• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    কোপা আমেরিকায় কেন ফাঁকা গ্যালারি?

    কোপা আমেরিকায় কেন ফাঁকা গ্যালারি?    

    ভোরে উঠে যারা নিয়মিত কোপা আমেরিকার ম্যাচগুলো দেখছেন, তাদের চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়েছে নিশ্চিত। কোপা আমেরিকা যেখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেই আমেরিকার গ্যালারিগুলো ভরছে না পুরোপুরি। হাতেগোণা কিছু ম্যাচ বাদ দিলে বাকি ম্যাচগুলোতে টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ছে ফাঁকা গ্যালারি।

    তবে মোটাদাগে দর্শক-উপস্থিতি যতই বাজে দেখাক না কেন, আর্জেন্টিনার ম্যাচে ফাঁকা গ্যালারি দেখা যায়নি একবারও। বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের একটা ম্যাচ দেখার জন্য, বা হয়তো শুধু লিওনেল মেসিকেই দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন সমর্থকেরা। আটলান্টা থেকে নিউ জার্সি, মায়ামি থেকে হিউস্টন, আর্জেন্টিনার কোন ম্যাচেই দর্শকের কমতি নেই। প্রতিটা ম্যাচেই গ্যালারি ছিল ‘জ্যাম-প্যাকড’।

    আর্জেন্টিনার ম্যাচে দর্শকের অভাব হচ্ছে না; Image Source: Getty Images

    টুর্নামেন্টের শুরুর ম্যাচে কানাডার মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা। আটলান্টার মার্সিডিজ-বেঞ্জ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে ৭০ হাজারের বেশি দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ম্যাচগুলোতে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র, দর্শকখরায় ভুগতে থাকে কোপা আমেরিকা। আবারও একটা ‘ফুল হাউজ’ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় টুর্নামেন্টের পঞ্চম দিন পর্যন্ত। হিউস্টনের এনআরজি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত কলম্বিয়া-প্যারাগুয়ে ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হয় ভরা গ্যালারিতে। 

    কিন্তু কেন এই দুরবস্থা? কেন গ্যালারি খালি থাকছে আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রাচীনতম আসরে?

    ১। টিকেটের দাম

    ফাঁকা গ্যালারির প্রথম কারণ হিসেবে ‘টিকেটের দাম’ আসবেই। তবে এবারের কোপা আমেরিকার টিকেটের দাম যে খুব বেশি, তেমনটা মনে করেন না কনমেবলের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল নেরি পাম্পিদো, “টিকেটের দাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এখন পর্যন্ত যা দেখছি, আমার মনে হয় টিকেটের দাম ঠিকই আছে।”

    বলে রাখা ভালো, কোপা আমেরিকার এবারের আসরের গ্রুপ পর্বের প্রতিটা ম্যাচের জন্য দর্শকদের গড়ে গুণতে হয়েছে প্রায় ২০০ ডলার। স্বাভাবিকভাবেই নকআউট পর্বে আরো বাড়বে টিকেটের দাম। ফাইনালের জন্য প্রতিটা টিকেটের দাম ধার্য করা হয়েছে ১,৩৬৯ ডলার। দুটো টিকেট নিলে প্রতিটা টিকেট পড়বে ১,২৯২ ডলার করে।

    প্রতিপক্ষ স্টেডিয়ামের নাম শহর ধারণক্ষমতা উপস্থিত দর্শক
    কানাডা মার্সিডিজ-বেঞ্জ স্টেডিয়াম আটলান্টা ৭১,০০০ ৭০,৫২৪
    চিলি মেটলাইফ স্টেডিয়াম ইস্ট রাদারফোর্ড ৮২,৫০০ ৮১,১০৬
    পেরু হার্ড রক স্টেডিয়াম মায়ামি গার্ডেনস ৬৫,৩০০ ৬৪,৯৭২
    ইকুয়েডর এনআরজি স্টেডিয়াম হিউস্টন ৭২,২০০ ৬৯,৪৫৬

