প্রিমিয়ার লিগ : নির্ভার থাকতে পারে লিভারপুল, কেপার বদলি চাই ল্যাম্পার্ডের
লিগের প্রথম ম্যাচের ওপর ভিত্তি করে দলের বিচার করা একরকম অবিচারই। শুরুর দিকে দলগুলোর দুর্বলতা থাকে কিছু, প্রত্যাশার পুরোটা পূরণও হয় না অনেক সময়। প্রতিপক্ষ কোচের ট্যাকটিকস টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতাও হয়ত গড়ে ওঠে না কোচদের ভেতর। শুরুর দিকে দারুণ ছন্দে থাকা দলও পরে গিয়ে তাই পথ হারায় প্রায়ই। আবার উল্টোটাও ঘটে। এক ম্যাচ দেখে সবকিছু যাচাই-বাছাই করা না গেলেও আঁচ করা করা যায় অনেক কিছুই। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচ ডে শেষে সেই ঘটনাগুলোই আরেকবার যাচাই করা যাক।
রক্ষণ নিয়ে দুশ্চিন্তা লিভারপুলের?
(লিভারপুল ৪-৩ লিডস)
লিডসের বিপক্ষে লিভারপুল হজম করেছে ৩ গোল। তাতে ভার্জিল ভ্যান ডাইকের দৃষ্টিকটু এক ভুলের দায়ও আছে। ভ্যান ডাইক লিভারপুলে যোগ দেওয়ার পর আড়াই বছরের ভেতর বোধ হয় সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছেন। লিগ জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর গেল মৌসুমের শেষ অংশেও ভ্যান ডাইক কিছুটা নড়বড়ে ছিলেন। লিভারপুলের রক্ষণ এবার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে কি না সে প্রশ্ন তাই উঠে গেছে লিগের প্রথম ম্যাচ শেষেই।
ইউর্গেন ক্লপ ৪-৩ গোলে জেতা ম্যাচ শেষে কৃতিত্ব দিয়েছেন লিডসেরই। ক্লপ বলেছেন, লিভারপুলের রক্ষণকে ভুল করতে বাধ্য করেছে লিডস। ভ্যান ডাইকরা মৌসুম শুরুর আগে যথেষ্ট বিরতি পাননি, সেটাও একটা কারণ। লিডসের বিপক্ষে খেলার আগে ভ্যান ডাইকরা নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলেছেন, ঝরঝরে ডিফেন্ডারদের পাননি ক্লপ, তাও যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো যায়। আর প্রথম ম্যাচ বলে ছাড় তো সবাই পেতে পারে। সে হিসেবে লিভারপুলের এখনই রক্ষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ার মতো কিছু হয়নি।
বরং স্বস্তি আছে। আক্রমণে লিভারপুলের ধার আছে আগের মতোই। মোহামেদ সালাহর বুটে মরচে পড়েনি। সাদিও মানের সঙ্গে সালাহর অ্যাটাকিং থার্ডে সমন্বয় ছিল আগের দুই বছরের মতোই। আপাতত তাই প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নদের বাড়তি ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে দলে নতুন একজন মিডফিল্ডার না ভেড়াতে পারা লিভারপুলকে কতোখানি ভোগাবে সেটা হয়ত টের পাওয়া যাবে পরের ম্যাচেই। লিগের দ্বিতীয় ম্যাচ ডে-তেই লিভারপুল খেলবে চেলসির বিপক্ষে। লিভারপুল গেল দুই মৌসুমের মতো দুর্দান্ত হয়ে উঠতে না পারলে নতুন খেলোয়াড় দলে না ভেড়ানোটাই কারণ হয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিতভাবে।
ব্রাইটনে বোঝা গেল না চেলসির দৌড়
(ব্রাইটন ১-৩ চেলসি)
