• আইসিসি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬
  • " />

     

    এশিয়ার পর এবার বিশ্বমঞ্চ?

    এশিয়ার পর এবার বিশ্বমঞ্চ?    

    ২০১৪ থেকে ২০১৬, মহাকালের হিসাবে যত ক্ষুদ্রই হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এই দুবছর বিস্মৃতির অতীত থেকে ঝলমলে বর্তমানে আসার ইতিহাস হিসেবেই মানুষ মনে রাখবে। তখনও মার্চ মাস, চার-ছক্কা হইহইয়ের সাথে বাংলাদেশে এসেছিল টি-টোয়েন্টির পঞ্চম বৈশ্বিক আসর। মাঠের খেলার আগেই দেশের রাস্তাঘাটে, আনাচে কানাচে ফ্ল্যাশমবের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। তবে মাঠের খেলায়? ঐ বিশ্বকাপে সাতটি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ; এর মধ্যে তিনটি আবার বাছাইপর্বে! জিতেছিল মাত্র দুটিতে, বরণ করতে হয়েছিল হংকং এর মতো দলের কাছে পরাজয়!

     

    মূলপর্বেও বিশাল বিশাল পরাজয়ের ধাক্কা- বাংলাদেশ তখন অচেনা এক ঘুড়ি, উড়তে উড়তে যেন সে অন্য আকাশে চলে এসেছে! টি-টোয়েন্টির ব্যাকরণটাই যে তখন বোঝা হয়ে উঠে নি। শুধু ঐ বিশ্বকাপটাই বা কেন, এর ঠিক আগেই শ্রীলঙ্কার সাথে খেলা দুটি টি-টোয়েন্টিতে ভাল খেলতে খেলতে হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলার সেই চিরন্তন গল্প। ক্রিকেটের এই ছোট সংস্করণে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে সম্মান হারিয়েছে, হেরেছে স্কটল্যান্ড-নেদারল্যান্ডের কাছে, নামতে নামতে চলে গেছে র‍্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে। সে যাই হোক, ওগুলা তো অন্য যুগের গল্প! আজ ২০১৬ সালে যে বাংলাদেশ দল ধর্মশালায় পা রাখল, তা শুধু নামেই এক; ২০১৪ সালের সাথে আর কোনভাবেই এর তুলনা যে দেয়া যাচ্ছে না।

    ইতিহাসকে বিপক্ষে নিয়ে বাংলাদেশ এবার টি-টোয়েন্টির বিশ্বমঞ্চে নামছে ঠিক আছে, কিন্তু প্রাপ্তির হালখাতায় এখন আর শুধু শূন্যের আঁকিবুঁকি নেই, সেখানে রঙের ছোপ যেমন আছে তেমনি আছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত আত্মবিশ্বাস। সাব্বির-মাহমুদউল্লাহর ব্যাটের বাড়িতে সীমানাছাড়া হওয়া চার-ছয়ের মত সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জ্বালানিও তো অফুরন্ত, আলআমিন-তাসকিনের হাত থেকে বের হওয়া বারুদও তো তাই! ২০১৫ যদি বাংলাদেশের রূপবদলের বছর হয় তবে ২০১৬ এশিয়া কাপ হবে সেই রূপবদলকে ক্রিকেটের সব সংস্করণে চিরস্থায়ী রূপ দেয়ার আসর!

    চাইলেই তাই পারা যাচ্ছে না এশিয়া কাপকে দূরে সরিয়ে রাখতে। ভারতের কাছে দুটি ম্যাচ হারতে হয়েছে তো হোক না, প্রাপ্তির ভাঁড়ারে তো তাতে এতটুকু কমতি পড়ছে না। সামনের ম্যাচগুলোর জন্যে নিশ্চিতভাবে সেটাই রসদ হিসেবে কাজ করবে।

