• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    মরিনহোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড!

    মরিনহোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড!    

    চেলসিকে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা এনে দেয়ার সাত মাস না পেরুতেই আবারও ছাঁটাই! মাঝখানে মেডিকেল স্টাফের সাথে উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। সেই 'অভিশাপে' ডিসেম্বরের আগেই মরিনহোর দলের ৯ জন খেলোয়াড়ই ইনজুরড! প্রথম ষোল ম্যাচের ৯টিতেই হারল মরিনহো চেলসি, জয় মাত্র চারটিতে। অথচ গেল মে মাসেই কী দাপট দেখিয়ে প্রিমিয়ার লিগ জিতে নিয়েছিল ব্লুজরা! চেলসিকে টালমাটাল অবস্থায় রেখেই আরও একবার 'স্যাকড' হলেন পর্তুগিজ ম্যানেজার।

    ওই একই মাসে ভ্যান গালের ওপর বিরক্তির ঝাঁঝটা যেন বাড়তে শুরু করল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের। ভ্যান গালের 'বোরিং' ফুটবলে যে নেই গোলের দেখা। অবনমন অঞ্চলে থাকা দলের সাথেও তিন পয়েন্ট যেন সোনার হরিণ। অথচ কয়েকটা বছর এই দলটাই মৌসুমের ৩৮ ম্যাচই মাঠে নামতো জয়ের আশায়! 

    স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিদায়ের পর থেকেই অধারাবাহিক। ডেভিড ময়েসের সময়টা তো বিরক্তিভরে এড়িয়েই যান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকেরা। লুই ভ্যান গালও পারেননি প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে।  

    ২৭ বছর এক ম্যানেজারের অধীনে থাকার পর মাত্র তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় ম্যানেজার হিসেবে হোসে মরিনহোর আগমনটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য তাই স্বস্তিই বয়ে এনেছে। স্যার অ্যালেক্সের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটাতেই হয়ত বসতে চেয়েছিলেন মরিনহো নিজেও। দেরীতে হলেও স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই পর্তুগিজেরও।

    রোমান্টিক ক্লাবের ম্যানেজার এখন ‘স্পেশাল ওয়ান’! এভাবে ডুবতে বসা দলের হাল আগে কখনও ধরেননি মরিনহো। এক ক্লাবে বেশিদিন টিকতে না পারার জন্য লোকের কথা শুনতে হয় এই ভদ্রলোককে। বিশেষ করে দ্বিতীয়বারে চেলসি থেকে ছাঁটাই হওয়াটা পর্তুগিজ ম্যানেজারের সামর্থ্যের ওপরই প্রশ্ন তোলে। 'শর্ট টাইম সল্যুশন'- আর যা হোক, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের সঙ্গে বড্ড বেমানান! মরিনহোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অধ্যায়টা তাই নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করারও সুযোগ।

    আর ইব্রাহিমোভিচ, পগবা, মিখতিরিয়ানদের নিয়ে নতুন দল গড়লেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেরও সাফল্য নির্ভর করছে আসলে মরিনহোর ওপরই। বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় পগবা অথবা ফ্যান ফেভারিট ইব্রা নন, লাইম লাইটটা থাকছে তাই মরিনহোর ওপরেই। ‘স্পেশাল ওয়ান’ নামকরণের স্বার্থকতাটা বোধ হয় এখানেই!

    নতুন মৌসুমে মূল লক্ষ্য চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেয়া। তবে তৃতীয় বা চতুর্থ হয়ে পরের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে ঠাই পেলে রেড ডেভিল সমর্থকদের মন গলাতে হয়ত ব্যর্থই হবেন মরিনহো। গত তিন মৌসুম শিরোপা লড়াইয়ে থাকতে না পারার হতাশা থেকে বের করে আনতে পারলেই  হয়ত মৌসুমটা সফল বলা যাবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য।

    এবারও সেই ডি গিয়া
     
    ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গত তিন মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় স্প্যানিশ এই গোলকিপারই। একজন গোলকিপার গত তিন মৌসুম ধরে দলের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটা অবশ্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দূরাবস্থারই ইঙ্গিতই দেয়। ইউনাইটেড ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ভালো ফর্মে থাকা ডি গিয়ার কাছে মরিনহোর বাড়তি চাওয়া থাকবে কমই। বড় ধরনের ইনজুরি সমস্যায় আক্রান্ত না হলে আরেক গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোকে আরও একটি মৌসুম পার করতে হবে সাইড বেঞ্চ গরম করেই। প্রাক-মৌসুম ম্যাচগুলোতেও সেই ইঙ্গিতই দিয়ে রেখেছেন মরিনহো!