ব্রাইটনের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জিতেছে চেলসি। তবে ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের নতুন মৌসুমের নতুন খেলোয়াড়রা কেমন করলেন সেই আলোচনা ধোঁয়াশাতেই থাকল। টিমো ভার্নার আর কাই হাভার্টজ নতুনদের ভেতর শুরু করেছিলেন। থিয়াগো সিলভা, বেন চিলওয়েল, হাকিম জিয়েখদের প্রথম ম্যাচে খেলাননি ল্যাম্পার্ড।
ভার্নার চেলসিকে পেনাল্টি আদায় করে দিয়েছিলেন। এছাড়া গোলের সুযোগ তার কাছে কমই এসেছে। যদিও ব্রাইটনের ডিফেন্সলাইনের পেছনে অবিরত রান নিয়ে গেছেন জার্মান ফরোয়ার্ড। হাভার্টজ সে তুলনায় আরও অনুজ্বল ছিলেন। ম্যাচের প্রথম বিশ-বাইশ মিনিট চেলসিকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। হাভার্টজের প্রিমিয়ার লিগে থিতু হতে আরেকটু সময় প্রয়োজন বলেই মনে হচ্ছে।
এতোসব নতুনদের ভিড়ে অবশ্য ল্যাম্পার্ডের গোলরক্ষক নিয়ে আফসোস থেকেই যাচ্ছে। রেনে থেকে গোলরক্ষক এদুয়ার্দ মেন্দিকে দলে ভেড়ানোর কথা চেলসির। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে কেপার ওপরই ভরসা রেখেছিলেন ল্যাম্পার্ড। কিন্তু কেপা বদলাননি, ল্যাম্পার্ডকেও আশ্বস্ত করতে পারেননি। ৫৪ মিনিটে লিয়ান্দ্রো টোসার্ডের গোলে কেপা আরেকটু ভালো করতে পারতেন। ট্রোসার্ডের লং রেঞ্জ শট গেছে কেপার স্ট্রেচড হাতের নিচ দিয়ে। সেই দোষ এড়িয়ে যাওয়া যায় হয়ত। কিন্তু এড়ানো যায় না ম্যাচের বেশিরভাগ সময় কেপার কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া গোলকিপিং। কর্নার থেকে বল ধরতে গিয়ে একাধিক বার ভুল ঝাঁপ দিয়েছেন, পাঞ্চ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আত্মবিশ্বাসের তলানিতে থাকা একজন গোলরক্ষকের মতোই খেলেছেন পুরো ম্যাচ।
হামেসে আশার আলো এভারটনের
(টটেনহাম ০-১ এভারটন)
কার্লো আনচেলোত্তির এভারটন টটেনহামের সঙ্গে শুধুই একটা জয় পায়নি বরং দাপট দেখিয়েই জিতেছে। ১-০ স্কোরলাইন সে কথা অবশ্য বলছে না। তবে টটেনহামকে এভারটন ম্যাচের বেশিরভাগ সময়টাতেই দিশেহারা করে রেখেছিল। তাও আবার টটেনহামেরই মাঠে। এভারটনের জার্সিতে অভিষেক হওয়া হামেস রদ্রিগেজ গোল করেননি। তবে এক ম্যাচেই তিনি প্রমাণ করেছেন এখনও বিশ্বমানের ফুটবলার তিনি।
টটেনহামের বিপক্ষে রাইট উইং থেকে শুরু করেছিলেন হামেস। রিয়াল মাদ্রিদে থাকতে তাকে তেমন একটা ট্র্যাক ব্যাক করতে দেখা যেত না। আনচেলোত্তির এভারটনে দেখা মিলল পরিশ্রমী হামেসের। তার চেয়ে বড় কথা তাতে কলম্বিয়ান সহজাত আক্রমণাত্মক ফুটবল ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। হামেস পুরো ম্যাচে মোট ৫টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন। তার ডিফেন্সচেরা পাসগুলো যে কোনো স্ট্রাইকারের জন্যই উপহার। হামেসের অতীত বলছে, এই দর্শনীয় পাসগুলো তিনি নিয়মিতই দিয়ে যাবেন। এখন বাকিটা নির্ভর করছে এভারটন ফরোয়ার্ডদের দক্ষতার ওপর।
এই আর্সেনাল কী সেই আর্সেনাল?
