• " />

     

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ৪

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ৪    

     


    আরো পড়ুনঃ

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ৩

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ২

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ১


     

    রেনাটো সানচেজ। বর্তমান ফুটবলের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ। কিন্তু তাকে নিয়ে বেনফিকা সমর্থকদের গর্ব যতটা না বেশি, তার চেয়ে বেশি ভয় কোনো ইউরোপিয়ান পাওয়ারহাউজের কাছে তাকে হারানোর। আর হবেই বা না কেন? ডি মারিয়া, ডেভিড লুইজ, এনজো পেরেজের মত তারকাদের শুরুটাও তো হয়েছিল এই বেনফিকাতেই। সানচেজেরও যে এদের দলে নাম লেখানোর সম্ভাবনা বেশি, তা খোদ বেনফিকার পাঁড় সমর্থকেরাও জানেন। বিগত পনের বছরে পর্তুগীজ লিগ জয়ে পোর্তোর নয় বারের বিপরীতে বেনফিকার জয় মাত্র পাঁচবার। খেলোয়াড় গড়ে তোলা ও বিক্রির দিক দিয়ে বিশ্বফুটবলে প্রথম সারির হলেও পোর্তোর ‘পাইপলাইন’ বেনফিকা থেকে অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী। অবশ্য ডি মারিয়াদের কেউ কেউ থেকে গেলে পাশার দানটা বদলে যেতেও পারতো।

     

    ২০১০-১১ মৌসুমের কথা। তৎকালীন গোলকিপার আর্তুরের ফর্মহীনতা বেনফিকাকে বেশ ভোগাচ্ছিল। গোলকিপারের সন্ধানে মরিয়া বেনফিকাকে তখন তাদেরই এক স্কাউট খোঁজ দেয় স্লোভেনিয়া কাঁপানো এক ১৭ বছর বয়সী তরুণের। নাম ইয়ান ওবলাক, বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম সেরা গোলকিপার। কেনার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে ওবলাককে নিয়ে আসা হয় পর্তুগালে। অবশ্য এর পরপরই ওবলাককে ধারে পাঠিয়ে দেয়া হয় বেইয়া মারে। পরবর্তী মৌসুমে তাকে আরেক পর্তুগীজ দল উনাও ডি লেইরিয়াতে ধারে পাঠানো হয়। ২০১২-১৩ মৌসুমে ওবলাককে ফেরত আনা হলেও সেই মৌসুমেই ট্রেনিং সেশন মিস করায় ক্লাব ও খেলোয়াড়ের মধ্যকারের সম্পর্কে চিড় ধরে। অবশ্য পুরো বিষয়টাকে ভুল বোঝাবোঝি আখ্যা দিয়ে কিছুদিন পরেই ২০১৮ সাল পর্যন্ত চুক্তি নবায়ন করেন ওবলাক। ওইদিকে কর্তোয়াকে চেলসির কাছে ফেরত দিতে বাধ্য হওয়ার পর কৌশলী সিমিওনের চোখ পড়ে ওবলাকের উপর। মাত্র ১৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পর্তুগাল ছেড়ে স্পেনে পাড়ি জমান ওবলাক। পানির দামে এমন একজনকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বেনফিকা বোর্ডের সাথে সমর্থকদের সম্পর্কটা এখনো বেশ তিক্ত।

     

    ওবলাকের মত ধারে আসা যাওয়ার ঝক্কি সইতে না হলেও পজিশন নিয়ে বেশ ভুগতে হয়েছে ম্যাক্সি পেরেইরার। রাইটব্যাক হলেও প্রথম দিকে রাইট মিডে খেলতে হয়েছে। সুবিধা করতে না পারার ফলে বেঞ্চই ঠিকানা হয় তার। কিন্তু ০৮-০৯ মৌসুমে বেনফিকার রাইটব্যাক নেলসন মার্কোসকে রিয়াল বেটিস কিনে নিলে নিজের পছন্দের পজিশনে খেলার সুযোগ পান পেরেইরা। এরপরের টানা ছয় বছর বেনফিকার ডানপ্রান্তের ডিফেন্স এবং অ্যাটাকের একটি বড় উৎস ছিলেন । ২০১৪ সালে বেনফিকার হয়ে ৩০০ ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেন। পরের বছরেই আকস্মিকভাবে বেনফিকার চিরশত্রু পোর্তোতে চলে যান। বলাই বাহুল্য, এর ফলে বেনফিকার সমর্থকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন।

