মুশফিকদের নিলাম এবং কিছু দেউলিয়াত্বের গল্প
কান টানলেই মাথা আসার মতো "নিলাম" শব্দটা শুনলেই অবচেতন ভাবে "দেউলিয়া" শব্দটাও চলে আসে চোখের সামনে। ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে না পারলে বন্ধকী সম্পত্তি কব্জা করে নেয় ব্যাংক আর সেটাই নিলামে বিক্রি করা হয়, একটা সময় নিলাম ডাকের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে জানতাম এতটুকুই। এরপর আইপিএল বিপিএল এসে তো নিলামের চেহারাই পালটে দিল। এখন খোলা বাজারে ক্রীতদাস কেনাবেচার মত করে খেলোয়াড় কেনাবেচা হয়, এটাই সভ্যতা। তবে মুশফিকুর রহিমের ব্যাট নিলাম করা নিয়ে যে কাণ্ড হল, তাতে করে করে নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে ভরসা পাচ্ছি না।
ক্রিকেটপ্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেমের আরক মিশিয়ে পান করে বুঁদ হয়ে থাকা একটা বিশাল জনগোষ্ঠী যে মানসিকভাবে কতটা দেউলিয়া তার প্রমাণ আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরদম পাচ্ছি। কিন্তু স্রেফ খেলার ছলে একটা মহৎ উদ্যোগ বানচাল করে দেয়ার মত হীনমন্যতার উদাহরণ বোধহয় কমই দেখা গেছে। মহামারী টিকায় শরীরের অসুখ হয়তো সারবে, কিন্তু মননের অসুখ সারাবার যে কোন দাওয়াই নেই।ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশের কীর্তিগাঁথার সংখ্যা কম, সেসবের স্মারকের সংখ্যাও কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তাই মুশফিকুর রহিম যখন তার প্রথম দ্বিশতকের ইনিংস খেলা ব্যাটটা করোনা আক্রান্তদের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিলামে বিক্রির ইচ্ছাপোষণ করেন, তখন ম্যাচজেতানো ইনিংস খেলার মতই করতালি আর অভিবাদন পেয়েছেন। কিন্তু মুশফিক জানতেন না, মাঠে প্রতিপক্ষ দৃশ্যমান এগার জন হলেও এখানে শত্রু অদৃশ্য এবং অগুণতি। পিকাবু ডট কম নামের যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ব্যাটটি বিক্রির চেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের প্রধান নির্বাহির কাছ থেকেই শুনেছি কিভাবে তাদের ওয়েবসাইটে অনুপ্রবেশ করে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ব্যাটের দাম। নামে, বেনামে একের পর এক দর হাঁকিয়ে দামটা মগডালে উঠিয়ে মই কেড়ে নেয়ার মত করেই তারা হাওয়া হয়ে গেছেন। এমনই অরুচিকর তাদের কীর্তি যে দর হাঁকাতে ব্যবহার করা হয়েছে নীল ছবির অভিনেত্রীর নাম!
মহৎ উদ্যোগের অমন পরিণতি দেখে পিছিয়ে গেছেন মোহাম্মদ আশরাফুলও। ২০১৩ সালে গলে সেদিন মুশফিকের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। মুশফিকের আগেই, প্রথম দ্বিশতকের গৌরব অর্জনের খুব কাছে গিয়েও ১৯০ রান করে যেভাবে আউট হয়েছেন তাতে বিস্তর সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, তবে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটায় যে শতরানের ইনিংসটা খেলেছিলেন সেটা নিয়ে ঘোরতর নিন্দুকের মুখেও প্রশংসা ফুটবে। সেই জয়ের স্মারক ব্যাটটাও নিলামে তুলতে চেয়েছেন আশরাফুল, কে জানে ঘরপোড়া গরু বলেই হয়তো সিঁদুরে মেঘ দেখে পিছিয়ে এসেছেন।
প্রথম দ্বিশতকের ইনিংস খেলা ব্যাটটা করোনা আক্রান্তদের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিলামে তুলেছিলেন মুশফিক/ক্রিকইনফো
অনেক জলঘোলা হওয়ার পর অবশেষে জানা গেছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম মূল্যবান স্মারকটি কিনে নিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদি। নিজ নামের ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ১৭ লাখ টাকায় ব্যাটটি কিনে আসলে বাংলাদেশের মানুষের জন্যই এই টাকাটা খরচ করলেন পাকিস্তানের এই ক্রিকেটার, যে দেশের নাম উচ্চারণ করলে অনেকে নাকি ঘৃণায় কুলি করেন।
ফেসবুক লাইভে আসা আড্ডায় বন্ধু তামিম ইকবালকে মুশফিক বলেছিলেন ব্যাটটা কিনে নিতে। তামিমও বলেছিলেন, সাধ্যের মধ্যে থাকলে কিনবেন। কিন্তু প্রতারক ক্রেতাদের কুকীর্তি দাম যে চলে যায় সীমানার অনেক বাইরে। বন্ধুর জন্য তামিম এমন একজনকে খুঁজে বের করেন, অনায়াসে সীমানা ছাড়িয়ে বল পাঠানোর জন্যই যার সুনাম।