    আর্জেন্টিনার ম্যাচ মানেই ভরপুর গ্যালারি

    এক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। যেমন, এবার কোপা আমেরিকার টিকেটের দাম নির্ধারিত হয়েছে স্টেডিয়ামের তরফ থেকে। অর্থাৎ কনমেবল বা কনকাকাফ নয়, বরং যে স্টেডিয়ামে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, সেই স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষই টিকেটের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সব স্টেডিয়ামের টিকেটের দাম সমান হয়নি।

    সমান হয়নি সব ম্যাচের টিকেটের দামও। কোয়ার্টার ফাইনালেই যেমন, আর্জেন্টিনা-ইকুয়েডর ম্যাচের টিকেটের দাম ছিল প্রায় ১৭৬ ডলার করে। এমনকি ম্যাচ শুরু হওয়ার পরও প্রায় ১২০ ডলারে বিক্রি হচ্ছিল টিকেট। সেই তুলনায় অন্যান্য ম্যাচের টিকেটের দাম ছিল বেশ কম। ব্রাজিল-উরুগুয়ে ম্যাচের টিকেট বিক্রি হয়েছে ১৩২ ডলার করে, এরপর ভেনেজুয়েলা-কানাডা এবং কলম্বিয়া-পানামা ম্যাচে টিকেটের দাম ছিল যথাক্রমে ১০৭ ডলার ও ৭০ ডলার করে।

    কনমেবলের মতে, এবারের আসরের গ্রুপ পর্বের ২৪টা ম্যাচের মধ্যে ৯টা ম্যাচের প্রায় সব টিকেট বিক্রি হয়েছে। আর পুরো টুর্নামেন্ট বিবেচনায়, অফিসিয়ালরা কোপা শুরুর আট দিন আগে জানিয়েছিলেন যে বিক্রি হয়েছে এক মিলিয়নের বেশি টিকেট। ২০১৬ কোপা আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে অনুষ্ঠিত যে আসরটিকে দর্শক উপস্থিতির দিক থেকে ধরা হয় ‘বেঞ্চমার্ক’, সেই আসরে মোট টিকেট বিক্রি হয়েছিল দেড় মিলিয়নের মতো। কনমেবল তাই পুরো ব্যাপারটিতে অখুশি নয়।   

    ২। অন্যান্য খরচ

    শুধু অনলাইনে টিকেট কিনবেন, আর এরপর খেলা দেখতে চলে যাবেন, ব্যাপারটা তো এত সরল নয়। টিকেটের কেনার সাথে সাথে গুণতে হবে কিছু অতিরিক্ত খরচ। সার্ভিস চার্জ আর প্রসেসিং ফি তো আছেই, এর সাথে দর্শকদের ভিসা-পাসপোর্ট, এরপর ফ্লাইট আর হোটেল ভাড়া, তারপর আমেরিকার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের খরচ, পার্কিং ফি, সব মিলিয়ে খরচের খাতটা বেশ বড়। আর্জেন্টিনা-ইকুয়েডর ম্যাচের কথাই ধরুন। জায়গাভেদে ওই ম্যাচের পার্কিং ফি ছিল সর্বোচ্চ ১৩২ ডলার পর্যন্ত।

    ম্যাচ স্টেডিয়ামের নাম শহর ধারণক্ষমতা উপস্থিত দর্শক
    পেরু-কানাডা চিলড্রেন'স মার্সি পার্ক কানসাস সিটি ১৮,৫০০ ১১,৬২২
    কোস্টারিকা-প্যারাগুয়ে কিউ টু স্টেডিয়াম অস্টিন ২০,৭০০ ১২,৭৫৬
    বলিভিয়া-পানামা ইন্টার অ্যান্ড কো স্টেডিয়াম অরল্যান্ডো ২৫,৫০০ ১২,৯৩৩
    ইকুয়েডর-জ্যামাইকা আলেজায়ান্ট স্টেডিয়াম লাস ভেগাস ৬৫,৫০০ ২৪,০৭৪
    কলম্বিয়া-কোস্টারিকা স্টেট ফার্ম স্টেডিয়াম গ্লেনডেল ৬৩,৪০০ ২৭,৩৮৬
    ইকুয়েডর-ভেনেজুয়েলা লেভি'স স্টেডিয়াম সান্তা ক্লারা ৬৮,৫০০ ২৯,৮৬৪