    ধর্মশালায় সেই রসদটা হয়ত সাব্বির রহমানই  সবচেয়ে বেশি নিয়ে যাচ্ছেন। টি-টোয়েন্টি অভিষেকটা গত বিশ্ব টি-টোয়েন্টির ঠিক আগে আগে। মোটেও সুখকর নয় সেই ইনিংসটা, ৩৬ বলে করেছিলেন ২৬ রান। অবশ্য ৪৭ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাবার পর এটাই যে করেছিলেন সেটাই বা কম কিসে? শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন তিনি, দলকেও এনে দেন ১২০ রানের সম্মানজনক স্কোর! এরপর বিশ্ব টি-টোয়েন্টিতে বাকিসব ব্যাটসম্যানদের মত তিনিও নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। গতবারের অখ্যাত সেই তরুণটাই ৯ মার্চ মাঠে নামবেন তারকা হয়ে। এই বছরটা যখন শুরু করেছিলেন তখন টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিয়ার গড় ছিল ২০ এর ঘরে, ত্রিশ পেরুনো স্কোরই ছিল মাত্র একটি, টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞ তকমাটা কি নিষ্ঠুরভাবেই না সাব্বিরকে উপহাস করছিল। সেই তিনিই এ বছর ৯ ম্যাচে করেছেন ৩১৬ রান, ব্যাটিং গড় নিয়ে গেছেন ৩২ এর উপরে। ৯ ম্যাচের ছয়টিতেই ত্রিশ পেরুনো স্কোর, অপরাজিত ছিলেন দুইবার, স্ট্রাইক রেটকে নিয়ে গেছেন ১২০ এর কাছাকাছি! এশিয়া কাপের সর্বোচ্চ রান তাঁর, বাঘা বাঘা সব খেলোয়াড়দের টপকে হয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরা। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বাদে এমন ঘটনা কেবল সাকিব আল হাসানই একবার করে দেখিয়েছিলেন- সেটাও ২০১২ সালে, গৌরবোজ্জ্বল-বিষাদের সেই এশিয়া কাপে।

    টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মাহমুদউল্লাহকে কেন নেয়া হয় এই প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই ছিল। ২০১৫ বিশ্বকাপের নায়ক বলে এই এশিয়া কাপে হয়তো দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি, কিন্তু তাতে কি আর পরিসংখ্যান মিথ্যা হয়ে যায়? এই এশিয়া কাপের আগে তাঁর টি-টোয়েন্টি গড় ছিল মাত্র ১৫; ৪১ ম্যাচে কেবল ১৩ বার ছুঁয়েছেন দুই অঙ্ক! সাব্বির হয়তো ছয় থেকে তিনে এসে তাঁর সক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন, কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারে মাহমুদউল্লাহর তো কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবুও তিনি জাত চেনালেন নিজের, এই এশিয়া কাপে কেবল প্রথম ম্যাচটাতেই রান পাননি, বাদ বাকি চার ম্যাচে তাঁকে কেউ আউটই করতে পারেননি। ফলাফল হচ্ছে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং গড়- ১২১! প্রতি ম্যাচেই খেলেছেন দলের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ক্যামিও, পাকিস্তানের সাথে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনিই হয়েছেন নায়ক! ফাইনালে অমন তান্ডবলীলা না চালালে হয়তো বাংলাদেশের স্কোর একশই পার হত না।

    তবে সব ছাপিয়ে এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রাপ্তি আলআমিন হোসেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন শৃঙ্খলাজনিত কারণে। নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও পেতে হয়েছে শাস্তি। সেই ক্ষোভেই কিনা; বিপিএল থেকে বল হাতে ক্রমাগত আগুন ঝরাচ্ছেন। রুবেলের চোট আর শফিউলের ফর্মহীনতায় ফিরেছেন জাতীয় দলেও। এশিয়া কাপের শুরু থেকেই চারদিকে মুস্তাফিজ রব উঠেছে, তাসকিন-মাশরাফির কাছে অন্তহীন প্রত্যাশার ফানুস পাঠানো চলেছে- কিন্তু তাঁর নামটা কেউ উচ্চারণও করেনি। হয়তো এই ব্যাপারটাই আরো তাতিয়েছে তাঁকে, ৫ ম্যাচ খেলে প্রতিটিতেই নিয়েছেন উইকেট, তাও একেবারে গুরুত্বপূর্ণ সব মুহুর্তে। হয়েছেন সর্বাধিক উইকেট শিকারি। বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্রিকেটের এই সংস্করণে তাঁর চেয়ে বেশি ‘তিন উইকেট শিকার’ আছে কেবল সাকিবের, পাঁচবার ‘তিন উইকেট শিকার’ নিয়ে আলআমিন কেবল একটি সংখ্যাই পিছনে আছেন।

