• অন্যান্য খবর
  • " />

     

    'মানুষ' ম্যারাডোনা, 'ঈশ্বর' ম্যারাডোনা

    'মানুষ' ম্যারাডোনা, 'ঈশ্বর' ম্যারাডোনা    

    ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে আপনি ঘৃণা করতে পারেন। যে লোকটা বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টারে হাত দিয়ে গোল দেয়, সেই অবৈধ গোলের কথা আবার বড়াই করে বলে, তাকে মন থেকে অপছন্দ আপনি করতেই পারেন।

    ম্যারাডোনা লোকটাকে আপনি অশ্রদ্ধা বা অভক্তিও করতে পারেন। যে লোকটা কোকেনের মতো ড্রাগ সেবন করে নিষিদ্ধ হয়, গুচ্ছের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, আর অশ্লীল অশালীন সব অঙ্গভঙ্গি করে বসে, এমনকি যাকে দেখে সবসময়েই মনে হয় নেশার ঘোরে আছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা না আসাটাই স্বাভাবিক।

    ম্যারাডোনা লোকটা আপনি করুণাও করতে পারেন। যে লোকটা এভাবে বিশ্বকাপ জেতালো, তার মতিগতি যেন কিশোরী মেয়ের মতো। তার মধ্যে কোনো স্থিরতা নেই, যেন সবে স্কুলে পা দেওয়া ছেলেটির মতো কোথাও দুদন্ড বসার ফুরসত নেই। এত বড় একটা খেলোয়াড়ের মানসিক বুদ্ধি এতোটা নিচে, সেটা ভেবে আপনার একটু খারাপ লাগতে পারে, হয়তো হাসিও আসতে পারে। যে লোকটা কথায় কথায় হেসে ওঠে, আবার কথায় কথা কেঁদেও ওঠে, তাকে নিয়ে চাইলে হাসাহাসিও করা যায়। মাথার তো আর ঠিক নেই তাঁর!

    আপনি ঘৃণা, তামাশা, অশ্রদ্ধা বা অভক্তি যাই করুন, এমনকি উপেক্ষা বা অবজ্ঞাও করুন, ম্যারাডোনাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন সেটা নয়, বোকা, নাপোলি, এমনকি আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি হিসেবে নয়, এমনকি ফুটবল ঈশ্বরও নয়। ফুটবল খেলাটা যারা খেলত, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘মানুষ’, এটাই আসল ম্যারাডোনা। দোষে-গুণে যে ম্যারাডোনা, সেজন্যই তিনি অনন্য। সেজন্যই তার মতো আর কাউকে আপন করে নেয়নি পৃথিবীর মানুষ, আর কারও জন্যে চোখের জলে বুক ভাসায়নি হাজার মাইল দূরের কোনো ভিনদেশী দেশের মানুষ। আবার তিনি সাধারণের মধ্যে অসাধারণ বলেই আর কারও নামে হয়নি উপাসনা, আর কারও নামে গড়া হয়নি প্রার্থনাগার। মর্ত্যের একজন হয়েও তিনি তাই স্বর্গের কাছাকাছি, নশ্বর হয়েও অবিনশ্বর।

    ম্যারাডোনা আমাদের এতো আপন, কারণ বুয়েনস এইরেসের বস্তি থেকে তার উঠে আসাটাই যেন এক রূপকথা। মাথার ওপরের ছাদটা এমনই বিপজ্জনক ছিল, যে কোনো দিন সেটা ধসে যেতে পড়ত। পুলিশ এসে নিয়মিত দেখত, সেই বাসাটা আস্ত আছে কি না। সেই বস্তির সামনে কাদা আর আবর্জনার পাক, ছোট্ট ডিয়েগো মাঝে মাঝে পড়ে যেত তাতে। চাচা চেঁচিয়ে উঠত, ‘পাঁকে ডুবে যাস না যেন, মাথাটা ভাসিয়ে রাখ।’ ডিয়েগো সেটাই মনে রেখেছিল। পংকের মধ্যে পরেও ডুবসাঁতার কেটে ঠিক চলে গেছে কিনারায়। ছেলেবেলায় এমন কোনো কাজ নেই, যেটা তাকে করতে হয়নি। ট্যাক্সিচালকের সহকারী থেকে ময়লাকুড়োনি, টোকাই থেকে কত ধরনের কাজ করতে হয়েছে। কে জানে, ময়লা কুড়োতে গিয়ে ভাঙা কাচ এড়িয়ে চলার যে কায়দা শিখেছিলেন, সেজন্যই বোধ হয় একের পর এক ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে স্বপ্নের ওই গোল করতে পেরেছিলেন।