    টুর্নামেন্টের উল্লেখযোগ্য দর্শক-স্বল্পতার ম্যাচ

    এসব খরচ আমেরিকার নাগরিকদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর নাগরিকদের পক্ষে একটু কষ্টকর হয়ে যায়। এই মুহূর্তে লাতিন দেশগুলোর গড় মাসিক বেতন ৯০০ ডলার। বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দেশ আর্জেন্টিনায় এই সংখ্যাটা প্রায় ৪২৩ ডলার। এই দেশগুলোর নাগরিকদের তাই মাঠে বসে দলের ম্যাচ দেখার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয়নি।

    ৩। মার্কেটিংয়ের অভাব

    একই সময়ে চলছে ফুটবলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দুই মহাদেশের দুই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা, জৌলুস আর মানুষের সংযুক্তিতে ইউরো যতটা এগিয়ে গেছে, কোপা আমেরিকা ততটা পারেনি। এক্ষেত্রে মার্কেটিংয়ের অভাবটাও চোখে পড়েছে সংশ্লিষ্টদের। এমনকি আমেরিকার ম্যাচগুলোতেও দর্শকে-ঠাসা গ্যালারি পাওয়া যায়নি। 

     

    আমেরিকার ম্যাচেও দেখা যায়নি পূর্ণ গ্যালারি; Image Source: Copa America

    লিভিয়ার বিপক্ষে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে টেক্সাসের ৮০ হাজার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এটি অ্যান্ড টি স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন ৪৭,৮৭৩ জন। দ্বিতীয় ম্যাচে আটলান্টায় পানামার বিপক্ষে ৭১,০০০ এর স্টেডিয়ামের ৫৯,১৪৫টা আসন পূর্ণ হয়েছিল। কানসাস সিটির অ্যারোহেড স্টেডিয়ামে, উরুগুয়ের বিপক্ষে আমেরিকার ১-০ ব্যবধানে পরাজয়া মাঠে বসে দেখেছেন মাত্র ৫৫,৪৬০ জন মানুষ, যেখানে স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ছিল ৭৬ হাজার। স্টেডিয়ামের ওপরের ফাঁকা অংশটা টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ছিলো বারবার। এবং বলা বাহুল্য, বেশ দৃষ্টিকটুই দেখাচ্ছিল দৃশ্যটা।

    ৪। কনকাকাফের দলগুলোর দুরবস্থা

    শুধু আমেরিকা নয়, কনকাকাফের অন্যান্য দলগুলোর ম্যাচেও দর্শকস্বল্পতা চোখে পড়েছে এবার। কনকাকাফের দলগুলোর মাঠের পারফরম্যান্সের দুরবস্থাও এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আমেরিকার মতো গ্রুপ পর্বের বাধা উতরাতে পারেনি মেক্সিকো, জ্যামাইকা আর কোস্টারিকা। কোয়ার্টার ফাইনালে গেলেও পানামা বড় ব্যবধানে হেরেছে কলম্বিয়ার কাছে। 

    ইকুয়েডর-জ্যামাইকা ম্যাচের দর্শকস্বল্পতা; Image Source: Getty Images

    ব্যতিক্রম বলতে শুধু কানাডার সেমিফাইনালে ওঠা। কিন্তু কানাডাকেও প্রায় প্রতিটা ম্যাচ খেলতে হয়েছে দর্শক-স্বল্প গ্যালারিতে। পেরুর বিপক্ষে কানাডার ম্যাচ দেখতে মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন মাত্র ১১,৬২২ জন দর্শক। অবশ্য এর পেছনে কানসাস সিটির আবহাওয়াও ছিল অন্যতম অনুঘটক। প্রবল উত্তাপে ম্যাচের একজন সহকারী রেফারিও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। 

