যে গল্পটা বাংলাদেশের নয়...
গল্পটা আপনার ঠিক বাংলাদেশের মনে হবে না কোনোভাবেই। এই গল্পের যারা কুশীলব, তারা আপনার আমার মতোই বাংলাদেশি। কিন্তু পাশের বাড়ির ছেলের মতো চেনা হয়েও এক অর্থে তারা ভীষণ অচেনা। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ দলটা মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভারতকে যেভাবে হারিয়েছে, সেটা তো বাংলাদেশের কোনো দলের সঙ্গেই মেলানো যাবে না কোনোভাবে। তবে এই যুবারা দল হিসেবে যেভাবে খেলেছে, সেই গল্পটা এই বদ্বীপে প্রায় রূপকথার মতো মনে হবে।
আকবর আলীর কথা ধরুন। বয়স এখনো ১৯ পেরোয়নি, বিশ্বকাপের মধ্যেই শুনতে হয়েছে বোনের মৃত্যুর দুঃসংবাদ। তবে আকবর সেই শোককে পরিণত করেছেন শক্তিতে। ফাইনালে যখন নিজের কাঁধে দলকে নিয়ে যাওয়ার পাহাড়প্রমাণ চাপ, বরফশীতল মস্তিষ্কে আকবর দলকে নিয়ে গেছেন লক্ষ্যে। শুধু খেলা দিয়ে নয়, আকবর যে কতটা পরিণত সেই প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন কথায়ও। ম্যাচ শেষে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই দলের যাত্রা কেবল শুরু। মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে তুলনাকে বাড়াবাড়ি বলেছেন, আবার ম্যাচ শেষে সতীর্থদের উদযাপনের আতিশায্যের জন্য পরে ক্ষমাও চেয়েছেন সবার কাছে। একজন সত্যিকারের নেতার মতো দলকে শিরোপা জিতিয়েই চলে গেছেন পেছনে, ট্রফিজয়ের ছবিতেও আকবরকে খুঁজে পাওয়া যাবে একদম এক পাশে। চার মেরে উদযাপন করে ফেলার জন্য আবার রকিবুলকে বকুনি দিয়েছেন, মনে করিয়ে দিয়েছেন খেলা তখনো শেষ হয়ে যায়নি। যখন মারার দরকার , তখন মেরেছেন। আবার ম্যাচের পরিস্থিতি যখন বেগতিক, বিন্দুমাত্র ঝুঁকি না নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে পার করে দিয়েছেন সময়। এই ছেলেকে তো আপনি বাংলাদেশের কারও সঙ্গে ঠিক মেলাতে পারবেন না। এই বয়সেই এতোটা পরিণতিবোধ বাংলাদেশের ১৯ না পেরুনো একজন ছেলের মধ্যে আসে কীভাবে?
এই দলের সবচেয়ে জুনিয়রদের একজন প্রান্তিক নওরোজ নাবিলের কথাই ধরুন। বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়নি, কিন্তু কথা বলেই ফেলে দিয়েছেন তোলপাড়। সাবলীল ইংরেজির জন্য না যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের ক্রিকেটীয় ভাবনা আর পরিণতমনস্কতার জন্য। একজন ১৬ বছর বয়সী ছেলে যখন বলে, ‘দেশের হয়ে কিছু করার আগে কেউ যদি ভেবে থাকে তারকা হবে, আমি মনে করি সে বেশি দূর যেতে পারবে না’- কোনোভাবেই তো আসলে বিশ্বাস হতে চায় না। সেই ছেলেই ক্যামেরার সামনে হয়ে যায় দোভাষী, সিনিয়রদের কথার তর্জমা করে দেয় পুরো বিশ্বের সামনে। ১৬ বছর বয়সী একজন ছেলের এতো আত্মবিশ্বাস আসে কোত্থেকে?
পারভেজ হোসেন ইমনের চেহারায় কৈশোরের গন্ধ এখনও তীব্রভাবে লেগে আছে। এই ইমনই চোটের জন্য একবার মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন। ফাইনালে দলের প্রয়োজনে আবার ফিরলেন চোট পেয়ে, কিন্তু ইমন দেখালেন কী ধাতে গড়া। দৌড়ানো দূরে থাক, ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না- এমন অবস্থায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে রান নিচ্ছিলেন। চোট নিয়ে তো কত ক্রিকেটারই খেলে, কিন্তু ইমনের মতো এমন উত্তুঙ্গু নিবেদন আছে কজনের? বিশেষ করে নিজের সঙ্গীন অবস্থায় এমন মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলতে জাতীয় দলের কজনই বা পারবেন? শুধু ইমন কেন, শামীম হোসেনও পুরো টুর্নামেন্টে খেলছেন পেশীর চোট নিয়ে। দলে তার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, ব্যাট বা বলে। কিন্তু এই চোট সামলেও দলে তার নিবেদন প্রশ্ন তোলে- এতোটা মনের জোরের উৎস কী?
