• অন্যান্য
  • " />

     

    নাম্বার সিক্সের আদ্যোপান্ত

    নাম্বার সিক্সের আদ্যোপান্ত    

    ফুটবল মাঠে দশ বা সাত নম্বর জার্সিধারীরাই সাধারণত থাকেন দর্শকদের মনোযোগের কেন্দ্রে, এর সাথে যোগ করা যেতে পারে নয় আর এগারোও। এক নম্বর জার্সিটা ওঠে গোলরক্ষকদের গায়ে, দুই-তিন-চার-পাঁচ পরতে দেখা যায় রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের। সেই হিসেবে ছয় নম্বর জার্সিধারীরা যেন একটু আড়ালেই থেকে যান। এই খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সও দর্শকদের চোখের আড়ালে থাকে তাদের জার্সি নম্বরের মতোই। কিন্তু কারা এই ‘নম্বর সিক্স’, কী তাদের পরিচয়, ফুটবল মাঠে কীভাবে ভূমিকা রাখেন তারা, উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছে দ্যা কোচেস ভয়েস

    নম্বর সিক্স কারা?

    ফুটবলে মাঝমাঠের কেন্দ্রে অবস্থান করা ডিপ-লায়িং বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকেই সাধারণত নম্বর সিক্স হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত দলগুলো একজন খেলোয়াড়কেই নম্বর সিক্স হিসেবে রাখে, এর সাথে থাকেন দুইজন নম্বর এইট। এই তিনজন মিডফিল্ডারকে নিয়েই তৈরি করবে ৪-৩-৩ ফরমেশনের মাঝমাঠ।

    তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলগুলোকে দুজন নম্বর সিক্সও খেলাতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে তাদের সামনে থাকেন একজন নম্বর টেন। বায়ার্ন মিউনিখের কথাই ধরা যাক, ইয়োশুয়া কিমিখ এবং লিওন গোরেতজকার মতো দুইজন নম্বর সিক্সের সামনে নম্বর টেন হিসেবে খেলেন জামাল মুসিয়ালা। মুসিয়ালার দুই পাশে উইঙ্গার হিসেবে রয়েছেন লেরয় সানে এবং কিংসলে কোম্যান, আর সবার সামনে নম্বর নাইন হ্যারি কেন। 

    [ছবি: Wyscout]

    কোচ যদি দলকে খেলাতে চান ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফরমেশনে, সেক্ষেত্রেও তিনি একজন নম্বর সিক্সকে খেলাতে পারেন। ৩-৫-২ ফরমেশনে বা ৩-৪-৩ ডায়মন্ডেও চাইলে একজন নম্বর সিক্সকে খেলানো সম্ভব। দুজন নম্বর সিক্সকে খেলাতে চাইলে ৩-৪-৩ বা ৪-২-২-২ ফরমেশন ব্যবহার করা যেতে পারে।

    [ছবি: Wyscout]

    নম্বর সিক্সের উৎপত্তি কোথায়?

    নম্বর সিক্সের জন্ম ইংল্যান্ডে, অবশ্যই ফুটবল জার্সিতে নম্বর ব্যবহারের সাথে সাথে। ১৯২৮ সালের ২৫ আগস্ট তারিখটা ফুটবলারদের জার্সিতে নম্বর ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক। আর্সেনাল বনাম দ্য ওয়েন্সডে (বর্তমানের শেফিল্ড ওয়েন্সডে) এবং চেলসি বনাম সোয়ানসি টাউন (বর্তমানের সোয়ানসি সিটি) ম্যাচে ইংল্যান্ডের ফুটবলে প্রথমবারের মতো খেলোয়াড়দের জার্সিতে ব্যবহৃত হয় জার্সি নম্বর।

