• সিরি আ
  • " />

     

    একজন পিন্তুরেচ্চিওর গল্প

    একজন পিন্তুরেচ্চিওর গল্প    

    ১.

    ১৯৮২ এর কোনো এক শীতের রাত। কাজকর্ম সেরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন গিনো দেল পিয়েরো। গ্যারেজের সামনে আসতেই শুনতে পেলেন স্ত্রী ব্রুনার চেঁচামেচি। রাত হয়ে গেছে, বড় ছেলে ঘরে ফিরলেও এখনো আপন মনে খেলে যাচ্ছে ছোটজন। বড় ছেলে স্টেফান ইতোমধ্যেই এলাকার বেশ ডাকাবুকো খেলোয়াড় বনে গিয়েছে। কিন্তু বড়জনের চেয়ে ছোটটার খেলা নিয়ে আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল গিনোর। ছেলের খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য গাড়িটা গ্যারেজের বাইরে পার্ক করলেন। ছেলের সাথে নিজেও খেললেন কিছুক্ষণ। সেদিন কে জানতো, কনগ্লিয়ানো শহরের দেল পিয়েরো দম্পতির গ্যারেজেই হাতেখড়ি হচ্ছে ইতালির এক অনবদ্য কিংবদন্তীর...

     

    ২.

    আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোর শুরুর গল্পটা এমনই। ১৯৭৪ সালের ৯ নভেম্বর ইতালির কনগ্লিয়ানোয় জন্ম তাঁর। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল পাগল ছিলেন। বড় ভাইয়ের স্টেফানই ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। মজার ব্যাপার হল, ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ডের শুরুটা হয়েছিল গোলরক্ষক হিসেবে। বাড়ির পেছনের উঠোনে আলেসান্দ্রোর জোরালো গোল কিক, লম্বা পাস দেখে স্টেফানই আলেসান্দ্রোকে বললেন, ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতে। নিজের উপদেশটা এত ভালভাবে ফলবে, এমনটা হয়তো স্টেফান নিজেও ভাবেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সিরি বি-এর পাডোভার যুব দলে যোগ দেন 'এডিপি'। '৯১-'৯২ মৌসুমে মাত্র ১৬ বছর বয়সে জায়গা করে নেন পাডোভার মূল দলে। অভিষেকের জন্য অবশ্য বছরখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল দেল পিয়েরোকে। নিজের প্রথম সিনিয়র মৌসুমেই পারফরম্যান্স দিয়ে নজর কাড়েন একাধিক বড় ক্লাবের। শেষমেশ ১৯৯৩ সালে ২.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দেল পিয়েরোকে দলে ভেড়ায় জুভেন্টাস। ১৯ বছরের এক তরুণের জন্য এত অর্থ খরচ করাটা কিছুটা বেমানানই ঠেকেছিল জুভেন্টাস সমর্থকদের কাছে। নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তাই দেল পিয়েরো প্রতিজ্ঞা করলেন, ক্লাবের আস্থার প্রতিদানটা মাঠেই দেবেন। জুভেন্টাসে প্রথম মৌসুমটা কাটলো সাব হিসেবেই। তুরিনের বুড়িদের হয়ে নিজের প্রথম স্টার্টেই পার্মার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক দিয়ে নিজের ক্ষমতার কথা জানান দিয়ে রাখলেন। ঐ মৌসুমে ১৪ ম্যাচে গোল পেলেন মোটে ৫টি। তুরিনের সম্রাট হওয়ার যাত্রাটা শুরু হল পরবর্তী মৌসুম থেকেই।

     

    একজন দশ নম্বরের উত্থান

    '৯৪-'৯৫ মৌসুমে দলের প্রাণভোমরা রবার্তো বাজ্জিওর ইঞ্জুরিতে কপাল খোলে দেল পিয়েরোর। দেল পিয়েরো-ভিয়ালি-রাভানেল্লিদের কল্যাণে দীর্ঘ ৯ বছর পর 'স্কুডেট্টো' জিতলো জুভেন্টাস। পার্মাকে হারিয়ে সেবার ইতালিয়ান কাপও জিতে নেয় তুরিনের বুড়িরা। সারা বছরের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কারণে '৯৫ ব্যালন ডি অরে চতুর্থ হন আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো।

     

    '৯৫-'৯৬ মৌসুমে বাজ্জিও এসি মিলানে যোগ দিলে জুভেন্টাসের দশ নম্বর জার্সি ওঠে দেল পিয়েরোর গায়ে। আবারো পার্মাকে হারিয়ে টানা দুবার ইতালিয়ান কাপ জিতে নেয় জুভেন্টাস। এই মৌসুমেই আসে জুভেন্টাসের জার্সিতে দেল পিয়েরোর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আয়াক্সকে পেনাল্টিতে হারিয়ে সুদীর্ঘ এক যুগ পর নিজেদের দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে জুভেন্টাস। পরের মৌসুমে ব্যালন ডি অর নমিনেশন পান, কাকতালীয়ভাবে আবারো হন চতুর্থ। '৯৫ থেকে '৯৮-টানা চার বছর ব্যালন ডি অরের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন 'কিং আলে’।