     

    পেরেইরা পজিশন নিয়ে ঝামেলার সম্মুখীন হলেও অন্ততপক্ষে বেনফিকাতেই ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রতিককালের অন্যতম সেরা লেফটব্যাক ফ্যাবিও কোয়েন্ত্রাও তো বেনফিকাতেই থাকতে পারেননি! নাসিওনাল, জারাগোজা, রিও আভে হয়ে অতঃপর ২০০৯ সালে বেনফিকাতে ফেরত আসেন কোয়েন্ত্রাও। এসেই ২০১৫ পুরযন্ত চুক্তি নবায়ন করেন। এরপর টানা দুই বছর সাসপেনশন বাদে আর কোনোই ম্যাচ মিস করেননি তিনি। কিন্তু ২০১১ তে রিয়াল মাদ্রিদের ৩০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে তাকে বিক্রি করে দেয় বেনফিকা।

     

    কোয়েন্ত্রাওকে মাদ্রিদ আনার চুক্তিটা শুধু টাকার ছিল না, এই চুক্তিতে এজেকুয়েল গারায়ও ছিলেন। মাদ্রিদ থেকে বেনফিকাতে যান তিনি। ২০১১-২০১৪ এই তিন বছর ব্রাজিলিয়ান লুইসাওয়ের সাথে এক ইস্পাতদৃঢ় ডিফেন্স গড়ে তোলেন তিনি। এর মধ্যে ১৩-১৪ মৌসুমে সেন্টারব্যাক হয়েও আটটি গোল করেন। এরপরই নিজের প্রিয় কোচ আন্দ্রে ভিয়াস-বোয়াসের অধীনে খেলার জন্য জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে যান তিনি। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী ডেভিড লুইজ ০৬-০৭ মৌসুমে ধারে খেলতে এসেছিলেন বেনফিকাতে। কিন্তু ঐ মৌসুমে ডিফেন্সের প্রধান প্রহরী লুইসাওয়ের অনুপস্থিতিতে দারুণ কিছু পারফরম্যান্সের সুবাদে মৌসুমে শেষে তাকে স্থায়ীভাবে নিজেদের করে নেয় বেনফিকা। প্রথম দিকে বেঞ্চ থেকে বদলি হিসেবে নেমে বেশিরভাগ ম্যাচ খেললেও ০৯-১০ মৌসুমে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বেনফিকার লিগজয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন লুইজ। ঐ মৌসুমে লিগের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন তিনি। এই এক মৌসুম দিয়েই ইউরোপিয়ান রাঘব বোয়ালদের নজর কাড়েন তিনি। অতঃপর ১০-১১ এর শীতকালীন দলবদলে ২৫ মিলিয়নের বিনিময়ে চেলসিতে যোগ দেন লুইজ। বেনফিকার ডিফেন্সে তার অভাব আজো স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়।

     