(ফুলহাম ০-৩ আর্সেনাল )
আর্সেনালকে শিরোপার দাবিদার বলা যাবে না। মিকেল আর্টেটার দল বরং একটা অবস্থান্তর সময় পার করছে। তবে বহুদিন পর আর্সেনাল সমর্থকেরা আশায় বুক বাঁধতে পারেন। প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের প্রথম ম্যাচ অন্তত তেমন কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
একজন ‘জাত’ সেন্টারব্যাক আর্সেনাল খুঁজছিল বহুদিন ধরে। ব্রাজিলিয়ান গ্যাব্রিয়েল মাগালেস সেই অভাব পূরণ করতে পারেন। ফুলহামের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের শুরুটা ভালো হয়নি। তার ভুলে শুরুর দিকেই দল প্রায় গোল খেয়ে বসেছিল। কিন্তু ২২ বছর বয়সী এরপর দারুণভাবে ফিরেছেন, শক্তি আর সামর্থ্যের নিদর্শন দেখিয়েছেন। ৩-০ গোলে জেতা ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটিও করেছেন তিনি। বাতাসে যে তিনি ভালো, তার প্রমাণ মিলেছে প্রথম ম্যাচে।
আরেক ব্রাজিলিয়ান উইলিয়ান তরুণ নন। ৩২ বছর বয়সীর প্রিমিয়ার লিগ খেলা, জেতার অভিজ্ঞতা আছে। আর্সেনালের জার্সিতে প্রথম ম্যাচে তিন গোলেই অবদান আছে তার। আর্টেটা এমন কিছুই চাইছিলেন। তরুণ আর্সেনালে অভিজ্ঞতার মিশ্রণ খুঁজছিলেন। যাদের দেখে বাকিরা শিখতে পারে, অনুকরণ করতে পারে। আর্সেনালে উইলিয়ানের প্রথম ম্যাচ তরুণদের জন্য অনেককিছুই রেখে গেছে শেখার মতো।
চেলসিতে থাকতে উইলিয়ান সমালোচিত হতেন অধারাবাহিকতার জন্য। সে সমালোচনার জবাব উইলিয়ান দিতে পারবেন কি না তার জবাব ভবিষ্যতের জন্য তোলা। তবে প্রথম ম্যাচে উইলিয়ান আর হেক্টর বেয়ারিনের ডানপ্রান্তের সমন্বয় ভরসা যোগাতে পারে গানারদের। দুইজনের খেলা দেখে বোঝার উপায় নেই তারা প্রথমবারের মতো খেলছেন একসঙ্গে। উইলিয়ান সময়মতো বেয়ারিনকে সঙ্গ দিতে নিচে নেমে গেছেন। আবার আক্রমণেও বেয়ারিনের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন উইলিয়ান। আর্টেটার ৩-৪-৩ ফর্মেশনে মিডফিল্ডাররা সৃজনশীল ভূমিকায় থাকেন না। আক্রমণে আর্সেনাল কোচের ভরসা দুই প্রান্ত। আর দুশ্চিন্তা রক্ষণ। দুইয়েরই সমাধান মিলেছে আর্সেনালের। ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আর্সেনালের উন্নতি না করার কারণ নেই।
মরিনহোর শুরু মরিনহোর মতো
সাইডওয়েজ পাসিং আর অকার্যকর মিডফিল্ড দিয়ে টটেনহাম আশায় ছিল হ্যারি কেইন জাদুর। সেটা কাজে দেয়নি। ম্যাচ শেষে হোসে মরিনহো বলেছেন, দলের মিডফিল্ডারদের খেলা ভালো লাগেনি তার। নতুন মৌসুমের শুরুটাই হয়েছে মরিনহো ক্ল্যাসিক দিয়ে। দলকে দুষেছেন, হতাশা ঝেড়েছেন, অজুহাতও দেখিয়েছেন পর্তুগিজ কোচ।
