স্টোকসের মেসেজ, মঈনের ফেরা ও ফ্রি হিটে ছয়
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের পা পড়েছে আমেরিকার মাটিতেও। একই সাথে কানাডায় আরেকটি, জিম্বাবুয়েতে হয়েছে টি-টেন লিগ। শেষ কয়েক বছরে ফ্র্যাঞ্চাইজির দুনিয়ায় মঈন আলীর কদর বেড়েই চলছে। এসব লিগে নিশ্চিত কোনও দল তাকে টানত। কিন্ত মঈন আলী স্বল্পদৈর্ঘ্যের ক্রিকেট থেকে সোজা পাড়ি দিয়েছিলেন দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে। অবসর ভেঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে ফেরা মঈনের সে সময়কালকে যদিও ফেলা যায় আরেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি চুক্তির আদলেই!
জুনের প্রথম সপ্তাহে একটা মেসেজ এসেছিলো মঈনের হোয়াটসঅ্যাপে। যাতে লেখা, ‘অ্যাশেজ?’। স্টোকসের সে মেসেজের উত্তর মঈন দিয়েছিলেন ‘লল’ লিখে! ততক্ষণে ইংল্যান্ডের মূল স্পিনার জ্যাক লিচ ইনজুরিতে ছিটকে পড়েছেন, মঈন তা জানেন না। তাই স্টোকসকে অট্টহাসির সেই জবাব।
দুবছর আগে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলেছিলেন মঈন। ২০২১ সালে ভারতের বিপক্ষে ওভাল টেস্টই তার সাদা পোষাকের শেষ স্মৃতি হয়ে ছিল এই জুনের আগে। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও বেন স্টোকসের অধীনে ইংল্যান্ড পথচলা শুরু করেছিল গেল বছরের জুনে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের প্রথম সিরিজে ‘বাজবল’ এর হাওয়া যখন বইছে ইংল্যান্ডজুড়ে, মঈনও তা নিয়ে গুণগান গেয়েছেন। বিবিসির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের সঙ্গে ব্রডকাস্টিংয়ে যে যুক্ত ছিলেন মঈনও।
মঈন যে ধরনের ক্রিকেট খেলেন, বাজবলের সঙ্গে পুরোপুরি যায়। মঈনকে অবসর থেকে ফেরানোর কথাও উঠেছিল তাই। ইংল্যান্ড দলও তাকে ফেরাতে চেয়েছিল। মঈন জানিয়েছিলেন, গেল বছরে পাকিস্তান সফরের আগে অক্টোবরে ম্যাককালামের সঙ্গে এ নিয়ে তার কথা হয়েছিলও বিস্তর। কিন্ত মঈন তার মতে কোন বদল না এনে নাকি বলেছিলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে আমি শেষ’।
সেই মঈন ফিরেছেন এই অ্যাশেজে। অ্যাশেজের মঞ্চ বলেই মত বদলাতে আগ্রহী হয়েছিলেন। তবে ফিরে পড়েছিলেন শরীরের সঙ্গে লড়াইয়ের আরেক খেলায়ও। ফেরার আগে সেই ওভালের শেষ আন্তর্জাতিক টেস্টটাই ছিল লাল বলে তার সবশেষ অভিজ্ঞতা। স্বভাবতই দীর্ঘদিন পর টানা ওভার করে যাওয়ার ধকল তার আঙুল নিতে পারনি। প্রথম টেস্টেই স্পিনিং ফিঙ্গারে হয় ইনজুরি। তবে সে টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৩৩ ওভারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে আরও ১৪ ওভার বোলিং করেছিলেন।
প্রথম ইনিংসের শেষদিকেই আঙুল নিয়ে ভোগান্তিতে দেখা যায় তাকে। আগ্রাসী ফিল্ডসেটে বোলিং করে এজবাস্টনের ফ্ল্যাট পিচে রানও খরচা করেছেন যথেষ্ট, তবে হেড ও গ্রিনের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়েছিলেন। বোলিং বিশ্লেষণ দুর্দান্ত না হলেও গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়ে আসলে পুরো সিরিজে ঠিকই অবদান রেখেছেন মঈন।
দ্বিতীয় টেস্টে খেলতে পারেননি আঙুলের কারণে। তৃতীয় টেস্টে হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়া যখন ম্যাচে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, তখনই লাবুশেন ও স্মিথকে ফিরিয়েছিলেন মঈন। ম্যানচেষ্টারেও লাবুশেনকে আউট করে অস্ট্রেলিয়ার বড় জুটির সম্ভাবনাকে মাটিচাপা দিয়েছিলেন।
ওভালে শেষদিনে স্মিথ-হেডের জুটি তাদের ম্যাচ থেকে ছিটকেই দিচ্ছিল, ৭ উইকেট হাতে রেখে ১২০ রানের দূরত্বে যখন অজিরা, তখনই হেডকে ফিরিয়ে ৯৫ রানের জুটি ভেঙ্গে ব্রডের ভাষায় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনেন মঈন। শেষদিনের পিচের টার্ন ও বাউন্স কাজে লাগিয়ে এক প্রান্তে টানা বল করে মার্শ ও কামিন্সকেও ফেরান মঈন। অথচ এর আগে প্রথম ইনিংসে ফিল্ডিংয়েই নামতে পারেননি। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় ১১ রানে থাকা অবস্থায় কুঁচকিতে চোট পেয়ে হঠাৎ ফিজিওকে ডাকেন। এরপর দৌড়াতেও পারছিলেন না ঠিকমতো। দ্বিতীয় ইনিংসে চতুর্থ দিনেও ভালোমতো চলাচল করতে পারেননি, তবে শেষদিনে এসে ইংল্যান্ডের চাওয়া পূরণ করেছেন দুর্দান্তভাবেই।
