• রিও অলিম্পিক ২০১৬
  • " />

     

    মাইকেল ফেলপসের দেহঘড়ির রহস্য

    মাইকেল ফেলপসের দেহঘড়ির রহস্য    

    সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান বললে আপনার মাথায় চট করে কার নাম আসবে? ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে উসাইন বোল্টের নামটা বলতে পারেন আপনি, হয়তো ভাবতে পারেন কার্ল লুইস বা অন্য কারও কথা। তবে অর্জনের হিসেবে মাইকেল ফেলপস এর মধ্যেই সর্বকালের সেরা সাঁতারুই শুধু নন, সেরা অলিম্পিয়ানও বটে। তবে যে প্রশ্নটা প্রায়ই ওঠে, মাইকেল ফেলপস কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা? অলিম্পিকের সুইমিং পুলের নীল জলে তোলপাড় তো এখন পর্যন্ত কম সাঁতারু তোলেননি, কিন্তু তাঁদের কেউ কেন ফেলপসের মতো এত বিখ্যাত হননি? বা আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে অন্যদের সাথে ফেলপসের পার্থক্যটা আসলে ঠিক কোথায়?

    ফেলপসের যে ব্যাপারটা সবচেয়ে অবাক করা মতো, সেটি তার ক্যারিয়ারের দীর্ঘায়ু। গড়ে একজন পুরুষ সাঁতারু ফর্মের চূড়ায় উঠেন ২৪ বছর বয়সে, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা ২২। এরপর অনেকেই আর শীর্ষ পর্যায়ে নিজেদের ধরে রাখতে পারেন না। ফেলপস ৩০ পার হয়েও ঝড় তুলেছেন পুলে, জিতেছেন অলিম্পিকে সোনা। বেইজিং অলিম্পিকে যখন ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন ফেলপস, তখন তার বয়স ছিল ২৩। স্বাভাবিকভাবেই ২০১৬ অলিম্পিকে এসে সেই ফর্ম ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু এরপরও ত্রিশ পেরিয়ে তার অর্জনটা সাঁতারুদের মানদণ্ডে অসাধারণই। সেটার একটা কারণ প্রতিদিন ছয় ঘন্টা তার নিবিড় অনুশীলন। তবে বড় একটা কারণ সম্ভবত তার শারীরিক গড়ন।



    শারীরিকভাবে কয়েকটা ব্যাপার ফেলপসকে ভালোমতোই আলাদা করেছে বাকিদের চেয়ে। ভালো সাঁতারুদের ক্ষেত্রে সাধারণত দুইটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ধড়ের দৈর্ঘ্য বেশি হতে হবে, কিন্তু পায়ের আকার হতে হবে ছোট। ধড় বড় হওয়া মানে আপনার উচ্চতা বেশি হওয়া, ফলে স্বাভাবিকভাবেই খর্বাকৃতির একজনের চেয়ে সাঁতরাতে আপনার সময় কম লাগবে। ফেলপসের উচ্চতার অনুপাতে তার ধড় অন্তত চার ইঞ্চি বড়। আর পা ছোট হলে সাঁতরানোর সময় বলের পরিমাণ একটু হলেও কম হয়, যেটার কারণে সাঁতার হয় দ্রুত। 

    এই উচ্চতাও ফেলপসের সাঁতারে বড় একটা ভূমিকা রেখেছে। সাধারণত দুই হাত প্রসারিত করলে এক আঙুল থেকে অন্য আঙুলের যে দৈর্ঘ্য হয় সেটা মানুষের উচ্চতার সমান হয়। ফেলপসের উচ্চতা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি হলেও তার এক বাহু থেকে অন্য বাহুর দৈর্ঘ্য ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি। স্বাভাবিকভাবেই জলে সেটা বাড়তি একটা সুবিধা দেয় তাকে। এই অপ্রতিসাম্যের দারুণ সুযোগ নিয়েছিলেন ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে। ১০০ মিটার বাটারফ্লাইতে সেবার সার্বিয়ার মিলোরাদ কাভিক সোনা প্রায় জিতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ আধ স্ট্রোকে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফেলপস সোনা জেতেন। শুধু সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ব্যবধানে আঙুলটা আগে ছুঁইয়ে ফেলার জন্য ফেলপসের হাতে উঠে যায় সোনা। সেটা সম্ভব হয়েছে তার এই দৈহিক অপ্রতিসাম্যের জন্যই।

