• নিউজিল্যান্ড-বাংলাদেশ
  • " />

     

    'সুপার-ডিপেন্ডেবল'

    'সুপার-ডিপেন্ডেবল'    

    সাকিব আল হাসান তখন অধিনায়ক। হঠাৎ কথা উঠলো, দলের মাঝে ‘গ্রুপিং’ চলছে। বিকেএসপি থেকে আসা ক্রিকেটাররা এক গ্রুপে, বিকেএসপি থেকে না আসা ক্রিকেটাররা আরেক গ্রুপে। কোনো সাংবাদিক সাকিবকে জিজ্ঞাসাই করে বসলেন এটা। সাকিবের সহজ-সরল উত্তর, ‘গ্রুপ আছে তো। দুইটা। একটা ব্যাটিং গ্রুপ, আরেকটা বোলিং।’

    কয়েক বছর পর। সাকিবের তখন অধিনায়কত্ব নেই। মুস্তাফিজরা আসার পর দলের ‘একমাত্র’ তারকাও নন। আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রথম ওয়ানডে, মিরপুরে। ম্যাচসেরা তিনি। ম্যাচটা অবশ্য তাঁর জন্য মাইলফলকেরও, এদিনই আব্দুর রাজ্জাককে ছাড়িয়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটে পাওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। তাঁর অনুভূতি জানতে চাওয়া হলো। ‘ভাল লাগছে। তবে তিন ফরম্যাটে সর্বোচ্চ রান থাকলে আরও ভাল লাগতো। দলের সবাই যেভাবে ব্যাটিং করছে, আমি তো সুযোগই পাই না!’ মজা করা শেষ। এবার যেন আরেকজন সাকিব উত্তর দিলেন, ‘ভাল লাগে। তবে বড় বিষয়টা হলো, দলের জন্য কতোটুকু করতে পারলাম’।


    ****
     

    নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন, ক্রিকেটের অন্যতম কঠিন। সেখানকার একটা পারফরম্যান্স যেন আর দশটার থেকে আলাদা, খানিকটা এগিয়ে থাকে বিচার বিশ্লেষণে। প্রথম ওয়ানডেতে ভালই ব্যাটিং করছিলেন, ৪২ রান করার পর উঠে যেতে হলো হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে। ছিটকে গেলেন সিরিজ থেকে, খেলতে পারলেন না টি-টোয়েন্টিও। বাংলাদেশ সুযোগ পায়, সুযোগ হারায়। উইকেট দেখেন আর আফসোসে পোড়েন মুশফিকুর রহিম! তিনি যে ভাল খেলতে চেয়েছিলেন! সতীর্থদের ব্যর্থতা আরও আফসোস বাড়িয়ে দেয়। নিজের পারফরম্যান্সটা ভাল হলে যে দলেরও লাভ হয়!

    ****

     

    ওয়েলিংটনে বৃষ্টির আনাগোণা। এর মাঝেই তামিমের তামিমসুলভ এক ইনিংস, মুমিনুলের টেস্টের ধারাবাহিকতা। অর্ধেকেরও কম খেলা হয়েই দিনশেষ। পরদিন আকাশ ঝকঝকে, ব্যাটিংয়ের জন্য উপযুক্ত কন্ডিশন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আউট মুমিনুল। তবে সাকিব বুঝলেন, এ উইকেটে দেখেশুনে খেললে ব্যাটিংটা খুব কঠিন নয়। উইকেটে আসার পর মুশফিককেও বললেন সেটাই। কিরকম একটা আত্মবিশ্বাসও কাজ করছিল সাকিবের ভিতর। আগেরদিন যখন মিচেল স্যান্টনার তাঁর ক্যাচটা ফেলে দিলেন, তখন থেকেই। এরকম পরিস্থিতিতে তো ‘বড় বড়’ ব্যাটসম্যানরা বড় স্কোর করেন!

    আর মুশফিকের পকেটে ছিল একটা কয়েনমতো কিছু। কী কারণে, সেটা বলতে চাননা। রাখতে চান তাঁর আর তামিমের মাঝেই। 

     

    স্কোরকার্ড কথা বলে! 

     

