• বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    বিপিএলে জ্বলছে না ভিনদেশী তারা?

    বিপিএলে জ্বলছে না ভিনদেশী তারা?    

    রাতের আকাশের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এবারের বিপিএলকে। দূরের তারারা যেখানে মিটিমিটি জ্বলে সেখানেই মর্ত্যভূমি উজ্জ্বল করে রাখে প্রকাণ্ড চাঁদ। দেশের খেলোয়াড়রা এবার যেমন পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটির মতো ঝলমলে, সেখানে বিদেশিরা যেন ব্রহ্মাণ্ডের অন্যপ্রান্তের এক ঝাঁক নিভু নিভু তারা। যাদের কয়েকটি মাঝে মাঝে হীরার মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে বটে, কিন্তু বাকিদের ব্যর্থতা সেটাতে লেপন করেছে ক্লেদাক্ত অমানিশা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের চতুর্থ আসরে বিদেশি খেলোয়াড়দের ব্যর্থতা অনেকটাই থিতিয়ে এনেছে টুর্নামেন্টটির উত্তেজনার ঝাঁজ।

    দর্শক সংখ্যার দিক থেকে আইপিএলের পরই অবস্থান বিপিএলের। ভারতীয় লিগটিতে যেমন শোনা যায় স্থানীয় ক্রিকেটের নবীন তারকার আগমনধ্বনি, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাঘা বাঘা ক্রিকেটারদেরও পারফর্ম করতে দেখা যায়। বিপিএলের প্রথম তিন আসরে ভালোই দাপট দেখিয়েছিলেন বিদেশিরা। কিন্তু এবারে তারা ভীষণ নিষ্প্রভ।

    শুন্য রান করার দিকটাই দেখুন না, দুটির বেশি শুন্য রান করা সবাই বিদেশি। ৭ ম্যাচে তিনটি শুন্য নিয়ে যাতে শীর্ষে বরিশাল বুলসের থিসারা পেরেরা। চার ম্যাচে দুটি শুন্য নিয়ে তাঁর ঠিক পেছনেই সতীর্থ দিলশান মুনাবীরা।

     


    রানের দিক থেকেও শীর্ষে দশে আছেন কেবল দুই বিদেশি। তারা দুজনই আবার চিটাগং ভাইকিংস ও রংপুর রাইডার্সের হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। বলছি দুই আফগান ক্রিকেটার মোহাম্মদ নবী ও মোহাম্মদ শেহজাদের কথা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম পর্ব শেষে এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মিলিয়ে মোট ২৬ জন ব্যাটসম্যান শত রান বা তারচেয়ে বেশি করেছেন। এঁদের মধ্যে বিদেশি মাত্র ১১ জন। শুধু রান নয়, ফিফটি ও ব্যাটিং গড়ের দিক থেকেও ঢের এগিয়ে আছেন দেশি ব্যাটসম্যানরা। বোলিংয়ে তাও বিদেশিদের মান রেখেছেন মোহাম্মদ নবী, জুনায়েদ খান ও শহীদ আফ্রিদিরা। তাঁরা তিনজনই আছেন শীর্ষ পাঁচ উইকেট শিকারির মধ্যে।

    অবশ্য এবারের বিপিএলে ভালোমানের বিদেশিদের সংখ্যাই যে হাতেগোনা। একটা সময় বিপিএলে দাপট দেখিয়েছেন আহমেদ শেহজাদ, কুমার সাঙ্গাকারা ও ব্র্যাড হজরা। প্রথম দুজন এখনো আছেন, কিন্তু আগের সেই ধার আর নেই। ছক্কা ও সেঞ্চুরির দিক থেকে তো এখনো শীর্ষে ক্যারিবীয় ওপেনার ক্রিস গেইল। এবারে তিনি চিটাগং দলে থাকলেও এখনো বাংলাদেশে এসে পৌঁছাননি। চোটের কারণে খেলতে এসেও ফিরে গেছেন আরেক ক্যারিবীয় তারকা আন্দ্রে রাসেল। তাঁদের শুন্যতা পূরণ করতে পারেননি পাকিস্তান ও কাউন্টির অখ্যাত খেলোয়াড়রা। তাঁদের দলে নিয়ে বিদেশিদের কোটা পূর্ণ হলেও কাজের বেলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলেছে অষ্টরম্ভা।

    আগের তিন আসরেই সেঞ্চুরি করেছিলেন কোনো না কোনো বিদেশি ব্যাটসম্যান। এবার একমাত্র সেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ভাইকিংসের আফগান ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ নবী। রাজশাহী কিংসের বিপক্ষে ম্যাচে অপরাজিত ৮৭ রান করেছিলেন তিনি। কিন্তু অন্য যেসব বিদেশি ব্যাটসম্যান বিভিন্ন দলে রয়েছেন তাঁদের অনেকেই বয়সের কারণে ম্লান। ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে একমাত্র উজ্জ্বল শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারা। ৭ ম্যাচে ১৬৬ রান করেছেন তিনি। উইকেটকিপার হিসেবে করেছেন ১১টি ডিসমিসালও। কিন্তু নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি মাহেলা জয়াবর্ধনে ও রবি বোপারা। ডোয়াইন ব্রাভো ছাড়া বল হাতে ভালো করেননি কেউই। দুবারের চ্যাম্পিয়ন ঢাকাকে তাই অনেকটাই নির্ভর করতে হচ্ছে স্থানীয় খেলোয়াড়দের ওপর।