    এমনিতে অনেক ইভেন্টে অংশ নিলেও বাটারফ্লাই তাই বেশি প্রিয়। সেখানে তাকে বাড়তি সুবিধা দেয় ফেলপসের দৈহিক গড়ন। বাটারফ্লাইয়ের জন্য ডলফিন কিক খুব জরুরি। এই আর এই ধরনের কিকের ৯০ ভাগ ধাক্কাটা আসে দুই গোড়ালি আর পা থেকে। ফেলপসের গোড়ালির ধরনটা এমন, সেগুলোর জন্য পা জোড়া পানিতে অনেকটা ফ্লিপারের মতো কাজ করে। সেজন্য পানি কেটে বেশি সাঁতরানো সম্ভব হয়।  গোড়ালির আকৃতির জন্য সেটি ১৫ ডিগ্রি কোণ করে থাকে। সেজন্যও বাড়তি গতি পান ফেলপস। আবার হাঁটু আর কনুই বেশি বর্ধিত বলে পানিতে তার গতি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বেশি দ্রুত।

    এ তো গেল আকৃতির কথা। শারীরবৃত্তীয় দিক দিয়েও ফেলপস অন্য সাঁতারুদের চেয়ে একটু আলাদা বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। মানুষ যখন কায়িক পরিশ্রম করে তখন শরীর থেকে ল্যাকটিক এসিড উৎপাদিত হয়। এই ল্যাকটিক এসিডের জন্য মানুষ টানা পরিশ্রম করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে,  তখন তার বিশ্রাম নেওয়ার দরকার হয়। মাংসপেশীর সংকোচন স্লথ হয়ে যায় এই এসিডের জন্যই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ফেলপসের দেহে যে ল্যাকটিক এসিড উৎপাদিত হয় সেটা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। সেজন্য কম পরিশ্রমে বেশি সময় ধরে সাঁতরাতে পারেন তিনি। সেই সঙ্গে বিশ্রামের সময়টাও কম দরকার হয়, ক্লান্তিও অন্যদের মতো চট করে আসে না।


     

    তবে শরীরের সঙ্গে আরেকটা জায়গায় ফেলপস বাকিদের চেয়ে এগিয়ে। সেটা হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। কীভাবে নিজের শক্তিটা সুইমিংপুলে কাজে লাগানো যায়, সেটা ফেলপসের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। মানুষ জলজ প্রাণি নয়, পানিতে নামলে মাথা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু কম কাজ করতেই পারে। কিন্তু ফেলপস জলচর প্রাণীর মতো পানিতে শারীরিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবেও আরও বেশি স্বচ্ছন্দ থাকেন। এই ব্যাপারটা তাকে এগিয়ে রেখেছে বাকি সবার চেয়ে। আর সঙ্গে তো নিজের পরিশ্রম আছেই। ফেলপস একবার বলেছিলেন, ‘প্রথম যখন কোচের সঙ্গে অনুশীলন শুরু করি তখন তিনি বলেছিলেন কোনোভাবেই না শব্দটা বলা যাবে না। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে তোমার সীমানা আসলে কতদূর।’ তখন থেকে শিক্ষাটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল ফেলপসের। সপ্তাহের সাতদিন ঘন্টার পর ঘন্টা নিয়ম করে পুলে অনুশীলন করা- ফেলপস আসলে ফেলপস হয়েছেন এসবের জন্যই। নিজের প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা যেটুকু আছে, সেটা আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন কঠিন পরিশ্রমে।

    সেই পরিশ্রমের সঙ্গে বড় ভূমিকা আছে তার ডায়েটেরও। সাধারণ মানুষের চেয়ে সাঁতারুদের বাড়তি ক্যালোরির দরকার হয়। ফেলপস যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন, সেটার জন্য তাকে প্রতিদিন ১২ হাজার ক্যালোরি নিতে হয়। যেটা একজন সাধারণ মানুষের প্রায় ছয়গুন। সকাল পাঁচটায় ঘুম ভাঙার পর তার নাস্তায় থাকে তিনটি ডিম, পনির, টমেটো, লেটুস, মেয়োনেজ ও মাখনসহ বড় একটা স্যান্ডউইচ। এরপর পাঁচটি ডিমের ওমলেট, আস্ত এক বাটি পনিরের এক ধরনের খাবার , বড় তিন স্লাইস ফ্রেঞ্চ টোস্ট, তিন স্লাইস প্যানকেক ও দুই কাফ কফি। দুপুর গড়ানোর পর ফেলপস খান হাফ কেজি বিভিন্ন উপাদানযুক্ত পাস্তা, দুইটি বড় হ্যাম ও চিজ স্যান্ডউইচ এবং প্রায় এক হাজার ক্যালোরির এনার্জি ড্রিঙ্কই। আর রাতে খান হাফ কেজি পাস্তা, একটা গোটা পিৎজা ও এনার্জি ড্রিংক। এই পরিমাণ খাবারের সমান পরিশ্রমও করেন অনুশীলনে, যে কারণে তার শরীরে মেদ জমতে পারে না।

    সব মিলে শুধু অনন্য দেহঘড়ি নয়, পরিশ্রম- মনের জোর আর হার মানতে না শেখা- সব মিলেই অতিমানবীয় মাইকেল ফেলপস।