    রক্ষণই সেরা আক্রমণ!

    ইব্রাহিমোভিচকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে এনে সমর্থকদের মন জয় করেছেন মরিনহো। ঘরের ছেলে পগবাকে ঘরে ফিরিয়ে দেখিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন লিগে জায়গা না পেলেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এখনও যে কোনো খেলোয়াড়কেই কেনার সামর্থ্য রাখে। আর নিজের ‘সেন্সিবল’ তকমার পরিচয়টা দিয়েছেন ডিফেন্ডার এরিক বেইলিকে দলে এনে। কমিউনিটি শিল্ডের ম্যাচে লেস্টার সিটির বিপক্ষে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়ে মরিনহোর ভরসার প্রতিদানও এরই মধ্যে দিতে শুরু করেছেন এরিক বেইলি।

    স্মলিং, বেইলির সেন্ট্রাল ডিফেন্সের জুটিটা চীনের প্রাচীর বানাতে মরিনহোর চেয়ে বেশি পারদর্শী আর কেইবা আছেন! নিজের প্রথম চ্যালেঞ্জ হিসেবে মরিনহো নিজেও দেখছেন রক্ষণদূর্গের ‘সংস্কারটা’। তবে গত মৌসুমে টটেনহ্যামের সাথে সবচেয়ে কম গোল হজম (৩৫) করা দলটার নামও যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড! তাতে অবশ্য ইউনাইটেড ডিফেন্সের চেয়ে ডেভিড ডি গিয়ার অতিমানবীয় কিছু পারফরম্যান্সই ‘দায়ী’। গত মৌসুমে গোল কম হজম করলেও, ডিফেন্সের দুর্দশাটা ছিল স্পষ্টই।



     

    গত মৌসুমের বেশীরভাগ সময়ই সেন্ট্রাল ডিফেন্সে পার করা ড্যালে ব্লিন্ডের নতুন অবস্থান ডিফেন্সেই নাকি মিডফিল্ডে হবে সেটা এখনই অনুমান করা কঠিন। কমিউনিটি শিল্ডের ম্যাচে ব্লিন্ডকে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে খেলিয়ে সবাইকে অবাকই করেছেন মরিনহো। তবে লুক শ এর ফেরত আসাটা নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যোগ করবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রক্ষণে। সেক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করার লড়াইয়ে নামতে হবে মার্কোস রোহোকে। রাইটব্যাক পজিশনে আগের মৌসুমে অধারাবাহিক ডারমিয়ানের লড়াইটা হবে  জোন্স আর অ্যান্টোনিও ভ্যালেন্সিয়ার সাথে। ইকুয়েডরের এই মিডফিল্ডার গত দুই মৌসুমে বেশ ক’বারই সামলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডান প্রান্ত।

    নতুন মিডফিল্ড!

    মরিনহোর কৌশলের জন্য পগবার চেয়ে উপযুক্ত মিডফিল্ডারের সংখ্যাটা বাজারে খুব বেশি নয়। চেলসিতে থাকার সময়ও পগবার পেছনে বেশ কিছুদিন মরিনহো ঘুরেছেন বলেও গুজব রয়েছে। পগবার সাথে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যুক্ত হয়েছেন হেনরিক মিখতিরিয়ান। বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে কাজ করবেন মরিনহোর ট্রাম্প কার্ড পগবা। আর দুই উইং এ ধরে প্রতিপক্ষ দলের ত্রাস ছড়ানোর দায়িত্বটা মারশিয়াল আর মিখতিরিয়ানের ওপরই বর্তাবে।

    আক্রমণভাগে ইব্রাহিমোভিচ থাকায় আর একজন স্ট্রাইকার খেলানোয় মরিনহোর খ্যাতি থাকায় রুনিকে হয়ত নেমে আসতে হবে মিডফিল্ডেই। সাথে অভিজ্ঞ ক্যারিক তো আছেনই। ব্লিন্ড, মাতা লিনগার্ড, ভ্যালেন্সিয়ারাও বাড়তি মাত্রা যোগ করবেন ইউনাইটেডের মিডফিল্ডে।


     

