ইউরোর ব্যবচ্ছেদ- গ্রুপ বি
এবারের ইউরোর ‘গ্রুপ অফ ডেথ’ গ্রুপ-ই কে বলা হলেও গ্রুপ-বি কেও সেটি বললে বেমানান কিছু হবে না। ইংল্যান্ড, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া এবং নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইউরোর মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ওয়েলসেকে নিয়ে গ্রুপটা বেশ জমজমাট হওয়ার কথা।
ইংল্যান্ড: পুনরাবৃত্তি না নতুন বিপ্লব?
প্রতি টুর্নামেন্টের আগের অবস্থা যেন ইংল্যান্ডের জন্য এক চক্রপূরণ। অসাধারণ কোয়ালিফায়ার, উদ্ভট দল নির্বাচন, সমর্থক ও মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত আস্ফালন, গ্রুপপর্বে সামর্থ্যমত খেলতে না পেরে অতঃপর খালি হাতে বাড়ি ফেরা- ১৯৬৬ এর পর থেকে বেশিরভাগ বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের আগে এটাই যেন ইংল্যান্ডের ‘ফ্লো-চার্ট’।
রোড টু ইউরোঃ
এবারো ব্যতিক্রম হয়নি খুব একটা। রয় হজসনের শিষ্যরা কোয়ালিফায়ারের দশটি ম্যাচের দশটিই জিতেছে, গোল করেছে ৩১টি ও গোল হজম করেছে মাত্র ৩টি। সুইজারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া-কেউই পাত্তা পায়নি ‘থ্রি লায়ন্স’দের কাছে।
টাচলাইনের বসঃ
মূলত শিষ্যদের নিজের মত খেলার স্বাধীনতা এবং তরুণদের পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়াই ছিল হজসনের এহেন সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। ৪-৩-৩ এ খেলানো ইংল্যান্ডকে মূলপর্বে কেইন, ভার্ডি, রুনি, র্যাশফোর্ড, স্টারিজের মত ফরওয়ার্ডদের কাকে রেখে কাকে খেলাবেন হজসন, তা-ই এখন ইংল্যান্ড সমর্থকদের মূল চিন্তা। গ্রুপপর্বে সবার প্রশংসা কুড়ালেও ২৩-জনের দল নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে হজসনকে। লেস্টারের মহাকাব্যিক শিরোপাজয়ের অন্যতম নায়ক ড্যানি ড্রিংকওয়াটারকে বাদ দিয়ে এই মৌসুমে মাত্র কিছু মিনিট খেলা জ্যাক উইলশেয়ারকে নেয়া এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয়।
তারকা খেলোয়াড়ঃ
স্টার্লিং, ভার্ডি, কেইন, আলি সহ অসংখ্য তরুণ তুর্কি দিয়ে ঠাসা হলেও ইংলিশদের কাছে এখনো মূল আশার প্রদীপ সেই ওয়েন রুনিই। কোয়ালিফায়ারে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টিতে লক্ষ্যভেদ করে স্যার ববি চার্লটনের ৪৯ গোলের রেকর্ড ভেঙ্গে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে যান ‘মাস্টার ওয়েন’। ৭ গোল করে ইংল্যান্ডের টপস্কোরার ছিলেন রুনি। ওয়েলবেক লক্ষ্যভেদ করেছিলেন ছ’বার, কেইন ও ভার্ডি তিনবার করে।
গ্যারি লিনেকার, পিটার শিল্টন, ববি চার্লটনদের মত কিংবদন্তীর জন্ম যে দেশে, ইউরোতে সে দেশের সর্বোচ্চ সাফল্য তৃতীয় হওয়া, মাত্র একবার তাও আবার সেই ১৯৬৮ তে, বিষয়টা আসলেই কিছুটা হলেও অপমানজনক। প্রতিবার কোয়ালিফায়ারে ভাল খেলে মূল পর্বে ‘ফর্মহীনতায়’ ভোগা ইংল্যান্ড কি পারবে তাদের সমর্থকদের দীর্ঘ অর্ধশতক পর সাফল্যের ভেলায় ভাসাতে? নাকি প্রতিবারের মত এবারও সেই আশায় গুড়েবালি? জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে জুলাই ১১ পর্যন্ত।
প্রেডিক্টেড লাইনআপঃ
হার্ট, ওয়াকার, কাহিল, স্মালিং, রৌজ; আলি, দিয়ের, মিলনার; রুনি, কেইন, ভার্ডি।
ওয়েলসঃ প্রথমবারেই বাজিমাত?
