পাঁচ বছর অপেক্ষা, ফিরেই পাঁচ উইকেট!
‘পুশ-আপ’, মিসবাহ-উল-হকের মতো করেই। হঠাৎ করেই যেন। বলটা উঁচু করে ধরে এজবাস্টনের দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছিলেন, তারপর সে বল সামনে রেখেই শুরু করলেন ‘পুশ-আপ’ দেয়া। তবে মিসবাহ বা লর্ডস টেস্ট জিতে যাওয়া গোটা পাকিস্তান দলের মতো করে নয়। একটা করে ‘পুশ’ এর পর যখন ওঠেন, একটা করে তালি দেন! ধারাভাষ্যে ডেভিড লয়েড গুনতে শুরু করলেন, নয় পর্যন্ত গুনলেন। তবে আশেপাশে থাকা সতীর্থরা গুনছিলেন, তাঁদের মতে দশ। সোহেল খান, উদযাপনই বলে দেয়, দারুণ কিছু করেছেন তিনি!
দারুণ তো বটেই। পাঁচ বছর পর টেস্টে খেলতে নেমেই পেয়েছেন পাঁচ উইকেট! এই টেস্টের আগে খেলেছিলেন দুই টেস্ট, গড় ছিল ২৪৫! ৫৭ ওভার বল করে একটিই উইকেট পেয়েছিলেন যে। তবে সোহেলের এখনকার গড়টা এক লাফে হয়ে গেছে ৫৬.৮৩! একটা সুযোগ পেলেই কিছু একটা করে দেখাবেন, ভাবতেন বোধহয় এমনই। সোহেলের ভাবনার সেই পরিধিটা বিস্তৃত হয়েছিল পাঁচ বছর জুড়ে!
ডানহাতি এই পেসারের প্রথম শ্রেণির অভিষেক ২০০৭-০৮ সেশনে। প্রথম নয় ম্যাচে ৬৫ উইকেট, ইনিংসে পাঁচ উইকেট আটবার! জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ২০০৮ সালে ওয়ানডে অভিষেকটাও তাই হয়েই গেল। পরের বছর টেস্ট অভিষেক, করাচীতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। ইউনুস খানের সেই ট্রিপল সেঞ্চুরির ম্যাচে। ২৭ ওভার বল করে ১৬৪ রান, অভিষেকে উইকেটবিহীন সবচেয়ে খরুচে বোলিং ফিগারের রেকর্ডটাই নিজের করে নিলেন সোহেল খান(এখন রেকর্ড ভারতের পঙ্কজ সিংয়ের, ২০১৪ সালে ১৭৯ রান দিয়ে উইকেটশুন্য অভিষেক হয়েছিল তাঁর ইংল্যান্ডের সঙ্গে)!
পরের টেস্টে বাদ পড়লেন সোহেল, লাহোর আক্রমণের ঘটনা ঘটলো। পাকিস্তান থেকে ক্রিকেট নির্বাসনে গেল। পাকিস্তানের ক্রিকেট থেকেও নির্বাসনে গেলেন সোহেল খান। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সিরিজে ফিরলেন এক ওয়ানডে ও এক টেস্টের জন্য। প্রথম ইনিংসে যে উইকেটটি পেলেন, সেটির স্মৃতি নিয়েই বোধহয় কাটিয়ে দিলেন পাঁচ বছর!
অবশ্য রঙ্গিন পোশাকে হঠাৎ করেই ফিরলেন। গত বছরের বিশ্বকাপে। বয়স ত্রিশ পার হয়ে গেছে ততোদিনে। বাংলাদেশ সফরের দলে ছিলেন, কন্ডিশনিং ক্যাম্পে বোলিং করতে গিয়ে পেলেন চোট। সোহেল খানের নির্বাসন ফিরে এল আবার!
আরেক পেসার ওয়াহাব রিয়াজের চোট সুযোগ করে দিল, স্বপ্নের সাদা পোশাকটা আবার গায়ে চড়ানোর। এজবাস্টন, ২০১৬। সোহেল খানের ‘নির্বাসন’ থেকে ফেরার দিন, সোহেল খানের স্বপ্নপূরণের দিন!
হারিয়ে যেতে নেই মানা!
সর্বোচ্চ গতি কতো হবে, ঘন্টায় ৮৫ মাইলের মতো। সিম পজিশন যে সবসময় ঠিক থাকছে তাও নয়। ব্যাটসম্যানরা যেসব বলে মারছেন, মার দেয়ার মতোই বল! তবে সোহেলের যেটা আছে, সেটা হলো একটা জায়গা ধরে বল করে যাওয়া। শর্ট-অফ-আ-গুড-লেংথ থেকে গুড লেংথ, সোহেল বল করে গেছেন এই অঞ্চলেই। লাইনটাও ধরে রেখেছেন, স্ট্যাম্পের ওপর থেকে অফস্ট্যাম্পের বাইরে। লেগস্ট্যাম্পের বাইরে বল করেছেন মোটে তিনটা!
লাইনের ওপর এই নিয়ন্ত্রনের প্রথম ফলটা মিললো অ্যালেক্স হেলসকে আউট করে। পেছনে ক্যাচ দিলেন হেলস। পরের তিনটি উইকেটও পেলেন একইভাবে, ব্যাটসম্যানের ‘এজ’ হয়, পেছনে ক্যাচ যায়। জো রুট, জেমস ভিনস, জেমি বেইরস্টো। রুট ড্রাইভ করতে যান, ভিনস ডিফেন্সিভ শট খেলেন, বেইরস্টো থার্ডম্যানে খেলতে যান। কেউ সফল হন না। সোহেল খান উল্লাসে মাতেন। পাঁচটা বছরের অপেক্ষার জ্বালা বোধহয় কমে এক এক করে!
মঈন আলী, ক্রিস ওকস, স্টুয়ার্ট ব্রডের উইকেট নেন মোহাম্মদ আমির ও রাহাত আলী। সোহেল আরেকবার অপেক্ষা করতে থাকেন। পাঁচ উইকেটের। স্টিভেন ফিন আবার ‘খাঁটি’ ব্যাটসম্যানের মতো করে চার মারেন, স্ট্রেইট ড্রাইভে, পুল করে। সোহেলের অপেক্ষা বাড়তে থাকে। এরপরই নতুন বলে ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকা বলটা মিস করে জিমি অ্যান্ডারসনের ব্যাট। আম্পায়ার ব্রুস অক্সেনফোর্ড আউট দিলেন, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন সোহেল। তবে জিমির রিভিউ আরেকবার অপেক্ষা করালো সোহেলকে।
জিমির রিভিউ কাজে দিল না। সোহেল উল্লাসে মাতলেন। সতীর্থদের অভিনন্দনে সিক্ত হলেন। তারপর পুশ-আপ দেয়া শুরু করলেন! এ বয়সেও যে তিনি ফুরিয়ে যাননি, মিসবাহর মতো করে যেন সেটাই দেখালেন এজবাস্টন টেস্টের প্রথম ইনিংসে!
৩২ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো পেসারের জীবনে যদি আরেকটা সুযোগ আসে, সেটা কিভাবে লুফে নিতে হয়, সোহেল যেন তা দেখালেন আরেকবার!