    ভ্যান গালের কৌশলে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করে খেলার যে প্রবণতা ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের, মরিনহোর আমলে তেমনটা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মরিনহোর ৪-২-৩-১ ফরমেশনে দুই মিডফিল্ডারই আসলে পালন করবেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা। সাধারণত শারীরিক সক্ষমতা আর কৌশল দুইয়ের মিশ্রণে গড়া খেলোয়াড়ই ওই দুই পজেশনে জায়গা পান বেশি মরিনহোর ট্যাকটিকসে। 

    অন্যদিকে মরিনহোর কৌশলে শোয়েন্সটেইগারের না থাকার গুজবটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। জার্মান এই মিডফিল্ডারের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়াটা মনে হচ্ছে এখন সময়ের ব্যাপার।

    ওল্ড ট্রাফোর্ডের ‘গড’ হবেন ইব্রাহিমোভিচ?

    ৩৪ বছর বয়স হয়ে গেলেও ইব্রাহিমোভিচের ধারটা যে আগের মতোই আছে সেটা বোঝা গিয়েছে কমিনিউটি শিল্ডেও। ৩০ ছোঁয়া আরেক স্ট্রাইকার রুনির সাথে ইব্রাহিমোভিচের পরিংখ্যান বলছে আক্রমণভাগে ইব্রাহিমোভিচই প্রতিপক্ষের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর। আক্রমণভাগে স্ট্রাইকার হিসেবে ইব্রাহিমোভিচের ওপরই বর্তাবে গোল করার গুরু দায়িত্ব। ওল্ড ট্রাফোর্ডের ‘গড’ হবার ঘোষণা দিয়ে এসেছেন যিনি তাঁর কাছ থেকে মৌসুমে বিশ গোল আশা করতেই পারেন ইউনাইটেড সমর্থকেরা।  

    আগের মৌসুমে গোলের দেখা পেতে ভালোই বেগ পেতে হয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। একের পর এক প্রথমার্ধে গোল করতে না পারা, এক মারশিয়াল বাদে লিগে আর কোনো খেলোয়াড়ের গোলের সংখ্যা দুই অঙ্কে না পৌঁছনো- সবই ছিল হতাশার। শেষ দিকে এসে হাল ধরেছিলেন তরুন র‍্যাশফোর্ড। সেই হতাশা মোচনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ইব্রাহিমোভিচই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষের দিকে চলে আসা একজন স্ট্রাইকারের ওপর আর কতোই ভরসা করা যায়? সবকিছুর পরেও তাই সেই মারশিয়াল, র‍্যাশফোর্ড আর 'স্ট্রাইকার' রুনির মাঠে নামতে হবে গোলের জন্যই।

    তরুণ খেলোয়াড়দের সুযোগ দিতে 'কার্পন্য' করার জন্য প্রায়ই নিন্দুকের খোটা শুনতে হয় মরিনহোকে। তাঁর আমলে যদি র‍্যাশফোর্ড, মারশিয়ালদের উন্নতির গ্রাফটা থমকে যায় সেই ক্ষোভটা সামাল দেয়া কঠিনই হয়ে পড়বে পর্তুগিজ কোচের জন্য!

    সম্ভাব্য ফরমেশনঃ

    বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় পল পগবা মরিনহোর ৪-২-৩-১ ফরমেশনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন কি না সে প্রশ্নের জবাবটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। তবে অতীত কিন্তু বলছে এই ফরমেশনে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না এই ফ্রেঞ্চ। জুভেন্টাসে থাকতেও, ৩-৫-২ ফরমেশনে নিজের সেরা খেলাটা দেখিয়েছেন। ইউরো চলাকালীকন গ্রিযম্যানকে সুবিধা করে দিতে ফরমেশন বদলে ৪-২-৩-১ করায় সেখানেও খেই হারিয়েছিলেন পগবা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ৩-৫-২ ফরমেশন কার্যকরী ফল দিতে পারবে না বলেই মনে করেন অনেকে। সেক্ষেত্রে ৪-৩-৩ ফরমেশনে পগবা সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। অন্যদিকে ইব্রাহিমোভিচও কিছুটা নিচে এসে খেলার সুযোগ পাবেন এই ফরমেশনে। কাগজে-কলমে মারশিয়ালের জন্যও মন্দ নয় ৪-৩-৩। তবে পুরোটাই আসলে নির্ভর করছে মরিনহোর সিদ্ধান্তের ওপর।