    মাত্র এক মৌসুম খেললেও বেনফিকা সমর্থকদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছিলেন অ্যাক্সেল উইটসেল। এক মৌসুমেই বেনফিকাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ প্লে-অফ থেকে মূল পর্বে নিয়ে গিয়েছিলেন দুই গোল করে। আবার ঐ মৌসুমেই পর্তুগীজ কাপের ফাইনালে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছিলেন তিনি, বেনফিকাও জিতেছিল কাপটি। কিন্তু এরপরই জেনিতের ৪০ মিলিয়ন ইউরোওর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে বেনফিকার জন্য। এর ফলে বেলজিয়াম, পর্তুগালের পর রাশিয়াই হয় তার পরবর্তী ঠিকানা। ডেভিড লুইজকে চেলসি কেনার সময় নেমানিয়া মাতিচকে চেলসি থেকে কিনে নিয়েছিল বেনফিকা। কোচ হোর্হে হেসুস তার ডিফেন্সিভ দক্ষতা দেখে প্লেমেকার থেকে সরিয়ে এনে তাকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলান। ১২-১৩ মৌসুমে বেনফিকার সবচেয়ে ধারাবাহিক ছিলেন মাতিচ। পোর্তোর কাছে লিগ হারালেও সেই মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন । নিজেদের একসময়ের ‘বেঞ্চ ওয়ার্মার’ কে এত ভাল করতে দেখে আর দেরি করেনি চেলসি। কর্তোয়ার মত তাকেও ফেরত আনা হয় ১৩-১৪ মৌসুমের শীতকালীন দলবদলে।

     

    ডেভিড লুইজের মত বেনফিকাই ছিল রামিরেসের প্রথম ইউরোপিয়ান ক্লাব। ২০০৯ সালে ৭.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ক্রুজেইরো থেকে বেনফিকায় যোগ দেন। রামিরেস মাত্র এক মৌসুম ছিলেন পর্তুগালে। ঐ মৌসুমেই বেনফিকার হয়ে ‘ডাবল’ (পর্তুগীজ লিগ ও কাপ) জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু আবারো বেনফিকার এক প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়ের জন্য মোটা অঙ্কের প্রস্তাব দেয় চেলসি (২২ মিলিয়ন ইউরো) যাতে স্বাভাবিকভাবেই, রাজি হয়ে যায় বেনফিকা।

     

    আর্জেন্টাইন ক্লাব এস্তুদিয়ান্তেস থেকে ৫.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তরুণ এনজো পেরেজকে কিনে নেয় বেনফিকা। শুরুতেই হাঁটুর গুরুতর চোটে পড়েন এনজো। ফিরে এসে ১২-১৩ মৌসুম থেকে মাতিচকে সঙ্গী করে ভেনফিকার মিডফিল্ড নিজের করে নেন। পরবর্তী মৌসুমে মাতিচ চেলসিতে চলে গেলে দলে তার প্রয়োজনীয়তা আরো প্রবল হয়ে পড়ে। সেই মৌসুমে বেনফিকাকে পর্তুগীজ সব শিরোপা জয়ের পেছনের অন্যতম সেরা ও ধারাবাহিক খেলোয়াড় ছিলেন । ঐ মৌসুমে ইউরোপা লিগের ফাইনালেও গিয়েছিল বেনফিকা। অনেকেই সেভিয়ার কাছে ফাইনালে তাদের হারের মূল কারণ হিসেবে এনজোর অনুপস্থিতিকে আখ্যায়িত করেন। ২০১৩-১৪ মৌসুমে অসাধারণ পারফরম করায় ৬ জুলাই, ২০১৪ তে ঐ মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাব থেকে তার জন্য প্রস্তাব আসতে থাকে। কিছুটা অস্বাভাবিক হলেও তাকে কেনার রেসে জয়ী হয় ভ্যালেন্সিয়া। তাদের ২৫ মিলিয়নের অফারে এনজোকে বিক্রি করে দেয় বেনফিকা ।  

     