     

    ১৯৯৮ থেকে ২০০০-বছর তিনটি খুব সম্ভবত দেল পিয়েরোর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অপয়া সময় ছিল। হাঁটুর গুরুতর ইঞ্জুরি, পারফরম্যান্স বর্ধক ড্রাগ নেওয়ার অভিযোগ- সব মিলিয়ে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন 'ইল পিন্তুরেচ্চিও'। দেল পিয়েরোর অভাবটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল জুভেন্টাস। দলের প্রাণভোমরাকে ছাড়া '৯৮-'৯৯ লিগ মৌসুম ৬ষ্ঠ স্থানে শেষ করে তুরিনের বুড়িরা। '০১-'০২ মৌসুমে জুভেন্টাসে প্রিয় গুরু মার্সেলো লিপ্পির প্রত্যাবর্তনে কপাল ফেরে 'এডিপি'র। ত্রেজেগে, নেদভেদদের নিয়ে জুভেন্টাসের ২৬তম লিগ শিরোপা জয়ে অন্যতম ভূমিকা রাখেন জুভেন্টাস কাপ্তান।

     

    কালসিওপোলি ও দেল পিয়েরোঃ

    ’৯৫-’৯৬ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের টাইব্রেকারে দেখেছিলেন মুদ্রার এপিঠ। ‘০২-'০৩ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের টাইব্রেকারে দেখতে হল মুদ্রার ওপিঠ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানের কাছে পেনাল্টিতে হেরে তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় জুভেন্টাস ও দেল পিয়েরোর।

    তবে ক্যারিয়ারের কঠিন সময়টা আসে ২০০৫ সালে। ইতালিয়ান ফুটবলের অন্যতম নিন্দিত ঘটনা 'কালসিওপলি' ঘটে এর পরের মৌসুমেই। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে দুটি সিরি আ শিরোপা ছিনিয়ে নেওয়া হয় জুভেন্টাসের থেকে। শাস্তিস্বরূপ নামিয়ে দেওয়া হয় সিরি বি-তে। ইব্রা, ক্যানাভারো, থুরাম, জাম্ব্রোতা, ভিয়েরা- ক্লাবের দুর্দিনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু ক্লাবের পাশে ঠিকই ছিলেন একজন, আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো। ক্লাবের অন্যান্যদের উদ্দ্যেশ্যে বলেছিলেন, "একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক কখনো তার অর্ধাঙ্গিনীকে ছেড়ে যান না"।

     

    ভস্ম থেকে পুনরুত্থানঃ

     

     

    ২০০৬ সালটা দেল পিয়েরো ভুলে যেতে চাইবেন। ইঞ্জুরি, বাহ্যিক বিতর্ক যেন পিছুই ছাড়ছিল না। বিশ্বকাপের আগে তো মনোবিদেরও শরণাপন্ন হয়েছিলেন! কিন্তু অন্ধকারের কালো মেঘ মিলিয়ে যায়  '০৬ বিশ্বকাপের পর। বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে জিদানের ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সুদীর্ঘ দুই যুগ পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। ম্যাচ শেষে আবেগাপ্লুত দেল পিয়েরো বলেন, "বছরটা আমার জন্য খুবই খারাপ যাচ্ছিল। বিশ্বকাপে আসার আগে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বিশ্বকাপ জিততেই হবে, যেভাবেই হোক। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় আশা পূর্ণ হল"। ইতালির হয়ে ৯১টি ম্যাচ খেলেছিলেন দেল পিয়েরো, গোল করেছিলেন ২৭টি। ১৯৯৫ সালে এস্তোনিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল 'কিং আলে'র। ইউরো '০০ তে রানার আপ হওয়ার কষ্ট মিলিয়ে যায় '০৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর। ২৭ গোল নিয়ে এখনো ইতালির সর্বকালের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা দেল পিয়েরো।

     

    ও কিং, মাই কিং:

    সবাইকে অবাক করে '১১-'১২ মৌসুমের শুরুতেই জুভেন্টাস প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেয়া আনেল্লি জানিয়ে দেন, জুভেন্টাসের জার্সিতে এটিই দেল পিয়েরোর শেষ মৌসুম। ক্লাবের এই মহীরুহের সাথে চুক্তি নবায়ন করবেন না বলে জানিয়ে দেয় আনেল্লি। মৌসুমের শেষদিকে লাৎসিওর বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে জুভেন্টাসের জার্সিতে ৭০০ ম্যাচ পূরণ করেন দেল পিয়েরো।

     