একেকজন করে গল্প লিখলে আসলে মহাকাব্যই হয়ে যাবে। এই দলের প্রত্যেকের যেন নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড আছে, সবার খেলায় পরিষ্কার দলে নিজের ভূমিকা। দশে মিলে কাজ করার এই সাক্ষ্য তো দিচ্ছে পরিসংখ্যানই। টুর্নামেন্ট শেষে দেখা যাচ্ছে, রানের দিক দিয়ে টুর্নামেন্টের প্রথম ১৪ জনের মধ্যে বাংলাদেশের কেউ নেই। এরপর আছেন মাহমুদুল হাসান জয়, তার একটু পর তানজিদ হাসান তামিম, শাহাদাত হোসেন, ইমনরা। অথচ পুরো টুর্নামেন্ট ফ্লপ গেছে, এরকম একজন ব্যাটসম্যানও নেই। আকবর শুরুতে সুযোগ না পেলেও আসল মঞ্চে গিয়ে নিজের কাজটা করে দিয়েছেন। এমনকি লিস্ট এ তে কখনো ১ রানের বেশি রান না করা রাকিবুলও জানতেন তার ভূমিকা। বল হাতে শীর্ষ পাঁচে বাংলাদেশের কেউ নেই, এরপর রাকিবুল। তবে সব বোলারই কমবেশি ব্রেকথ্রু এনে দিয়েছেন। শরিফুল বা সাকিবের বল হাতে অবদান আসলে ঠিক উইকেট দিয়ে বোঝা যাবে না। এই দলের যার কাজটা যখন এসেছে, কমবেশি সবাই দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার কেউ ব্যর্থ হলে পরের জন সেটি পুষিয়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছিল প্ল্যান বি শুধু না, সি আর ডিও মাথায় ছিল আকবরদের। পরিস্থিতি যেরকমই হোক, সবসময় বিকল্প একটা ভাবনা ছিল তাদের।
দল হিসেবে এরকম পারফরম্যান্সও ফ্লুক নয় কোনোভাবেই। প্রান্তিক যেমন বলছিলেন, এই দলে তারকা বলে কেউ নেই। কাল ম্যাচ শেষে আকবরও বলছিলেন একই কথা, দল হিসেবে দীর্ঘদিন খেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। সেই অনূর্ধ্ব ১৭ থেকে একসঙ্গে খেলছেন এই দলের অনেকে। তবে গত দুই বছরে দলটির পেছনে প্রচুর বিনিয়োগও করেছে বোর্ড। এই সময়ের মধ্যে ৩০টি যুব ওয়ানডে খেলেছে দলটি। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড থেকে অনেক জায়গায় খেলে এসেছে, প্রমাণ করেছে দেশের চেয়ে বিদেশের মাটিতে বরং রেকর্ড বেশি ভালো। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার সেই ছাপ দেখা দিয়েছে ফিল্ডিংয়ে, আগ্রাসী শরীরী ভাষার সাথে দুর্দান্ত ফিল্ডিং দিয়েই প্রতিপক্ষের ওপর তৈরি হয়েছে অন্তহীন চাপ। এই বিশ্বকাপকে নিয়ে অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা করেছে বোর্ড, শ্রীলংকার কোচ নাভিদ নেওয়াজকে দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছে বছর দুয়েক আগে। সবার আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। পুরো দলের কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে সবাই তাই দারুণ এককাট্টা। ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে তাই বয়সে অর্ধেকেরও বেশ ছোট ছেলেদের সঙ্গে নাচে মেতেন ওঠেন ফিল্ডিং কোচ ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স। ভিনদেশী ফিটনেস কোচ রিচার্ড স্টনিয়ের যেমন ডাগআউট থেকে বাংলায় বলে ওঠেন, ‘শেষ করে আসো’। কিন্তু এই দলের এভাবে একটু একটু করে গড়ে ওঠা, তাদের পেছনে বিনিয়োগ- সবকিছুই বাংলাদেশের বাস্তবতায় আসলে অতিলৌকিক কিছু মনে হয়। লম্বা সময় ধরে কোনো কিছু নিয়ে লেগে থাকলে যে ফল পাওয়া যায়, এই দলটা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।
তবে এই দলের আসল পরীক্ষা শুরু হবে এখন। বয়সভিত্তিক দলের লাল গালিচা ছেড়ে এবার পা রাখতে হবে পেশাদার ক্রিকেটের রূক্ষ রাজপথে। সেখানে পা কেটে গেলে কেউ ফিরে তাকাবে না, সেখানে পিছিয়ে পড়লে অন্য কেউ জায়গা নিয়ে নেবে। আকবরদের রাতারাতি খ্যাতি জুটে গেছে, সামনে আছে অর্থ আর প্রাপ্তির অনেক প্রলোভন। তবে এই খ্যাতিটা তারা কীভাবে সামাল দিতে পারবেন, সামনের গল্পটা তাতেই লেখা হয়ে যাবে। বয়সভিত্তিক দলে দারুণ করে একদম ঝরে পড়ার বিস্তর উদাহরণ শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য সব দলেও আছে। বরং গড় হিসেব করলে প্রতি দল থেকে দু-তিন জনের বেশির সুযোগ হয় না জাতীয় দলের হয়ে খেলার। এই দলের অনেকেরই সামর্থ্য আছে সর্বোচ্চ চূড়ায় যাওয়ার, কিন্তু খ্যাতির মোহে মাথা ঘুরে না গিয়ে কতটা স্থির থাকতে পারবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।
আকবররা নিশ্চয় জানেন, আসল খেলা শুরু হচ্ছে এখন।