মুশফিকের কাছ থেকেই জানা গেছে, শুরুতে ব্যাটটা কিনতে আগ্রহী হয়ে যোগাযোগ করার পর প্রতারক ক্রেতাদের অপতৎপরতায় চড়ে যাওয়া দাম দেখে পিছিয়ে গিয়েছিলেন শহীদ আফ্রিদি। পরে তামিম এগিয়ে আসেন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন মুশফিক। সেই সঙ্গে ধিক্কার জানিয়েছেন সেই সব মানুষদের, যাদের অপ তৎপরতায় বিঘ্নিত হতে চলেছিল একটি মহৎ উদ্যোগ।
ভাবনায় মুশফিক এগিয়ে থাকলেও তৎপরতায় এগিয়ে সাকিব আল হাসানই। মুশফিক যেখানে একটি ব্যাট বিক্রি করতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়েছেন, সেখানে তার চেয়েও কম সময়ে সাকিব আল হাসান বিক্রি করে ফেলেছেন দুটো ব্যাট। যে সংগঠনটির সঙ্গে সাকিব একাত্ম হয়ে তার ২০১৯ বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো খেলা ব্যাটটি নিলামে বিক্রি করেছেন, সেই “অকশন ফর অ্যাকশন” এর মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে তাসকিন আহমেদের হ্যাটট্রিক করা বল, সৌম্য সরকারের নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪ বলে শতরানের ইনিংস খেলার ব্যাট সহ তারকাজগতের আরও অনেকের রকমারী পণ্য।
করোনার কালে, নিলামের এই স্রোতে ভেসে আসছে অনেক কিছুই। পালটে যাচ্ছে অনেক হিসেব। মোনেম মুন্নার ভক্তকূল শুধু বাংলাদেশের মানচিত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, ওপার বাংলাতেও এখনো ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা মুন্নাকে মনে রেখেছে। তার আবাহনীর জার্সির দাম পাওয়া গেছে মাত্র ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। অন্যদিকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল পরিচালনা করা “রেফারির জার্সি” বিকিয়েছে ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকায়! ক্রেতা ছিলেন একজনই, তাই দর নিয়ে দরাদরিও হয়নি। এই মহৎ উদ্যোগের জন্য ফিফার মহাসচিব জিয়ানি ইনফান্তিনো প্রশংসা করেছেন রেফারি তৈয়ব হাসানের। এসব দেখে একজন কাবাডি রেফারিও নাকি তার জার্সি নিলামে তুলতে চাইছেন। ক্রীড়াঙ্গণের সঙ্গে জড়িত একজনের কাছে শুনেছি, তার কাছে নাকি পাড়া মহল্লার টুর্নামেন্টে জেতা ট্রফিও নিলামে তুলে বিক্রি করে দেয়ার আবদার আসছে!
মুশফিকের কাছ থেকেই জানা গেছে, শুরুতে ব্যাটটা কিনতে আগ্রহী হয়ে যোগাযোগ করার পর প্রতারক ক্রেতাদের অপতৎপরতায় চড়ে যাওয়া দাম দেখে পিছিয়ে গিয়েছিলেন শহীদ আফ্রিদি।/ফেসবুক/ মুশফিকুর রহিম
কিছুদিন আগেই আইসিসি ক্রিকেটারদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক হবার পরামর্শ দিয়েছে। ম্যাচ গড়াপেটার পর স্পট ফিক্সিংয়ের এই যুগে টাকা লেনদেনের সহজ অথচ সন্দেহাতীত মাধ্যম হতে পারে এই সব নিলাম। আকাশছোঁয়া দামে আপাত মূল্যহীন কোন কিছু কেউ যদি কিনে নেয় নিলামের মাধ্যমে, তাকে পাগল ঠাউরাবেন নাকি সেয়ানা সেটা পরে তবে সুযোগটা থেকেই যাচ্ছে। বাজিকররা তো এভাবেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে খেলোয়াড়দের।
মহামারীর এই সময়ে তাই কেউ নিলামে কুড়োচ্ছেন সুনাম, কেউ বা দূর্নাম, কেউ শুধুই নাম। হারিয়ে যাওয়া অনেক তারাই নিলামে তুলতে চাইছেন কোন একটা কিছু, আর সেই ইচ্ছের ঘোষণাতেই ভরে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রশংসা ডালি। অলক্ষ্যে ওঁত পেতে আছে শিকারী।
মানসিক দেউলিয়াপনা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে আসছি। এমনিতেই উগ্র সমর্থক হিসেবে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম থেকে সুনীল গাভাসকার, কাউকেই কটাক্ষ করতে আমরা ছাড়ি না। রড টাকার, নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন যদি তাদের প্রতি বর্ষিত অভিশাপগুলো শুনতেন, তাহলে কেন জন্মেছেন সেই আক্ষেপ করতেন। মাঠের ক্রিকেট কীর্তির স্মারক নিলামে বিক্রি করতে গিয়ে দেশের শিক্ষিত (ইন্টারনেট যখন ব্যবহার করছেন তখন তো শিক্ষিত, আর হ্যাকিং জানেন মানে তো রীতিমত পন্ডিত!) মানুষের যে কীর্তির দেখা পেয়েছেন মুশফিক, তাতে আশা করা যায় আর যাই হোক জীবনে আর কোন ক্রিকেটস্মারক নিলাম করে তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াবেন না।
আর কিনলেন এমন একজন, যার দেশকে কি না বারবার ব্যর্থ রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়। ব্যর্থতাটা কোথায়, এই মহামারী আসলে সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।