ইয়ান রাশ, গ্যারি স্পীড, রায়ান গিগস, ক্রেগ বেলামি। পারেননি কেউই। সেই ১৯৫৮ তে বিশ্বকাপ খেললেও এরপর থেকে আর কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে খেলার সৌভাগ্য হয়নি ওয়েলসের। সেই ৫৭ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটলো গ্যারেথ বেল, অ্যারন র্যামসেদের হাত ধরে। বেলজিয়াম, বসনিয়া, ইসরায়েল নিয়ে গড়া গ্রুপে খুব কম মানুষই ওয়েলসের মূল পর্বে খেলতে পারার সম্ভাবনা আমলে নেননি। কিন্তু ক্রিস কোলম্যানের শিষ্যরা নিন্দুকের মুখে চুনকালি দিয়ে যা কিছুদিন আগেও দূর আকাশের চাঁদ মনে হচ্ছিল, তা সত্য করে দেখিয়েছেন।
রোড টু ইউরোঃ
কোয়ালিফায়ারে ওয়েলস জিতেছে ছয়টি, ড্র করেছে চারটি এবং হেরেছে মাত্র একটা ম্যাচ। এর মধ্যে আছে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে থাকা বেলজিয়ামকে হারনোর ও ড্র করার সুখস্মৃতি। আক্রমণে বেল, র্যামসেদের পাশাপাশি ডিফেন্সেও ওয়েলস ছিল দুর্ভেদ্য এক দেয়াল। পুরো কোয়ালিফায়ারে তারা গোল খেয়েছে মাত্র চারটি।
টাচলাইনের বসঃ
ওয়েলস কিংবদন্তী গ্যারি স্পিডের আকস্মিক মৃত্যুর পর দলের কোচ হন ক্রিস কোলম্যান। তার অধীনেই আসতে থাকে ওয়েলসের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সময়। অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে চলা এক ‘খরা’র অবসান ঘটানোয় কোলম্যানের সাথে চুক্তিটা আরো তিন বছরের জন্য নবায়ন করে নিয়েছে ওয়েলস ফুটবল অ্যাসোসিয়েসন। বেল, র্যামসে ছাড়াও দলে আছেন অ্যাশলি উইলিয়ামস, জো লেডলি, জো অ্যালেন, বেন ডেভিসের মত প্রিমিয়ার লিগ তারকারা।
তারকা খেলোয়াড়ঃ
৪-২-৩-১ ফরমেশনে খেলা ওয়েলস দলের মূল কান্ডারি স্বাভাবকভাবেই রিয়াল মাদ্রিদ তারকা গ্যরেথ বেল। কোয়ালিফায়ারে ওয়েলসের ১১টির মধ্যে ৭টি গোলই তার দেয়া। গ্রুপপর্ব পার হতে হলে বেইলকে যে নিজের সেরাটাই দিতে হবে, তা বলা বাহুল্য।
প্রেডিক্টেড লাইনআপঃ
হেনেসি, গান্টার, চেস্টার, উইলিয়ামস, ডেভিস; লেডলি, র্যামসে, কিং; বেইল, রবসন-কানু।
রাশিয়া :‘জাদুকর’ স্লুটস্কির ভেলকিঃ
২০১৫ সালের আগস্ট মাসের কথা। সমগ্র রাশিয়া জুড়ে হতাশা। এত ভাল সূচনা করেও ছয় ম্যাচ পরে রাশিয়া কি না আছে পঞ্চম অবস্থানে! তৎকালীন কোচ ক্যাপেলোও অবস্থা বেগতিক দেখে বরখাস্ত হবার আগেই নিজেই ছেড়ে দিলেন চাকরি। আসলেন লিওনিদ স্লুটস্কি, এসেই করলেন বাজিমাত। পরের চার ম্যাচের চারটিতেই জিতে রানারআপ হয়ে সরাসরি ইউরোর