    সেই সময়ে বেশিরভাগ দলই খেলতো ২-৩-৫ ফরমেশনে। যখন খেলোয়াড় তালিকা লেখা হতো, প্রথমে লেখা হতো গোলরক্ষকের নাম, এরপর রক্ষণ, মাঝমাঠ, সবশেষে ফরোয়ার্ডদের নাম। জার্সি নম্বরও একইভাবেই দেওয়া হতো। গোলরক্ষক পেতেন এক নম্বর জার্সি, দুই ও তিন পরতেন দুই ডিফেন্সিভ ফুলব্যাক। মাঝমাঠের তিনজন- অর্থাৎ রাইট হাফ, সেন্টার হাফ এবং লেফট হাফ পেতেন যথাক্রমে ৪, ৫ ও ৬ নম্বর জার্সি। সামনের পাঁচ ফরোয়ার্ড পেতেন সাত থেকে এগারো, ডান থেকে বাঁয়ে ক্রমানুসারে।

    [ছবি: Wyscout]

    এরপর ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয় ফুটবল। ২-৩-৫ ফরমেশনের জায়গা নেয় ‘ব্যাক ফোর সিস্টেম’। জার্সি নম্বরের গুরুত্বেও বদল আসে, যদিও ভিত্তিটা ছিল ওই ২-৩-৫-ই। লেফটব্যাক আর রাইটব্যাক সাধারণত পান দুই আর তিন, দুই সেন্টারব্যাক পরেন চার আর পাঁচ। আর ছয় নম্বর জার্সিটা ওঠে সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের গায়ে।

    [ছবি: Wyscout]

    তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। কিছু কিছু দল অবশ্য নম্বর ছয় নয়, বরং নম্বর চারকে ব্যবহার করে সবচেয়ে পেছনের মিডফিল্ডার হিসেবে। সেক্ষেত্রে সেন্টারব্যাকরাই দলের পাঁচ আর ছয় হয়ে থাকেন। তবে নম্বর যাই হোক, ভূমিকায় খুব বেশি বদল আসে না।

    বল পায়ে থাকা অবস্থায় নম্বর সিক্সের ভূমিকা

    ফুটবল মাঠে নম্বর সিক্সের মূল দায়িত্ব রক্ষণ আর আক্রমণের সমন্বয় করা। রক্ষণভাগ আর আক্রমণভাগের মধ্যে পাসিংয়ের সূত্র হিসেবে কাজ করেন তিনি। সেন্টারব্যাকদের সামনের জায়গাগুলো ব্যবহার করা, দ্রুত মুভমেন্টের মাধ্যমে মাঠের সব প্রান্তে ছোট-বড় পাস দিয়ে খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করেন নম্বর সিক্স।

    সময়ে সময়ে সেন্টারব্যাকদের মাঝে অবস্থান নিয়ে খেলা তৈরিতেও ভূমিকা রাখেন নম্বর সিক্স। শুধু সেন্টারব্যাকদের মাঝেই নয়, কখনো কখনো রক্ষণের এক পাশেও অবস্থান নেন তারা। এজন্য ট্যাকটিকালি বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে হয় তাদের, একই সাথে দখল থাকতে হয় সতীর্থদের মুভমেন্ট বিষয়ক জ্ঞানের ওপর। এর পাশাপাশি স্ক্যানিংয়ের ক্ষমতাও ভালো হতে হয় নম্বর সিক্সদের। জায়গাগুলো কাজে লাগানো, নিজের ও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের অবস্থান ও প্রেস সম্পর্কিত ধারণা থাকতে হয় নম্বর সিক্সদের। বল রিসিভ করে কখনো টার্ন বা হাফ টার্ন নেওয়া, কখনো সামনে এগিয়ে যাওয়া, লাইন ব্রেকিং পাস দেওয়ার সক্ষমতাও থাকা চাই তাদের।

    [ছবি: Wyscout]

    সাধারণভাবে নম্বর সিক্সই থাকেন দলের পাসিংয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। মাঠের খেলার ধরণ পাল্টানো, আক্রমণের দিক পরিবর্তন করতে হয় তাদের। এর পাশাপাশি সুযোগ পেলে বল নিয়ে এগিয়ে যেতেও ভুল করেন না তারা, একটু এগিয়ে গিয়েই খুঁজে নেন সতীর্থকে।

    [ছবি: Wyscout]