    ****


    কন্ডিশন ব্যাটিংয়ের পক্ষে, আত্মবিশ্বাস আছে। অন্য কোনো ‘বিশ্বাস’ও আছে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজটাও তো বাকি আছে। এতসবকিছুর প্রয়োগ। পরিস্থিতি বদলাবে। বদলাবে ফিল্ডারের জায়গা, বলের লেংথ, গতি। হঠাৎ দমকা হাওয়া বইবে। টিকে থাকতে হবে এসবের মাঝেই। সাকিব টিকে থাকলেন। আক্রমণ করলেন। গত আট ইনিংসে ফিফটি নেই। প্রথমে সেটা হলো। এরপর সেঞ্চুরি, নিজের প্রথম সেঞ্চুরিটা করেছিলেন এই নিউজিল্যান্ডেই। সেই স্মৃতির পুনরাবৃত্তি হলো। টেস্টে সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ১৪৪, টপকে গেলেন সেটা। প্রথম ‘ড্যাডি হান্ড্রেড’ পেলেন। এরপর এসে দাঁড়ালেন ১৯৯ রানে। কেন উইলিয়ামসন ফিল্ডার সামনে আনলেন সব। দুইবার বল করতে গিয়েও ট্রেন্ট বোল্ট ফিরে এলেন, সাকিবের স্নায়ুচাপ যেন তখন ভর করেছে কিউই পেসারের ওপরই। ১৯৯ রানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন ছয় বল। ডি গ্র্যান্ডহোমকে স্কয়ার কাটে চার মারলেন এরপর। যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী রান করেছেন, সেই ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়েই চার। ওপাশে মুশফিক গর্জন দিয়ে উঠেছেন, হাত তুলে উদযাপনও শুরু করেছেন। যেন তাঁরই ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে গেছে! সাকিব হেলমেট খুললেন, ব্যাট উঁচিয়ে ধরলেন ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে গোটা মাঠের দিকেই। মুখে একটা স্মিত হাসি, যেন সেই লাজুক ভাল ছাত্র, কিছু একটা করে বসেছেন। দারুণ কিছু। আর মুশফিক সেই বন্ধু বা সিনিয়র, যাঁর গর্ব দেখে মনে হয় অর্জনটা তাঁরই। মুশফিকুর রহিম, যিনি সাকিব আল হাসানের বিকেএসপির সিনিয়র।

     

    কয়েন-রহস্য! 

     

    ****

     

    ড্রেসিংরুমের সিঁড়িতে বসে আছেন সাব্বির রহমান। প্যাড পরে। উইকেট গেলে ব্যাটিংয়ে নামার কথা তাঁর। তামিম আছেন, কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে আছেন। মেহেদী হাসান মিরাজ আছেন। সাকিবের মাইলফলকে, মুশফিকের মাইলফলকেও। চোট থেকে ফিরে সেঞ্চুরি। সাকিবের মতো তাঁর সেঞ্চুরিও বাউন্ডারিতে। উদযাপনে একটু ভিন্নতা থাকলো, হেলমেটের সঙ্গে গ্লাভসটাও খুললেন। ট্রাউজারসের পকেট থেকে বের করলে একটা কয়েন, উঁচিয়ে ধরলেন ড্রেসিংরুম পানে। মুখে হাসি। সাকিবের চেয়ে একটু প্রসারিত, কিংবা সাকিবের মতোই।


    স্যান্টনারের ক্যাচ ছেড়ে দেয়া আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল সাকিবকে। ট্রেন্ট বোল্টের বলটা মুশফিকের লেগস্ট্যাম্প ছুঁয়ে গেল, বেইল পড়লো না। ইনসাইড-এজটায় চারই হলো। এ ঘটনা কি বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল তাঁকে? নাকি সবই ওই কয়েনের ‘খেল’? বড় ব্যাটসম্যান হয়তো সুযোগ পেলেই কাজে লাগান। একটা কয়েন হয়তো জোগায় আত্মবিশ্বাস। অথবা এমন কোনো ঘটনা, যাতে ভাগ্যের ছোঁয়া থাকে খানিকটা। 


     

    যখন মুশফিকের হাসি বেশী বিস্তৃত! 



    সাকিবের ইতিহাস গড়া ইনিংস শেষ হলো নেইল ওয়াগনারের বলে। ওয়াগনার ছুটে এলেন, কেন উইলিয়ামসন ছুটে এলেন, যে মিচেল স্যান্টনার ক্যাচ ফেলেছিলেন, ছুটে এলেন তিনিও। প্রায় সব কিউই ফিল্ডারই ছুটে এসে অভিনন্দন জানালেন। স্ট্রোক আর আধিপত্যে ভরপুর এমন ইনিংস দেখাতেও তো আনন্দ! কিউইরা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মুশফিককেও। আউট হয়ে দুজনের চোখেমুখেই ছিল হতাশা। ইতিহাস গড়া জুটিতে, ইতিহাস গড়া ইনিংসে, বাংলাদেশের টেস্টের ঐতিহাসিক দিনে যে হতাশা মুছে যেতে বাধ্য।

     

    ****


    রেকর্ড করতে পারলে সাকিবের ভাল লাগে। নিউজিল্যান্ডের মতো কন্ডিশনে ‘আলাদা’ কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা থাকে মুশফিকের। তবে দিনশেষে লক্ষ্য একটাই। দলের জন্য কী করা গেল। সাকিবের অর্জনে তাই মুশফিকের গর্জন শোনা যায়। তামিম নিজের রেকর্ড ভাঙ্গা দেখতে ড্রেসিংরুমের সিঁড়িতে নেমে আসেন। সাব্বির ব্যাটিংয়ে নামার অপেক্ষাটা উপভোগ করতে থাকেন। মিরাজকে দেখলে বোঝা যায়, সাকিব-মুশফিকের অর্জন দলের জন্য কতোখানী অর্থবহ! 

    যখন ‘কিছু’ করা যায়, যখন ‘বিশেষ কিছু’ করা যায়, তখন নিশ্চিতভাবেই ব্যক্তিগত তৃপ্তির চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় দল। তখন বিকেএসপি থাকে না, মাগুরা থাকে না, বগুড়া থাকে না। থাকে ওই দল। থাকে একটা দেশ।

    সাকিব আল হাসান, অর্জনে বাংলাদেশের ‘সুপারম্যান’।

    মুশফিকুর রহিম, আস্থায় বাংলাদেশের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’।