    ম্যারাডোনার মতো মুদ্রার দুই পিঠ সম্ভবত আর কোনো ফুটবলার কেন, খুব কম মানুষই দেখেছে। প্রথম যখন খেলতে গিয়েছিল, আর্জেন্টিনো জুনিয়রস থেকে বলা হয়েছিল এই ছেলের বয়স নির্ঘাত আটের চেয়ে বেশি। আবার ডাক্তার ডাকা হলো, সার্টিফিকেট দেখা হলো। ম্যারাডনা খেলার সুযোগ পেলেন, আর বাকিটা ইতিহাস। ১১ বছরের মধ্যে একেবারে পত্রিকার প্রথম পাতায়। ১৫ বছরের মধ্যে পেশাদার চুক্তি, এরপর শুধু একটার পর একটা সিড়ি তরতর করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এর মধ্যেও ম্যারাডোনা বার বার মেজাজ হারিয়েছেন। স্কুলে তাকে গ্রেস দিয়ে পরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই মারামারি করে গেছেন সবার সাথে। বোকার আর্থিক সুবিধার জন্য শরীরের কথা চিন্তা না করে কিশোর ম্যারাডোনাকে খেলে যেতে হয়েছে একের পর এক ম্যাচ, পরে শরীর পাই পাই করে সেটার শোধ তুলেছে। কিন্তু ম্যারাডোনা পেশাদার হতে পারেননি, সারাজীবনেই তো নিজের এই মর্জিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

    যেখান থেকে উঠে এসেছেন, সেখান থেকে একবার ওপরে উঠে গেলে শুধু তরতর করে এগিয়ে যাওয়াই ছিল প্রায় সবার নিয়তি। কিন্তু মানুষটা ম্যারাডোনা বলেই ওপরে উঠতে উঠতে মাথা ঘুরেছে, এরপর ধপাস করে পড়ে গেছেন। সেই পড়ে যাওয়ার শুরু বার্সেলোনা থেকে, প্রথম যখন কোকেনে আসক্তি শুরু হয়। তবে সত্যিকার অর্থে, ম্যারাডনা লার্জার দ্যান লাফ হয়েছেন নাপোলিতে এসে।

    সেই নেপলস, ইতালির দক্ষিণের যে গেঁয়ো শহরকে তাচ্ছিল্য করত উত্তরের অভিজাতেরা। যার নাম শুনলে তুরিন, মিলান নাক সিঁটকাত। নাপোলির সঙ্গে মযাচে তাই দুয়ো দিত উত্তরের দর্শকেরা, ‘কলেরায় মরুক সব, ভূমিকম্পে নিপাত যাক’। সেই নাপোলিই যখন দলবদলের রেকর্ড গড়ে ম্যারাডোনাকে নিয়ে এলো, স্তাদিও সান পাওলোতে ম্যারাডোনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এসেছিলেন ৮৫ হাজার দর্শক। সেদিন সংবাদ সম্মেলনেই ম্যারাডোনাকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাকে কেনার জন্য এত টাকা নাপোলি কি মাফিয়াদের কাছ থেকে পেয়েছে? ম্যারাডোনার সাথে নেপলসের মাফিয়া, বিশেষ করে কামোরার সম্পর্ক নিয়ে এরপর অনেক কানাঘুষো হয়েছে, আর অপরিহার্য অনুষঙ্গের পর সেখানে এসেছে ড্রাগস আর নারী।


     

    তবে মানুষ বলেই, নাপোলিতে এসেই ম্যারাডোনা শুধু খেলা নয়, কথা দিয়েও জয় করে ফেলেছিলেন নেপলস। নিজের ছোট্ট মেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘জুভেন্টাস চুলোয় যাক।’ সেটা স্থানীয় টিভিতে দেখানো হয়েছিল। একবার এরকম জুভেন্টাসকে হারানোর পর সারা রাত পার্টির পর রাস্তায় নেমে হেঁড়ে গলায় গান ধরেছিলেন। পাড়ার সবচেয়ে খিটখিটে মেজাজের বুড়িটা এসে যখন জানতে চাইল, এত রাতে হইচই কে করে? ম্যারাডোনা বলেছিলেন, আমি নেপলসের রাজা। চিনতে পেরে বুড়ি চুমোয় ভরিয়ে দিয়েছিল বাছা ম্যারাডোনাকে। এই যে অকৃত্রিম ভালোবাসা, অচেনা দেশে কজন ফুটবলার পেয়েছেন?