    তবে কানাডার যে ম্যাচগুলোতে দর্শক-উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল, সেখানেও মূলত বিপক্ষ দলের সমর্থকেরাই বেশি ছিলেন। আর্জেন্টিনার ম্যাচে তো স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টাইন দর্শক দিয়ে গ্যালারি ছিল পূর্ণ, এর বাইরে চিলি এবং পেরুর বিপক্ষের ম্যাচেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। কানাডার খেলোয়াড়েরাও মেনে নিয়েছেন ব্যাপারটা।

    “আমাদের ফ্যানবেজটা যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তাতে এই ব্যাপারটা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে,” কানাডিয়ান ডিফেন্ডার অ্যালিস্টার জনস্টন বলেন, “আমাদের জাতীয় দলের ম্যাচগুলো সাধারণত এমন পরিস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয়, হয়তো দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপারটা আমাদের জন্যই ভালো। আমরা এর সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছি।”

    ৫। মেজর লিগ সকার চলমান থাকা

    আমেরিকার মাটিতে কোপা আমেরিকা অনুষ্ঠিত হলেও বন্ধ নেই মেজর লিগ সকার। আমেরিকান দর্শকদের মনোযোগ তাই কিছুটা হলেও সরে গেছে সেদিকে। আবার এমএলএস চলতে থাকায় কোপা আমেরিকার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে আমেরিকান ফুটবল বা এনএফএলের স্টেডিয়ামগুলো। প্রস্থে কিছুটা ছোট এই মাঠগুলো নিয়ে অভিযোগ এসেছিল দলগুলোর কাছ থেকেও।

    কোপা আমেরিকা চললেও বন্ধ নেই মেজর লিগ সকার; Image Source: Getty Images

    দুই বছর পরে ফুটবল বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হবে এই আমেরিকা-কানাডা-মেক্সিকোর মাটিতেও। সেই হিসেবে এই কোপা আমেরিকা হতে পারতো খুব ভালো ‘ড্রেস রিহার্সেল’। নতুন দর্শকদের কাছে যেমন খেলাটাকে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ ছিল, পাশাপাশি উত্তর আমেরিকায় ফুটবলের বাজারটা বুঝতে পারতেন আয়োজকেরা। ঠিক এই কারণেই, ইকুয়েডর থেকে যখন টুর্নামেন্টটাকে আমেরিকায় স্থানান্তরিত করা হলো, মোটাদাগে খুশিই ছিলেন আয়োজকেরা। টিকেটের দাম, যাতায়াতের অসুবিধাসহ অন্যান্য কারণে লাতিন আমেরিকানদের কাছে সিদ্ধান্তটা কিঞ্চিৎ অজনপ্রিয় হলেও, ফুটবলের উন্নতি আর বিস্তারের জন্যই নেওয়া হয়েছিল এমন সিদ্ধান্ত।

    তবে গ্যালারি যতই ফাঁকা থাকুক, ফুটবলের ভবিষ্যতের বাজার হিসেবে আমেরিকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছে না কনমেবল।

    “আমেরিকার দিকে নজর রাখতেই হবে, ২০২৬ বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজকও তারা,” পাম্পিদো বলেন, “তাদেরকে বিবেচনার বাইরে রাখার কোন সুযোগই নেই।” তিনি আরো বলেন, “ফুটবলে আমেরিকা বেশ উন্নতি করেছে। মেসির আগমনের পর সেটা আরো বেড়েছে। তাই ভবিষ্যতে যেকোন টুর্নামেন্টের আয়োজক হিসেবে আমেরিকার নামটা মাথায় থাকবে কনমেবলের।”

    কনমেবলের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেলের কথাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে ফুটবলের বিস্তারের জন্য আমেরিকা এক উর্বর ভূমি হতেই পারে, কিন্তু আপাতত স্টেডিয়ামের ফাঁকা গ্যালারিগুলো তো চোখে লাগছে!