• ইউরো
  • " />

     

    কার হাতে এবারের ইউরো ?

    কার হাতে এবারের ইউরো ?    

    রীতিমতো বিয়েবাড়ির সাজে সেজেছে স্তাদ দ্য ফ্রান্স। সার ধরে দর্শকদের অনিঃশেষ স্রোত মিশে যাচ্ছে মূল ফটকে। কোলাহল, উল্লাসে যেন কান পাতা দায়।টাকমাথার লোকটা অভ্যাসবশত ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলেন। এই স্টেডিয়ামে কত ম্যাচ দেখেছেন দর্শক হয়ে, গ্যালারিতে ক্যামেরা তো তাঁকে কম খুঁজে নেয়নি। কিন্তু আজ সেখানে তিনি অপাংক্তেয়। একরকম দয়া করেই তাঁকে গ্যালারিতে বসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সিংহাসন থেকে উৎখাত হওয়া রাজার কি রাজদরবারে আসা মানায়? ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার হতে তো তিনি চাননি। অথচ ওই গ্যালারিতে তাঁর থাকার কথা ছিল মধ্যমণি হয়ে। ক্যামেরার মুহূর্মুহূ ফ্লাশ তাঁর দিকে ঝলসে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু যে বিয়েবাড়িটা নিজের হাতে সাজিয়েছেন, সেখানেই এখন যেন একরকম অচ্ছুত। ৩২ বছর আগে এখানে যে শিরোপা হাতে নিয়েছিলেন, সেই শিরোপার লড়াই তাঁকে দেখতে হচ্ছে অনাহূত হয়ে। ফ্রান্সের ইউরো হচ্ছে, অথচ সেখানে মিশেল প্লাতিনি নেই, এক বছর আগেও কল্পনা করা দুঃসাধ্য ছিল! উয়েফার সাবেক সভাপতি ফুটবল থেকে নির্বাসিত, নিজের দেশটা এত অচেনা হবে, সেটা কি কখনো ভেবেছিলেন?

     

    কেন যেন ইউরো এলেই স্বাগতিকেরা কুঁকড়ে পড়ে, নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে থাকে। নিজেদের মাটিতে সর্বশেষ ইউরো জয়ের যে কীর্তি, তাতেও কিন্তু মিশেল প্লাতিনির নাম জড়িয়ে আছে। সেই ১৯৮৪ সালে প্যারিসে ট্রফি হাতে নিয়েছিলেন প্লাতিনি, এরপর থেকে স্বাগতিকদের কাছে ইউরো হয়ে আছে দুর্বোধ্য একটা প্রহেলিকা। জার্মানি, সুইডেন, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, ইউক্রেনের কেউই সেই ধাঁধার জট খুলতে পারেনি। একমাত্র কাছাকাছি গিয়েছিল ২০০৪ সালে পর্তুগাল, সেবার গ্রিক পুরাণের জিউস, হারকিউলিসেরা মর্ত্যভূমিতে নেমে আসায় তাদের সেই গেরোটা খোলা হয়নি। এবার ফ্রান্স কি সেটা খুলতে পারবে?

     

    কাগজ কলমে অন্তত সেই সম্ভাবনা আছে পুরোমাত্রায়। জিদান, পিরেসদের ওই সোনালী প্রজন্মের পর এই দলটাই তেরঙা ফরাসী পতাকা পতপত করে ওড়াচ্ছে। করিম বেনজেমার মতো স্ট্রাইকারকেও ছুঁড়ে ফেলার বিলাসিতা যে দল করতে পারে, তারা শিরোপার কত বড় দাবিদার, সেটা বলে না দিলেও চলে। পগবা, মার্শিয়াল, গ্রিয়েজমান, মাতুইদি, পায়েটদের বুটেই সবাই দেখতে পাচ্ছেন ফরাসী সৌরভের আভাস।এমনকি লেস্টার সিটির রূপকথার শিরোপা জয়ের অন্যতম কুশীলব অ্যাঙ্গোলো কান্তেরও বেঞ্চে বসে থাকতে হতে পারে! ফরাসী দুর্গের পতনে একদিন যে উল্লাস হয়েছিল, সেটা নিশ্চয় পগবারা আরেকবার হতে দেবে না!

     

    সেই পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা কে? সবার আগে অবশ্যই জোয়াকিম লোর জার্মানির নামটা আসবে। “পাওনা” বিশ্বকাপটা দুই বছর আগেই হাতে নিয়েছে জার্মানি। এবার ইউরোর অনেক দিন ধরে জমে থাকা ঋণ বুঝিয়ে দেওয়ার সময়। সেই ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে “মিত্রপক্ষকে” হারিয়ে দিয়ে এসেছিল, এবার আরেকটি মিত্রশক্তির মাটিতে জার্মান-যন্ত্রের রাজ্যজয়ের মিশন। দুই বছর আগের সেই দলের প্রায় সবাই এবার আছেন। তবে একজনের অনুপস্থিতিটা এখনো কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। ফিলিপ লামের বিকল্প জার্মানি যে এখনো খুঁজে ফিরছে। আর দুই বছর আগের মতো এবারও দর্শক হয়ে দেখতে হচ্ছে মার্কো রয়েসকে, সেটাও তো কম ট্র্যাজেডি নয়! তারপরও ক্রুস, মুলার, গোটশেদের সঙ্গে অধিনায়ক শোয়েনস্টাইগারকে নিয়ে জার্মানি এখনো বড় হুমকি। কিন্তু শিরোপার পথে সবচেয়ে বড় বাধাটা যে জার্মানিকে ফাইনালের আগেই পেরুতে হবে। নিজেদের গ্রুপে যদি দুই দলই চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে জার্মানির সঙ্গে তো সেমিফাইনালেই দেখা হয়ে যেতে পারে ফ্রান্সের।