আদতে মরিনহোর এই দল দিশেহারা এক পথিক। সৃষ্টির প্রশান্তি হাতছানি দেয় তাদের, কিন্তু পথ খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে যায়। এভারটনের বিপক্ষে বদলি নামা মুসা সিসোকো এক অর্ধে তিনবার খেলেছেন তিন পজিশনে। কেইন বলের আশায় হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। এভারটনের জমাট রক্ষণ ভাঙতে না পেরে টটেনহাম মিডফিল্ডাররা ছিলেন কেইনের আশায়। মরিনহো অবশ্য নিজের সেরা দলটাও পাননি, “হ্যারি কেইন আমাদের সঙ্গে অনুশীলন করেছে একবার। মুসা সিসোকো দুইবার। এভাবে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ফিরিস্তি দিচ্ছি না, তবে আমাদের প্রাক মৌসুম অনুশীলন যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমন হয়নি।”
“অনেকেই করোনায় আক্রান্ত, তারা কোয়ারেন্টিনে। আবার কেউ কেউ জাতীয় দলের দায়িত্বে ছিল। মাঠে যারা খেলছে তারা খুব নিখুঁত হবে, দুর্দান্ত খেলবে, আরও দ্রুত গতির ফুটবল খেলবে- আমি এমনটাও আশা করিনি। তবে দলগতভাবে তারা আরও ভালো কিছু দেখাতে পারত।” - এভারটনের সঙ্গে হারের পর মরিনহো কথা বলেছেন মরিনহোর মতো করেই।
নিজের কোচিং ক্যারিয়ারে কখনই মৌসুমের প্রথম ম্যাচ হারতে হয়নি মরিনহোকে। এবার সেই অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার। দলবদলেও টটেনহাম নীরব। অক্টোবরের ৫ তারিখ পর্যন্ত দলবদল খোলা, তবে টটেনহামের সরব হওয়ার সুযোগ কম।
রক্ষণ ভোগাবে লিডসকে
লিডসের ১৬ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে ফেরাটা রাজসিক হতে পারত লিভারপুলের সঙ্গে অন্তত ড্র করতে পারলেও। লিডস ফিরেছে খালি হাতে। তবে এরপরও মার্সেলো বিয়েলসার দল প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু লিভারপুলের কাছে হজম করা ৪ গোল বিয়েলসাকে স্বস্তি দেওয়ার কথা নয়।
ম্যাচ শেষে বিয়েলসা অবশ্য আক্রমণে তার দল কেন আরও ধারালো হতে পারল না সেই আফসোস করেছেন। লিভারপুলের ২২ শটের বিপরীতে লিডস গোলে শট নিয়েছে ৫টি। বিয়েলসার জন্য সেটি যথেষ্ট নয়। বিয়েলসার সন্তুষ্টি অর্জন প্রায় সম্ভব ব্যাপার। লিভারপুলের বিপক্ষে লিডস যেভাবে আক্রমণ করেছে সেটি বাকি দলের জন্য সতর্কবার্তাই। তবে বিয়েলসার মূল দুশ্চিন্তার কারণ তার রক্ষণ। জার্মান ডিফেন্ডার কেভিন কখের প্রথম ম্যাচ গেছে দুঃস্বপ্নের মতো। গোলরক্ষকও ছিলেন নড়বড়ে। লিডসের আনাড়ি রক্ষণ আর যাই হোক প্রিমিয়ার লিগে লড়াই করার মতো নয়। বিয়েলসা অবশ্য আপনাকে অন্য কথা বলবেন। আক্রমণ দিয়েই ম্যাচ জিততে চাইবেন তিনি। তবে আর্জেন্টাইন ভদ্রলোকের একরোখা স্বভাব যে সবসময় দলের জন্য সাফল্য বয়ে আনতে পারে না তার প্রমাণ তো আগেই মিলেছে। এই রক্ষণ ঠিক করতে না পারলে বিয়েলসার জন্য দুঃসময় অপেক্ষা করছে প্রিমিয়ার লিগে।