    ১৩ মে, ২০১২। আটালান্টার বিপক্ষে মৌসুমের শেষ ম্যাচ। জুভেন্টাসের সাদা-কালো জার্সিতে এটিই ছিল দেল পিয়েরোর শেষ লিগ ম্যাচ। শেষ ম্যাচেও নিজের দাগটা ঠিকই রেখে গেছেন 'কিং আলে'। ২৭ মিনিটেই গোলের দেখা পেয়ে যান দেল পিয়েরো। ৫৭ মিনিটে যখন তাকে উঠিয়ে নিচ্ছিলেন কন্তে, সমগ্র জুভেন্টাস স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে অশ্রুভেজা চোখে বিদায় জানাচ্ছিল তাদের প্রিয় সম্রাটকে। এমন অভ্যর্থনায় আপ্লুত দেল পিয়েরো ম্যাচ শেষে 'ল্যাপ অফ অনার' ও করেছিলেন জুভেন্টাস সমর্থকদের জন্য। '১১-'১২ লিগ মৌসুমে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় জুভেন্টাস। এর সপ্তাহখানেক পর ২০ মে, ২০১২ তে তুরিনের বুড়িদের হয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরের এক বর্ণীল ক্যারিয়ারের ইতি টানেন 'কিং আলে'। নাপোলির বিপক্ষে ইতালিয়ান কাপের ফাইনাল ম্যাচের ৬৭ মিনিটে যখন তাকে উঠিয়ে নেন অ্যান্তোনিও কন্তে, জুভেন্টাস সমর্থকেরা তো বটেই, নাপোলির সমর্থকেরাও দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল তুরিনের সম্রাটকে। ম্যাচ হারলেও সমর্থকদের মন ভারাক্রান্ত ছিল নিজেদের প্রাণপ্রিয় 'কিং আলে' কে হারানোর বেদনায়।

     

    সম্রাটও হারতে পারেনঃ

    ব্যালন ডি’অরটা বাদে ফুটবলে প্রায় সবই জিতেছেন তুরিনের ফেনোমেনন। কিন্তু ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ কিন্তু তার পাশে সবসময় ছিল না। লিগ জিতেছেন ৮ বার (কালসিওপোলির কারণে অফিশিয়ালি ৬ বার), রানার আপ হয়েছেন ৫ বার। ইতালিয়ান কাপ ও ইতালিয়ান সুপারকাপ জিতেছেওন ৫ বার, রানার আপও ৫ বার! কিন্তু দেল পিয়েরো খুব সম্ভবত সবচেয়ে পোড়ায় ১ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের বিপরীতে তিন তিনবার রানার আপ হওয়া, এর মধ্যে আবার টানা দুবার (’৯৬-’৯৭, ’৯৭-’৯৮)। আসলেই সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সবকিছু দেন না...

     

    যেখানে নেই আর কেউঃ

    সেই ১৯ বছরের অচেনা এক তরুণ হিসেবে পাড়ি জমিয়েছিলেন জুভেন্টাসে। ২৩ বছরে ম্যাচ খেলেছিলেন ৭০৫টি। গোল করেছেন ২৯০টি, অ্যাসিস্ট ১৩৪টি। প্রায় দুই যুগ ব্যাপ্তির ক্যারিয়ারে ৮ বার লিগ শিরোপা (কালসিওপোলির কারণে অফিশিয়ালি ৬টি), ৫ বার ইতালিয়ান কাপ এবং ১ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন দেল পিয়েরো। সিরি আ-র সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন দুবার ('৯৮ এবং '০৮)। ক্লাবের হয়ে শেষ ম্যাচটা যখন খেললেন, বয়সটা তখন চল্লিশ ছুইঁছুইঁ। চল্লিশেও চালশে হয়ে যাননি তুরিনের সম্রাট, তুরিনের ফেনোমেনন। জুভেন্টাসের পর খেলে বেড়িয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনী এফসি, ভারতের দিল্লী ডায়নামোসে। কিন্তু যেখানেই গেছেন, ভালবাসাটা পেয়েছেন নিজ ও প্রতিপক্ষ সবার কাছ থেকে।

    এখানেই তার মাহাত্ম্য, এটাই আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোর সাথে অন্যান্যদের মূল পার্থক্য। রায়ান গিগসের মতে, দেল পিয়েরোর মধ্য দিয়েই ফুটবলে বিশ্বস্ত সেনানীদের যুগের সমাপ্তি শুরু হয়েছিল। বুফন, টট্টি, মেসিরাও চলে যাবেন একদিন। অবসরের পর 'ওয়ান ম্যান ক্লাব' হিসেবে নাম আসবে সবারই। কিন্তু কজনই বুক চিতিয়ে বলতে পারবেন, "নিজ ক্লাবকে দ্বিতীয় বিভাগে নামিয়ে দেওয়া দেখেও ক্লাব ছেড়ে যাইনি"? কজনই বা অর্থমোহে অন্ধ না হয়ে ক্লাবের কথা, সমর্থকদের কথা চিন্তা করে থেকে যাওয়ার শক্ত মানসিকতার প্রমাণ দিতে পারবেন? উত্তর একজনই, আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো। এখানেই সবার চেয়ে ভিন্ন তিনি, এখানেই অনন্য সবার প্রিয় 'ইল পিন্তুরেচ্চিও'...