     

    এদিক দিয়ে ভিসেন্তে দেল বস্কের স্পেন বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। গ্রুপ পর্বে প্রথম হয়ে পেরুতে পারলে সেমিফাইনাল পর্যন্ত রাস্তাটা তাদেরই সবচেয়ে মসৃণ। সেমিফাইনালের আগে বড় মুখদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অন্তত কোয়ার্টার ফাইনালের আগে গ্রুপ চ্যাম্পিয়দের কাউকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেতে হচ্ছে না। কিন্তু পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাওয়া স্পেন যে নিজেদের ওপরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। বিদায়ী কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক নিজেই যখন স্বীকার করেছেন, এই দলে কিছু দুর্বলতা আছে- তাদের ওপর ভরসা রাখা তো কঠিনই। সেনাপতির পাই যখন কাঁপতে থাকে, সৈন্যরা যুদ্ধজয় করবেন কীভাবে? নাকি নিজেদের ওপর থেকে মনযোগ সরাতেই এই কৌশল এঁটেছেন সেনাপতি?

     

    সেই হাকডাকটা এবার আরেক “পরাশক্তির” অনেকটাই কম। বড় টুর্নামেন্ট এলে প্রতিবারই তাদের প্রচারমাধ্যম পারলে শিরোপাটা হাতে তুলে দেয়, কিন্তু প্রতিবারই অসারের তর্জন গর্জন সার। সেই ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ শিরোপাস্মৃতির জাবর কেটেই এখনো দিন পার করতে হচ্ছে ইংল্যান্ডকে। তবে এবার সেই ডামাডোল যেন কিছুটা কম। “বিখ্যাত‘ ইংলিশ মিডিয়া এবার অনেকটাই চুপচাপ। তারুণ্যের ঝান্ডা ওড়ানো ডেলে আলি, রস বার্কলে, হ্যারি কেনদের নিয়ে এবার অতটা শোরগোল নেই। জেমি ভার্ডির মতো রূপকথার কুশীলবকেও নিয়ে নেই সেভাবে মাতামাতি। ইংল্যান্ডের ১৯৬৬ বিশ্বকাপের নায়ক জিওফ হার্স্ট অবশ্য বলে দিয়েছেন, ওই বিশ্বকাপের পর এটাই তাঁর দেখা সবচেয়ে প্রতিভাবান ইংল্যান্ড দল।কিন্তু দলটা যখন ইংল্যান্ড, তখন আরও একবার সমর্থকেরা বোধহয় হাপিত্যেশ করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেই ভালো করবেন!

     

    সেই আফসোস একজন অন্তত এবার করতে চাইবেন না। ক্লাবের হয়ে সব পেয়েছেন, দেশের হয়ে কিছু একটা করার এটাই সম্ভবত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সবচেয়ে সেরা সুযোগ। ২০০৪ সালের পর্তুগালের পর এবারের দলটাই হয়তো সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। ড্যানিলো, আন্দ্রে গোমেস, উইলিয়াম কারভালহো, রেনাটো সানচেজদের মধ্যমাঠ মুখর নতুনের জয়ধ্বনিতে। পেপে, ফন্টে, ব্রুনো আলভেসরাও এখন পোড় খাওয়া। শুধু গোল করার লোকটারই অভাব, সেই কাজটা করার দায়িত্ব বোধ হয় রোনালদোকেই একা নিতে হবে।

     

    এই যা, এতকিছুর মধ্যে ইতালির নামটা তো বলা হয়নি! খুব সম্ভবত আন্তোনিও কন্তের এই ইতালি স্মরণকালের সবচেয়ে খর্বশক্তির। জুভেন্টাসের রক্ষণত্রয়ী আর চিরবিশ্বস্ত জিয়ানলুইজি বুফন ছাড়া এই দল তো একেবারেই নখদন্তহীন। কিন্তু দলটা যখন ইতালি, তাদের নিয়ে শেষ কথা বলার উপায় কী? হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যে দলটা আমূল বদলে যেতে পারে, সেটা তো ফুটবল ইতিহাস কম দেখেনি!

     

    ও হ্যাঁ, বেলজিয়ামের নামটা বোধ হয় বাদ পড়ে গেল। স্কোয়াডের দলবদলের মূল্য হিসেব করলে বেলজিয়ামই ইউরোর সবচেয়ে দামি দল, কাগজে কলমেও বোধ হয় সবচেয়ে শক্তিশালীর একটি। ডি ব্রুইন, লুকাকু, হ্যাজার্ডরা নিজেদের দিনে একটা মুহূর্তেই ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন। কিন্তু ফুটবলটা যে শেষ পর্যন্ত দলীয় খেলা, সেটা এই বেলজিয়ামকে দেখেই বোঝা যায়। এত সব বড় মুখ নিয়ে মন ভরানোর মতো খেলা খেলতে পারল কই? এই ইউরোতে সেরকম কিছু করা মুশকিলই হয়ে যাবে।

     

    ১০

    তাহলে শেষ কথা কী দাঁড়াল? সমান্তর ধারা অনুযায়ী এবার ফ্রান্সের পালা। ১৯৮৪ সালের পর ২০০০ ইউরো, ১৬ বছর পর শিরোপা তো তাদের কাছেই যাওয়া উচিত। কিন্তু সমান্তর ধারা এও বলছে, ১৯৯২ সালে ডেনমার্কের ১২ বছর পর আরেক বিস্ময় গ্রিস জিতেছিল শিরোপা। আবার ১২ বছর পর কি এবার নতুন রূপকথা হবে? কিন্তু সেটা জন্ম দেবেই বা কারা ? সেটা আপাতত অনুমান নাই করি। হোক না এবারের ইউরো নতুন কারও!