    আক্রমণের গতি বাড়ানো-কমানোর জ্ঞান থাকাটাও একজন নম্বর সিক্সের জন্য আবশ্যক। প্রতিপক্ষের রক্ষণের ধরণ ও তাদের দুর্বলতা বুঝে আক্রমণের প্রকৃতি বদলানোর দায়িত্বটা নিতে হয় এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকেই। কখনো লাইন ব্রেকিং পাস দিয়ে, কখনো থ্রু বল দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার দায়িত্বও নম্বর সিক্সরা নিয়ে থাকেন। একইভাবে সরাসরি লং পাস দিয়ে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের কাছে বল পৌঁছে দেওয়াটাও নম্বর সিক্সদের বাড়তি পারদর্শীতার মধ্যে পড়ে। প্রতিপক্ষের রক্ষণ আর গোলরক্ষকের মাঝের ফাঁকা জায়গাকে লাগানোর জন্য অনেক সময়ে ফরোয়ার্ডদের উদ্দেশ্যে লং বল বাড়ান তারা, আবার প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের পেছনের জায়গাকে কাজে লাগানোর জন্য বল বাড়িয়ে দেন উইঙ্গারদের উদ্দেশ্যে।

    বল পায়ে না থাকা অবস্থায় নম্বর সিক্সের ভূমিকা

    প্রতিপক্ষের কাউন্টার অ্যাটাক বা প্রতি-আক্রমণ আটকানোর মূল দায়িত্বটা থাকে দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের ওপর, কেননা প্রতি-আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম রক্ষণরেখা রূপে তারাই থাকেন দলে। তাই দল আক্রমণে উঠলেও নম্বর সিক্সকে সতর্ক থাকতেই হয়। আর এই প্রতি-আক্রমণ রুখে দেওয়ার জন্য প্রথম বা দ্বিতীয় চেষ্টাতেই বলটা জিতে নিতে হয় তাদের। এর বাইরেও ডুয়েল জিততে হয়, লুজ বলগুলো দখলে নিতে হয়, প্রয়োজনে ফাউল করে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থামাতে হয়। এসবের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে তাদের অর্ধেই বন্দী করে রাখা সম্ভব, নিজেরা তখন শাণানো যায় একের পর এক আক্রমণ।

    [ছবি: Wyscout]

    এছাড়া বল পায়ে না থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে প্রেস করে বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। বলটা প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডারদের পায়ে থাকলেও প্রেসিংটা চালিয়ে যান নম্বর সিক্স। প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের মাঠের জোন ১৪তে প্রবেশে বা অবস্থানে বাধা দেন তিনি। দল যদি লো ব্লকে খেলে, সেক্ষেত্রে সরাসরি যেকোন একজনকে মার্কিং করার দায়িত্বও থাকতে পারে নম্বর সিক্সের ওপর। দুজন সেন্টারব্যাকের মাঝে অবস্থান নিয়ে প্রতিপক্ষের জন্য জায়গা কমিয়ে দেওয়ার কাজটাও অনেক ক্ষেত্রে করেন তিনি। 

    [ফুটবল মাঠকে ভাগ করা হয়েছে আঠারোটা জোনে; ছবি: Wyscout]

    প্রতিপক্ষের কোন ফরোয়ার্ড যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে দলের কোন একজন ডিফেন্ডারকে ড্র্যাগ করে সরিয়ে নেন তার জায়গা থেকে, বা তাকে মার্ক করতে গিয়ে যদি ডিফেন্ডারকে সরে যেতে হয় নিজের অবস্থান থেকে, সেই ফাঁকা জায়গাটা পূরণের দায়িত্ব থাকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ওপর। প্রয়োজনে ‘ব্যাক ফোর’কে ‘ব্যাক ফাইভ’-এ রূপান্তরের কাজটাও তাকে পালন করতে হয়।

