকফ বেশিক্ষণ টেকেননি, হাসান মুরাদের ঝুলিয়ে দেওয়া বলটা মিডউইকেটে টেনে খেলতে গিয়েছিলেন জোরের ওপর। তবে বলের লাইন বুঝে উঠতে পারেননি, পুরো মিস করে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক হারিয়েছেন তার স্টাম্প।
নিউজিল্যান্ড ইনিংসের সবচেয়ে ভাল অধ্যায়টা এসেছে এরপর। লিডস্টোনের সঙ্গে বেকহ্যাম হুইলার-গ্রিনঅলের জুটি নিউজিল্যান্ডকে পিচ্ছিল পথে পায়ের নিচে একটু শক্ত মাটি এনে দিয়েছিল। দুজন মিলে ১৫ ওভার ব্যাটিং করেছেন, যোগ করেছেন ৬৭ রান। মাঝে তানজিম হাসান সাকিব বেশ কয়েকবার এজ বিট করেছেন, আবার উলটো রাকিবুলকে দুই বাউন্ডারি মেরেছিলেন হুইলার-গ্রিনঅল।
শরিফুল ফিরে এসে ফিরিয়েছেন লিডস্টোনকে, ডেথ ওভারের শুরুতেই। তার ফুলটস ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে মিস করে এলবিডব্লিউ হয়েছেন লিডস্টোন। পরের ওভারে কুইন সুন্ডেকে বোল্ড করে নিউজিল্যান্ডকে আরেকটু ঠেলে দিয়েছিলেন হাসান মুরাদ। অবশ্য একদিক থেকে হুইলার-গ্রিনঅলের আক্রমণ চলেছেই- ৯ বলে ৭ করে ক্রিশ্চিয়ান ক্লার্ক ও ১টি করে চার-ছয়ে জোয়ি ফিল্ডের ১১ বলে ১২ রানে ফিরলেও তিনি ছিলেন শেষ পর্যন্ত।