বাংলাদেশে গোপন যে তিন অস্ত্র নিয়ে আসছে নিউজিল্যান্ড
প্রায় আনকোরা একটা দল নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে নিউজিল্যান্ড। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য মূল দলের কেউই আসছেন না বাংলাদেশে। দলে আছেন কয়েকজন টেস্ট স্পেশালিস্ট, আর আন্তর্জাতিক অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা তিন জন। বেন সিয়ার্স, কলিন ম্যাককঞ্চি ও রচীন রবীন্দ্র এই সফরে হতে পারেন নিউজিল্যান্ডের তুণের তিন তীর।
ঘাসে ঢাকা পিচ, কনকনে ঠাণ্ডার সাথে আছে মৃদু হাওয়া। ওয়েলিংটন ক্রিকেট দলের হয়ে বল হাতে নিয়ে প্রথম বল করতে এগিয়ে আসছেন মাইকেল সিয়ার্স, চোখমুখ ঠিকরে পড়ছে বুনো এক তৃপ্তি। নিউজিল্যান্ডে একজন ফাস্ট বোলারের জন্য এরকম কন্ডিশন স্বর্গের চেয়ে কম নয় বৈকি। মাঠে আবার এসেছে চার বছর বয়সী ছেলেও। সেই ছেলে গভীর আগ্রহে বাবাকে দেখতে দেখতেই কখন যে মজে গেল নিজেই ঠাহর করে উঠতে পারেনি। ফাস্ট বোলিংয়ের বুনো আগ্রাসনকে আনমনে সেই যে ভালবেসে ফেলল সেদিন থেকেই চার বছর বয়সী বেন ঠিক করল বাবার চেয়েও একদিন জোরে বল করবে।
স্বপ্ন তো ঐ বয়সে অনেকেই দেখে তবে সত্যি হয় কয়জনের? মনের মাঝে যেই স্বপ্নজাল বুনেছিলেন বেন মাঠেও সেটা করে দেখাতে অপেক্ষা করেননি। হাট ইন্টারন্যাশনাল বয়েজ স্কুলের হয়ে ততদিনে ব্যাটসম্যানদের জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছেন। একদিন স্কুল ক্রিকেটের এক ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন গ্লেন পোকন্যাল। ১৩ বছর বয়সী বেন সেদিন ব্যাটসম্যানদের সমানে বাউন্সার দিয়ে কাবু করে যাচ্ছেন, স্কয়ার লেগের দিকে লাফিয়ে উঠে কোনোভাবে মাথা বাঁচাচ্ছে সব ব্যাটসম্যান। পোকন্যাল সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন এই ছেলে একদিন কালো জার্সি গায়ে চড়িয়ে ২২ গজে ঝড় তুলবে।
পোকন্যাল ঠিকই ধরেছিলেন। ১৭ বছর বয়সেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বাংলাদেশে হওয়া বিশ্বকাপ খেলতে আসেন বেন সিয়ার্স। বিভীষিকাময় এক টুর্নামেন্ট কাটানো নিউজিল্যান্ডের হয়ে সেবার নজর কাড়ার সুযোগই পাননি অবশ্য। ভাগ্যের চাকা ঘুরে সিয়ার্স ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে গিয়ে পড়লেন সেই পোকন্যালের দলেই। দারুণ সম্ভাবনাময় হলেও ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে নজর কাড়ার সুযোগই পাননি ততদিন। পোকন্যালের অবশ্য তাতে কিছুই আসে যায়নি, ইনজুরিতে ছিটকে পড়া জিমি নিশামের জায়গায় হুট করেই ওটাগো ভোল্টসের বিপক্ষে নামিয়ে দিলেন বেনকে। নিজের প্রথম ওভারেই টানা দুই বলেই তিনি ফেরালেন হ্যামিশ রাদারফোর্ড ও নিল ব্রুমকে। কাঁধঘেঁষা বাউন্সারে যেভাবে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরেছিলেন ব্রুম তাতেই মাঠের সবার বোঝা হয়ে গিয়েছিল এই তরুণ পেসারের গতি কতটা! পোকন্যালের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণ করে ঐ ম্যাচে ২১ রান দিয়ে নিলেন ৪ উইকেট, যা ছিল সেবারের সুপার স্ম্যাশ টি-টোয়েন্টির সেরা বোলিং ফিগার। পরের ম্যাচেও ক্যান্টারবারি কিংসের সাথে নিলেন ৩ উইকেট। সেবার ৭ ম্যাচ খেলে ১৬.৭৬৭ গড়ে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট, ইকোনোমি ছিল মাত্র ৬.৮৬। টুর্নামেন্টের ২য় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সতীর্থ ডেভন কনওয়ে তো ঘোষণাই দিয়ে বসলেন যে এই ছেলে নিউজিল্যান্ডের দ্রুততম বোলার, ফার্গুসন, মিলনেদের চেয়ে কোনও অংশেই কম নয়।