    এনজো, লুইজদের মত তারকাদের হারালেও খুব সম্ভবত বেনফিকা সমর্থকদের সবচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস আনহেল ডি মারিয়াকে বিক্রি করা। উপরি উল্লিখিত বেশকিছু তারকাদের মত ডি মারিয়ারও প্রথম ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল বেনফিকা। আর্জেন্টাইন ক্লাব রোসারিও সেন্ট্রাল থেকে ৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে কেনা হয়েছিল বেনফিকার ক্লাব ক্যাপ্টেন সিমাওয়ের বদলি হিসেবে। ২০০৭-২০১০ এই তিন বছর বেনফিকা সমর্থকদের নিজের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি। স্বয়ং ম্যারাডোনা পর্যন্ত তাকে মেসির পর আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় তারকা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বেনফিকাতে থাকাকালীন তিন বছরে ০৮-০৯ মৌসুমে পর্তুগীজ কাপ আর ০৯-১০ মৌসুমে পর্তুগীজ লিগ ও কাপ জিতেছিলেন তিনি। ২০১০ ওয়ার্ল্ড কাপের সময় ডি মারিয়াকে ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। বেনফিকার হয়ে শেষ ম্যাচে নিজে কেঁদে এবং অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে বিদায় নেন ডি মারিয়া। আজো তাকে পরম আলবাসার সহিত স্মরণ করে বেনফিকা সমর্থকেরা।

     

    ডি মারিয়া বেনফিকা সমর্থকদের সবচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস- এই কথাটির সাথে দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন দীর্ঘদেহী প্যারাগুইয়ান স্ট্রাইকার অস্কার কারদোজো। আর্জেন্টাইন ক্লাব নিউওয়েলস ওয়ল্ড বয়েজ থেকে ৯.১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে কিনে নেয় বেনফিকা। কারদোজোকে পর্তুগীজ ক্লাবটির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামী খেলোয়াড়ে পরিণত করে (সর্বোচ্চঃ সিমাও, ১৩ মিলিয়ন ইউরো)। ০৭-০৮ মৌসুমে এসেই নিজের জাত চেনানো শুরু করেন কারদোজো। প্রথম মৌসুমেই ২২ গোল করেন তিনি; যদিও খালি হাতেই মৌসুম শেষ করতে হয় বেনফিকাকে। এরপরের মৌসুমে ১৭ বার জাল খুঁজে পান এই প্যারাগুইয়ান। এই মৌসুমে অল্পের জন্য লিয়েদসনের কাছে মৌসুমের টপস্কোরার খেতাবটি হারান কারদোজো।

     

    দলীয় ও এককভাবে কারদোজোর সেরা মৌসুম হয় ০৯-১০ মৌসুমটি। সব মিলিয়ে মোট ৩৮ বার গোল করেন, বেনফিকা পর্তুগীজ লিগ ও কাপ জেতে। ১১-১২ মৌসুমে আবারো লিগের টপস্কোরার হন কারদোজো। ১৩-১৪ মৌসুমে ইঞ্জুরি ও বাহ্যিক গুঞ্জনের জন্য আগের বিধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হতে পারেননি । ২০১৪ এর আগস্টে ঘোষণা দেন, তুরষ্কের ক্লাব ট্রাবজনস্পোরে চলে যাচ্ছেন। বিদায়বেলায় তার কান্না আজো বেনফিকা সমর্থকদের মন ভারী করে দেয়। ৯ বছরে গোল করেছেন ১৭২টি, ক্লাব ইতিহাসের নবম সর্বোচ্চ গোলস্কোরার, ইউরোপিয়ান প্রতিযোগীতায় বেনফিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা বিদেশী খেলোয়াড় কারদোজো।

     

    একসময়ের ইউরোপিয়ান জায়ান্ট বেনফিকা এখন সেরা খেলোয়াড়দের আকর্ষণ করা তো দূরের কথা, নিজেদের তারকাদের ধরে রাখতেও হিমশিম খাচ্ছে। নিকোলাস গাইতান, লিমা, রেনাটো সানচেজদের নিয়ে গর্বের চেয়ে তাদের হারানোর ভয়টাই বেশি বেনফিকা সমর্থকদের মনে। বর্তমানের অর্থনির্ভর ফুটবলে এই তরুণেরা কি গিগস, টট্টিদের মত আনুগত্য দেখিয়ে বেনফিকায় থেকে যাবে? নাকি ডি মারিয়া, লুইজদের মত অর্থ-যশ-খ্যাতির মোহে বড় দলে চলে যাবে? উত্তরটা সময়ই জানিয়ে দেবে।

     

     


    বেনফিকা, যা হতে হতেও হলো না