    একই অবস্থা রাজশাহী কিংসেরও। সামিত প্যাটেল ছাড়া দলের অন্য কোনো বিদেশিই দাঁড়াতে পারেননি। ভীষণ ব্যর্থ হয়েছেন মোহাম্মদ সামি, উমর আকমল, ড্যারেন স্যামি ও মিলিন্দা সিরিবর্ধনেরা। দুটি ম্যাচে শুন্য রান করা উমর আকমলকে তো বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে খোদ পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডই। তৃতীয় শ্রেণির চুক্তিতে জায়গা দেয়া হয়েছে তাঁকে।

     

                                গতবারের সেরা জাইদি এবার ব্যাটে বলে একেবারেই অনুজ্জ্বল 

    কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের দৈন্য দশার পেছনে দেশের ক্রিকেটারদের চেয়ে কম অবদান নেই বিদেশিদের। গতবারের বিপিএল সেরা আসহার জাইদি বল হাতে পাননি একটি উইকেটও। গতবার ১১ ম্যাচে ২১৫ রান নিয়ে শীর্ষ সাতে ছিলেন, অথচ এবার তিন ম্যাচে তাঁর রান ১২।  আশানুরূপ খেলতে পারেননি ইমাদ ওয়াসিম ও রশিদ খানরা। বরিশাল বুলসের হয়ে ব্যাটে-বলে ফ্লপ রায়াদ এমরিট, দিলশান মুনাবিরা ও জোশুয়া কবরা। খুলনা টাইটানসের রিকি ওয়েসেলস ও জুনায়েদ খান ছাড়া ব্যাটে-বলে ভালো খেলছেন এমন বিদেশি নেই। চোটের কারণে অবশ্য দলটির হয়ে সবকটি ম্যাচ খেলতে পারেননি গতবারের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি কেভন কুপার। এবারে ৪ ম্যাচে ৭ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।

    এদিক থেকে দারুণ ব্যতিক্রম রংপুর রাইডার্স ও চিটাগং ভাইকিংস। দুই দলের হয়েই এবারের বিপিএল মাতাচ্ছেন বিদেশিরা। রংপুরের তো শীর্ষ রান সংগ্রাহক ও উইকেট শিকারি দুজনই বিদেশি- মোহাম্মদ শেহজাদ ও শহীদ আফ্রিদি। চিটাগংয়ের হয়েও দারুণ খেলছেন মোহাম্মদ নবী, ইমরান খান জুনিয়র ও শোয়েব মালিকরা।

    এমন এক সময়ে হচ্ছে বিপিএলের খেলা যখন ভীষণ ব্যস্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচী। টেস্ট ক্রিকেটে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তান এবং ভারত-ইংল্যান্ড। বাকি তিন দল শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ে ব্যস্ত ত্রিদেশীয় সিরিজ নিয়ে। আইসিসির পূর্ণ সদস্যদের মধ্যে খেলছে না কেবল বাংলাদেশ। অনুমিতভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এমন ঠাসা সূচীর কারণে বিপিএলে দেখা যাচ্ছে না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অনেক তারকাদের। এর ফলে বিপিএলের আকর্ষণ যেমন হয়েছে ম্লান, তেমনি পড়ে গেছে খেলার মান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঠাসবুনটের মধ্যে বাংলাদেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে আগ্রহ থাকার কথা নয়। সেটা খুব একটা দেখাও যাচ্ছে না।

    অবশ্য জাতীয় দলের বাইরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালাদের অনেককেই দলে ভেড়াতে পারতো বিপিএলের দলগুলো। ডেভিড মিলার ও শেন ওয়াটসনের রংপুর রাইডার্সের হয়ে খেলার গুঞ্জন উঠলেও দুজনেই না করে দিয়েছেন। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল,জেমস ফকনার ও অ্যারন ফিঞ্চ ব্যস্ত ঘরোয়া শেফিল্ড কাপ খেলতে। এবি ডি ভিলিয়ার্স চোটের কারণে মাঠের বাইরে। ফিট থাকলেও নিঃসন্দেহে থাকতেন জাতীয় দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায়।

    বিপিএলের জৌলুস বাড়াতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচীর সঙ্গে সমন্বয় করে সূচী নির্ধারণের কোনো বিকল্প নেই। নয়তো অবসর নেয়া, অখ্যাত ও মাঝারি মানের বিদেশি ক্রিকেটারদের স্বর্গ হিসেবে বিপিএলের যে "খ্যাতি", তা সহজে ঘুচবে না।