    এই নাপোলিকেই দুটি সিরি আ জিতিয়েছেন, কেউ কেউ বলেন ৮৬ এর সেই রূপকথার বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে যা কম নয়। ম্যারাডোনা বার্সায় মন বসাতে পারেননি, তবে দীনহীন নেপলস তাকে দিয়েছিল দুই হাত ভরে। কিন্তু তিনি মানুষ বলেই সেই নেপলস থেকে রাজার বেশে এসে বিদায় নিতে হলো ভিখিরির মতো গলাধাক্কা খেয়ে। ৯০ এর বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইতালির প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা। কী কাকতালীয়, খেলাটা নাপোলির মাঠেই। ঘরের ছেলে হয়ে সবাইকে নিজের দেশকে এসে সমর্থন দিতে বলেছিলেন, কিন্তু সেটা কি আর হয়? যত যাই হোক, দেশ তো আগে। ম্যারাডোনা ইতালিকে হারিয়েছিলেন, সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছিলেন নেপলসকেও। এরপর ডোপিং আর নারী কেলেংলারিতে নিষিদ্ধ হয়ে ছাড়তে হয় ইতালি, আবার ফিরতে হয় নিজ দেশে। নাপোলি এখন তাকে নায়ক হিসেবেই জানে, কিন্তু এমন বিদায় তো চাননি ম্যারাডোনা। আর নিয়তির কী  পরিহাস, মাথার ওপর ট্যাক্স ফাঁকির দন্ড ঝোলায় আর কখনোই সেই ইতালিতে ফেরা হয়নি।

    সবাই ৮৬ এর সেই হ্যান্ড অব গডের কথা বলে, কিন্তু এমন কাজ তো ম্যারাডোনা পরেও করেছেন। ৮৯ এর ইউয়ফেয়া কাপে হাত দিয়ে ধরেও পেনাল্টি এনে দিয়েছেন দলকে, ৯০ এর বিশ্বকাপে রাশিয়ার বিপক্ষে হাত দিয়ে ঠেকিয়েছেন গোল। ম্যারডোনা জানেন, এসব অন্যায়। তার চেয়েও বড় অন্যায়, ড্রাগ পাপ আড়াল করার জন্য আরেকজনের মূত্র নমুনা চালান দিয়েছেন নিজেরটা বলে। একটা অন্যায় ঢাকতে আরও দশটা অন্যায় করেছেন। একটু একটু করে ডুবে গেছেন অন্ধকার জগতে, বিশ্বকাপ থেকে হতে হয়েছে নির্বাসিত।

     

    কিন্তু ম্যারাডোনা বলেই বার বার রঙ্গমঞ্চে ফিরেছেন। অভিজ্ঞতাশুন্য হয়ে দলকে নিয়ে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপে গেছেন। যুক্তির চেয়ে আবেগ দিয়ে দল চালানোর চেষ্টা করেছেন। জাদুটা অবশ্য রেখে এসেছিলেন মাঠেই, কোচ হিসেবে করতে পারেননি কিছুই। সেটা শুধু আর একবার প্রমাণ করেছে, ম্যারাডোনা রক্ত মাংসের মানুষই।

    কিন্তু এত কিছুর পরেও ম্যারাডোনা দেবতা হয়েছেন এই সাধারণত্বের জন্যই। মানুষ আপন ভেবেই তাকে বসিয়েছে হৃদমাঝারে, তার নামে তাই বুয়েনস এইরেসে হয়েছে চার্চ। সেখানে তাকে নিয়ে পূজা হয়েছে, সেজন্যই ধর্মীয় স্মারক হিসেবে জাদুঘরে ঝোলানো হয়েছে তার নকল শিশ্ন।

    ম্যারাডোনা নিষিদ্ধ হয়েছেন, নির্বাসিত হয়েছেন। ফিরে এসেছেন। মুটিয়ে গেছেন, আবার শুকিয়েছেন। মৃত্যুকে চুমু খেয়ে এসেছেন। আবার ফিরে জীবনকে করেছেন আলিঙ্গন। আনন্দের কান্না কেঁদেছেন, আর ব্যর্থতায়ও চোখের জলে দুকূল ভাসিয়েছেন। কাঁদিয়েছেন অনেক বার, শেষ বার কাঁদালেন মৃত্যুর পর।

    ম্যারাডোনা হেরেছেন, কিন্তু তার আগে জিতিয়ে দিয়ে গেছেন ফুটবলকে, এবং অতি অবশ্যই জীবনকে।