চার ম্যাচে ৫১.৪৪ গড়ে ৯ উইকেট। স্পিনারের যে দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে, সেটি পূরণ করতে পারলেন কি না, এই সংখ্যা সেটির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার দাবি হয়তো রাখে। তবে ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিতভাবে তাতেই খুশি হবে।
স্পিনারের জায়গা তো পূরণ করলেন, মঈন ‘নাম্বার ত্রি’র ফাঁকা ঘরও যে পূর্ণ করেছিলেন। দ্বিতীয় টেস্টে চোট পাওয়া ওলি পোপ পরে অ্যাশেজ থেকেই ছিটকে যান। তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে হ্যারি ব্রুককেই তিন নাম্বারে নামায় ইংল্যান্ড। পরের ইনিংসে দেখা যায় মঈন আলীকে ওয়ান ডাউনে নামতে। মঈনই নাকি নিজের ইচ্ছায় ম্যাককালাম ও স্টোকসকে বলেছিলেন, তিন নাম্বারে নামতে চান। যা তাদের পছন্দ হয়েছে এবং এভাবে নিজে থেকে দায়িত্বের ভার নেওয়ার প্রশংসাও করেছেন স্টোকস।
হেডিংলিতে দ্বিতীয় ইনিংসে যদিও ৫ রানই করতে পেরেছিলেন মঈন। তবে ম্যানচেষ্টারে তিনে নেমে খেলেছেন মন জুড়ানো শটে ৫৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সাধারণ বিষয়গুলোতেই ফিরে যাচ্ছি। দেরিতে বল খেলা, যত সোজা ব্যাটে খেলা যায় এবং কিছু বল ছেড়ে দেওয়া।’ খেলেছিলেনও সেভাবেই, পারফেক্ট নাম্বার ত্রি।
মঈনের তিনে চলে যাওয়া দল ব্যালেন্সেও সহায়তা করেছে। তিন নাম্বারে কোনও ব্যাটার খেলাতে চাইলে এক বোলার কম নিয়ে খেলতে হত। ওদিকে স্টোকস বোলিং করছেন না মোটেও। তিন পেসার নিয়ে খেলার ঝুঁকি এড়াতে চাইলে তাই আরেক পেসার খেলিয়ে ব্যাটিংয়ে কম শক্তি নিয়েই খেলতে হত। কিন্ত অলরাউন্ডার মঈনের উপস্থিতিতে সে জটিলতা এড়ানোর সঙ্গে তিন নাম্বারের চিন্তাও দূর হয়েছে। যে সাত ইনিংসে ব্যাট করেছেন, তাতে আট-সাত নাম্বারে নেমেছেন চারবার, আর তিনে তিনবার। ২৫.৭১ গড়ে ১৮০ রানে ব্যাট হাতেও তার অবদান যথেষ্টই কাজে এসেছে।
টেস্টে ইংল্যান্ড খেলবে আর আগামী বছরের জানুয়ারিতে। ভারতের মাটিতে মঈনের ভূমিকা তো বিশালাকারেরই হওয়ার কথা। যেকোন সময়ে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলার সঙ্গে এক পত্রিকাকে আগেই বলেছিলেন মঈন, ‘আমি ভারতে যে যাব, কোনও সম্ভাবনা নেই।’ জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টুয়েন্টিতে জোবার্গ সুপার কিংসের হয়ে খেলার চুক্তিও ইতোমধ্যে সারা। স্টুয়ার্ট ব্রড ওভালেই নিজের বিদায়ক্ষণ আগেভাগেই নিশ্চিত করে ফেললেও মঈন তেমন কিছু করেননি। মঈনও পরে নিশ্চিত করেছেন, টেস্টে তিনি ‘শেষ’!
৬৪ টেস্টে থেমে যাওয়া ক্যারিয়ার যে আবার ছুটেছিল, তাতে আরও চার টেস্টই যোগ হয়েছে কেবল। ফিরে আসাকে মঈন বলেছিলেন ‘ফ্রি-হিট’ হিসেবেই দেখছেন। সে ফ্রি-হিটের ফাঁকে তৃতীয় ইংলিশ স্পিনার হিসেবে টেস্টে দুই শ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। তিন হাজার রান ছাড়িয়ে গিয়ে টেস্টে ৩০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবলের ক্লাবে ১৬তম হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
‘অ্যাশেজ জিতে সঠিকভাবে টেস্ট ক্রিকেট শেষ করতে পারলে চমৎকার হবে।’, মঈনের সে আশা পূরণ হয়নি, তবে ওভালে সিরিজ সমতার দুর্দান্ত জয়ে পেয়েছেন মনে রাখার মতো স্মৃতি, ‘আমি খুব খুশি যে স্টোকসকে হ্যাঁ বলেছিলাম। দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমার বাকি জীবনে কখনোই যা ভুলবো না’। অবসর ভেঙ্গে এলেন, দুর্দান্ত ও স্মরণীয় একটা সিরিজের অংশ হয়েই চলে গেলেন। যেন আরেকটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের দলেই খেললেন কেবল।
ফ্রি-হিটে তাহলে কী হাঁকালেন মঈন? নিশ্চয়ই ছক্কা!