গ্রুপপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে রাশিয়ানরা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর ১৯৯৬ থেকে ইউরোতে সদা উপস্থিত দলগুলোর একটি রাশিয়া। ইউরোতে রাশিয়ার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্য ২০০৮ সালের সেমিফাইনালে খেলা এবং ঐ আসরের তৃতীয় সেরা দল হওয়া। রক্ষণভাগে ইগর আকিনফেভ ও সের্গেই ইগ্নেশেভিচের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে বড় এক প্লাস পয়েন্ট হবে রাশিয়ার ইউরো মিশনে।
টাচলাইনের বসঃ
জরুরী ভিত্তিতে সিএসকেএ মস্কোর কোচ লিওনিদ স্লুটস্কিকে নিয়োগ দেয় রাশিয়া। তার জাদুকরী দিকনির্দেশনায় পরবর্তী চারটি ম্যাচ জিতে গ্রুপ রানারআপ সরাসরি ফ্রান্সের টিকেট পায় রাশিয়া। অল্পদিনেই শিষ্যদের কাছ থেকে এতটা ভাল পারফরম্যান্স সম্ভবত স্লুটস্কি নিজেও আশা করেননি। রাশিয়া খেলান ৪-১-২-২-১ ফরমেশনে। মিডফিল্ডে শাটভ, ডেনিসভ, শিরোকভ, স্মলভদের সামনে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন দীর্ঘদেহী স্ট্রাইকার আর্ট্যম জুবা।
তারকা খেলোয়াড়ঃ
স্লুটস্কির ২৩ সদস্যের দলে এবার একমাত্র এবং খুব সম্ভবত সবচেয়ে বড় ক্ষতি অ্যালেন জাগোয়েভের ইঞ্জুরির কারণে অনুপস্থিতি। তার অনুপস্থিতিতে আক্রমণভাগে দলের মধ্যমণি থাকবেন কোয়ালিফায়ারে আট গোল করা আর্ট্যম জুবা। জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গের এই স্ট্রাইকার ক্যাপেলোর অধীনে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। স্লুটস্কি এসেই যেন তাকে আমূলে বদলে দিলেন। ফ্রান্সের টিকেট নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম ধন্যবাদটা কোচকেই জানিয়েছিলেন জুবা। বি গ্রুপ থেকে শেষ ষোলতে যেতে হলে আরো বেশ কিছুবার জাল খুঁজে পেতে হবে জুবাকে।
প্রেডিক্টেড লাইনআপঃ
আকিনফেভ, স্মলনিকভ, বেরেজুটস্কি, ইগ্নেশেভিচ, শেনিকভ,সামেদভ, মামায়েভ, ডেনিসভ, শাটভ, স্মলভ, জুবা।
স্লোভাকিয়াঃ অনুপ্রেরণায় ২০১০ বিশ্বকাপঃ
রোড টু ইউরোঃ
স্লোভাকিয়ার ইউরো বাছাইপর্বের শুরুটা হয়েছে চমৎকার। প্রথম ছয় ম্যাচের ছয়টিতেই জয়লাভ করেছিল তারা, এর মধ্যে তারা বিস্ময়করভাবে হারিয়েছিল স্পেনকেও। একজন গোলস্কোরারের অভাব স্লোভাকিয়ার জন্য পথের কাঁটা হয়ে দাড়াতে পারে। তবে মিখাল দুরিসের ফর্ম তাদের জন্য সুখবরই বটে। মারেক হামসিক, ভ্লাদিমির ভেইসদের নেতৃত্বে মাঝে পথহারা হয়ে গেলেও শেষদিকে ঠিকই মূলপর্বে নিজেদের জায়গা পাকা করেছে স্লোভাকরা।
টাচলাইনের বসঃ