    খেলোয়াড় ধরে হয়তো প্রাপ্তির খেরোখাতায় এতটুকুই যোগ করা যায়, কিন্তু আসল অর্জন তো একটি ‘দল’ হয়ে খেলার মধ্যে। দেখুন না ব্যাপারটা, বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট নায়কদের নাম বলতে হচ্ছে- কিন্তু সাকিব, তামিম, মুশফিকের নামই সেখানে আসছে না। আসছে না হালের সেনসেশান সৌম্য কিংবা মুস্তাফিজের নামও। একজনের কাঁধ থেকে দলের ব্যাটনের ভারটা সবার কাঁধে ছড়িয়ে দেয়া, এই এশিয়া কাপে বাংলাদশের মূল সাফল্য আসলে এটাই। সাকিব-মুশফিকের ব্যর্থতা একারণেই তেমন মোটা দাগে চোখে পড়ছে না!

    কাল বাদে পরশুই বাংলাদেশ আবার মাঠে নামছে। ভারতে খেলার সুযোগ বাংলাদেশের কদাচিৎ হয়। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ তো এখনো একবারও হয়নি। ২০০৬ সালের পর এটাই বাংলাদেশ জাতীয় দলের ভারতে পদার্পণ! আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ঐ দলের মাত্র দুইজন এবার দলে আছেন- সাকিব এবং মাশরাফি। প্রতিবেশি দেশটা নিশ্চিতভাবেই এই দলের খেলোয়ারদের আনকোরা ঠেকবে। ধর্মশালার নতুন মাঠ, অচেনা কন্ডিশন। বাংলাদেশের ৩০ এর উপর তাপমাত্রা থেকে গিয়ে মাত্র একদিনের ব্যবধানে খেলতে হবে ১০ ডিগ্রির হিমে! নতুন টুর্নামেন্টে শূন্য থেকে শুরু করার ক্লিশে উক্তিটা এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই মিলে যায়।

    ২০১৪ সালের বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ গিয়েছিল আগের দশ ম্যাচে মাত্র একটি জয়ের স্মৃতি নিয়ে। সে তুলনায় এবার শেষ ১১ ম্যাচে ছয় জয়- এর মধ্যে আছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানকে টানা দুম্যাচে হারানোর টাটকা স্মৃতি! ফাইনালে হারের কষ্ট থাকছে থাকুক, নতুন করে শুরুর ব্যাপারটা কেবল এই ফাইনালের স্মৃতির জন্যই হোক। সাব্বির-আলআমিনরা তাঁদের পারফরম্যান্সের ধারা এই আসরেও টেনে নিয়ে যান, সাথে জ্বলে উঠুন সাকিব-তামিম-মুশফিকরা! দলের স্তম্ভদের ব্যর্থতার পরও এশিয়া কাপের রানার্সআপ, সবাই একসাথে জ্বলে উঠলে নিশ্চিতভাবেই ২০১৪ সালের দুঃখ এই ২০১৬ তে এসে ঘুচবে। সাথে চুকাবে অনেক হিসাব নিকাশও।

    টি-টোয়েন্টির ব্যাকরণ শিখে যাওয়া বাংলাদেশ দলের মানবস্তম্ভ রচনাটা সবুজ মাঠে বারবার দেখতে মোটেও খারাপ লাগবে না!