ঐ ক্যান্টারবারি কিংসেই ছিলেন একজন অফস্পিনিং অলরাউন্ডার যার ক্যারিয়ারই হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিলো। সেই কলিন ম্যাককঞ্চি গলফেই মনোনিবেশ করা শুরু করেছিলেন, নিউজিল্যান্ডের পিজিএ র্যাঙ্কিংয়েও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের বর্তমান কোচ গ্যারি স্টিডের অবশ্য মনে ধরেছিল এই অফ স্পিনারকে, সেটাও আবার ব্যাটিং টেকনিকের জন্য। স্টিড বললেন ব্যাটিং নিয়ে বেশি সময় দিতে, পাশাপাশি নাহয় একটু হাত ঘুরাক। যেই বলা সেই কাজ, ম্যাককঞ্চির ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরল সেখান থেকেই। সুপার স্ম্যাশে ১২০.১৬ স্ট্রাইক রেটে ২৯৮ রান করে তো পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকই হয়ে গেলেন, সাথে ৭.৪০ ইকোনোমি রেটে নিলেন ৫ উইকেট।
গলফ কোর্সে থাকতেই নিউজিল্যান্ড দলের পক্ষ থেকে কল আসে ম্যাককঞ্চির কাছে, কল যায় মাত্র ১২ টি-টোয়েন্টি খেলা বেন সিয়ার্সের কাছে, কল যায় আরও একজনের কাছে- ভারতীয় বংশোদ্ভূত রচীন রবীন্দ্রর কাছে। বাংলাদেশে হওয়া ২০১৬ সালের সেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন ১৬ বছর বয়সী রচীন। দুঃস্বপ্নের মত একটা টুর্নামেন্ট তো কেটেছিলই, পাশাপাশি গরম আর মন্থর উইকেটের ফলে ক্রিকেটটা তার কাছে বড়ই কঠিন মনে হয়েছিল। কিন্তু বাবা যে শখ করে শচীন টেন্ডুলকার আর রাহুল দ্রাবিড়ের নাম জোড়া লাগিয়ে রেখেছিলেন তার নাম, দেশ ছেড়ে ওয়েলিংটনের ঐ বিলাসী জীবনের সুযোগ করে দেওয়া বাবার আশা যে তাকে পূর্ণ করতেই হবে। ঘুরে তিনি ঠিকই দাঁড়িয়েছেন, লিস্ট এ আর ফার্স্ট ক্লাসে ব্ল্যাকক্যাপসদের হয়ে গত দুই বছরে তার ব্যাটে ছুটেছে রানের ফোয়ারা। তবে টি-টোয়েন্টিতে জুতসই পারফর্ম্যান্স দেখাতে পারেননি, সুপার স্ম্যাশে ৬ উইকেট পেলেও ব্যাট হাতে কিছুই করতে পারেননি বলার মত। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য ডাক পেয়ে যেমন বিস্মিত হয়েছিলেন, খুশিরও তেমনই ছিলনা কোনও কমতি। তিন ফরম্যাটেই কিউয়িদের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেন যে তিনি।
এই তিনজন হয়ত স্বাভাবিক পরিস্থিতে এই সময়ে দলে ডাক পেতেন না। তবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ নিতে আর দলে নিজেদের জন্য শক্ত দাবি জানাতে মুখিয়ে থাকবেন এই তিনজন। রচীন আর সিয়ার্সের বাংলাদেশে খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ত এই কন্ডিশনের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে তাদের। বাংলাদেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার নিদারুণ পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়েই মন্থর উইকেটের কথাও মাথায় থাকবে তাদের। রচীন অবশ্য স্পিনটা বেশ ভাল খেলেন আর সাথে নিজেও স্পিনটা মন্দ করেন না, ম্যাককঞ্চির ভুমিকাও থাকবে একই। সিয়ার্সের জন্য চ্যালেঞ্জটা আরও বড় হলেও তার গতি দিয়েই ঘায়েল করতে চাইবেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের। অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা এই তিন কিউই তাই তাক লাগিয়ে দিতেই পারে বাংলাদেশের বিপক্ষে।