ইয়ান কোয্যাকের দর্শন যেন স্লোভাকিয়ার ফুটবলে ‘আ ব্রেথ অফ ফ্রেশ এয়ার’। তার আগের প্রায় সব কোচের অধীনেই স্লোভাকিয়ার খেলা তাদেরই সমর্থকদের মতে ছিল একঘেয়ে। কোয্যাকের ফলাফলের চেয়ে খেলাটা উপভোগ করার এবং অনুপ্রারিত করার ক্ষমতার জোরে স্লোভাকিয়ার এসেছে এতদূর। ৪-২-৩-১ ফরমেশনে হামসিককে ‘ফ্রি-রোল’ দেওয়া ছিল কোয্যাকের অন্যতম মাস্টারস্ট্রোক। ভেইস ও দুরিসের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য পেয়ে দলকে ফ্রান্সের টিকেট এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন স্লোভাক কাপ্তান।
তারকা খেলোয়াড়ঃ
নিঃসন্দেহে মারেক হামসিক। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপে খেলে আসা বাহারি চুলের এই উইঙ্গার ও নিজেদের কাপ্তানের কাছ থেকে কোয়ালিফায়ারের মতই কিছু আশা করবে তার সমর্থকেরা। ৭ গোল করে স্লোভাকিয়াকে প্রথমবারের মত ইউরোর মূলপর্বে নিয়ে আসার কৃতিত্বটাও তারই ছিল। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, রাশিয়াকে টপকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে হামসিককে তার সেরাটাই উগড়ে দিতে হবে।
২০১০ বিশ্বকাপ ছিল স্লোভাকিয়ার প্রথম বড় টুর্নামেন্ট। সেখানে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়া স্লোভাকরা তাদের লড়াকু মনোভাবের দ্বারা আবারো কি ঐবারের মত কিছু করে দেখাতে পারবে? ইয়ান কোয্যাক কি পারবেন ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ওয়েলসকে টক্কর দিয়ে হামসিকদের দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে যেতে? সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে খুবই শীঘ্রই, ফ্রান্সে।
প্রেডিক্টেড লাইনআপঃ
কোজাচিক, পেকারিক, স্কারটেল, দুরিচা, হুবোকান; কুচকা, পেকভস্কি, মাক, হামসিক, ভেইস; দুরিস।
কারা যাবে শেষ ষোলতে?
ফর্ম ও সামর্থ্যের বিচারে দেখলে, এই গ্রুপ থেকে ইংল্যান্ড ও রাশিয়ারই অগ্রসর হওয়ার কথা। কিন্তু ফুটবল কখনোই পরিসংখ্যান, রেকর্ডস দিয়ে চলে না। ইংল্যান্ডের ‘মূল পর্বের জুজু’, রাশিয়ার ইঞ্জুরি দুর্ভাগ্য এবং ওয়েলস, স্লোভাকিয়ার প্রথম আসরের বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছাশক্তি-সব মিলিয়ে এই গ্রুপ থেকে যে কেউই শেষ ষোলোতে জায়গা করে নিতে পারার যোগ্যতা রাখে। সব হিসাব নিকাশ শেষে কারা যাচ্ছে পরবর্তী রাউন্ডে, তা জানা যাবে ২২ জুন, গ্রুপ পর্ব শেষে। তবে এই গ্রুপটি যে টানটান উত্তেজনার খোরাক যোগাবে, তা বলাই যায়।