    নম্বর সিক্সের উদাহরণ

    জার্সি নম্বর ছয় না হলেও মাঠে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের দায়িত্ব পালনকারীদের নম্বর সিক্স হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এবং এক্ষেত্রে প্রথম নামটাই আসবে বার্সেলোনার সাবেক অধিনায়ক, বর্তমানে ইন্টার মায়ামির জার্সিতে খেলা স্প্যানিশ মিডফিল্ডার সার্জিও বুসকেটসের নাম। জাতীয় দলে বুসকেটসের জায়গা যিনি নিয়েছেন, সেই ম্যানচেস্টার সিটির রদ্রিও রয়েছেন একই বন্ধনীতে। আর্সেনালের ইতালীয় মিডফিল্ডার জর্জিনহো, একই দলের ইংরেজ খেলোয়াড় ডেক্লান রাইস, বায়ার্ন মিউনিখের জার্মান মিডফিল্ডার ইয়োশুয়া কিমিখ, রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক ব্রাজিলীয় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ক্যাসেমিরো, মাঠে প্রত্যেকের ভূমিকা হুবহু এক না হলেও প্রত্যেকেই নম্বর সিক্সের উদাহরণ।

    [ছবি: গেটি ইমেজেস]

    নম্বর সিক্স খেলানোর সুবিধা

    থ্রি-ম্যান মিডফিল্ডে যখন নম্বর সিক্সকে খেলানো হয়, প্রতিপক্ষের টু-ম্যান মিডফিল্ডকে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে পরাজিত করাটা অনেকটা সহজ হয়ে যায় দলের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই বল পজেশন থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে প্রেস করে বল কেড়ে নেওয়া, প্রতিপক্ষের প্রেস ভেঙে জায়গা বের করা, প্রতিটি কাজই সহজ হয়ে যায়।

    [ছবি: Wyscout]

    আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, নম্বর সিক্সের অন্যতম কাজ হলো দলের রক্ষণকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া, রক্ষণ দেয়ালের ওপরে বাড়তি দেয়াল হিসেবে কাজ করা। একজন ভালো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের উপস্থিতি দলের রক্ষণের চেহারা পাল্টে দিতে পারে খোলনলচে।

    থ্রি ম্যান মিডফিল্ডে একজন নম্বর সিক্স থাকার অর্থ, বাকি দুইজন খেলছেন নম্বর এইট হিসেবে। এই দুজনই দলের আক্রমণে সাহায্য করার বাড়তি সুযোগ পান, কেননা রক্ষণকে সাহায্য করছেন নম্বর সিক্স। দলের আক্রমণেও নতুন মাত্রা পায় তাতে।

    নম্বর সিক্স খেলানোর অসুবিধা

    যদি নম্বর সিক্সকে মাঠের ওয়াইড অংশগুলো কাভার করার কাজ করতে হয়, সেক্ষেত্রে মাঝের অংশে প্রতিপক্ষ জায়গা পেয়ে যেতে পারে। একই ভাবে, যদি প্রতিপক্ষ একাধিক খেলোয়াড়কে নম্বর টেন অবস্থানে খেলায়, সেক্ষেত্রে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে পড়বে নম্বর সিক্স। দলের মাঝমাঠ আর রক্ষণের মাঝে, অর্থাৎ বিটুইন দ্য লাইনসে যদি প্রতিপক্ষ এক বা একাধিক খেলোয়াড়কে রাখে, তাতেও নম্বর সিক্সের বিপদে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিপক্ষ যদি একাধিক সেন্টার ফরোয়ার্ডকে খেলায়, সেক্ষেত্রে দুজনের মাঝের পাসিং লেন বন্ধ করাটাও কঠিন হয়ে পড়বে নম্বর সিক্সের জন্য, সেন্টারব্যাকদের ওপরে তখন বাড়তি দায়িত্ব পড়ে যাবে।

    [ছবি: গেটি ইমেজেস]

    কিছু অসুবিধা থাকলেও, নম্বর সিক্সরা আসলে একটা ফুটবল দলকে পূর্ণতা দেন, আক্রমণ আর রক্ষণে সমন্বয় করেন, দলের ডিএনএটা মূলত তারাই বহন করেন। তাই জার্সি নম্বর ছয় হোক বা না হোক, গুরুত্বের বিচারে নম্বর সিক্সরা ছক্কাই মেরে থাকেন!