জেনেসিস অফ জিজি বুফন
১
২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ১৫ মিনিটের প্রায় শেষের দিক। বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে ম্যাচের ভাগ্য। ডান প্রান্ত থেকে সানিওলের ক্রসে জিদানের হেড! ইতালির ৬ কোটি মানুষের দম না ফেলা সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সমান মুহূর্ত। বিশ্বের কোটি মানুষের চোখ তখন বাতাসে ভাসতে ভাসতে গোলবারের দিকে যাওয়া অ্যাডিডাসের টিমজিস্ট নামের একটা চামড়ার গোলকের ওপর। এখানে সময় থেমে যায়, ফুরিয়ে যায় স্নায়ুর জোরও। শুধু হার মানেন না একজন।
তিনি শুন্যে উড়াল দেন। এক হাতের তালু দিয়ে দিক বদলে দেন বলটার। মাটিতে ফেরত আসার আগেই জিদানের সাথে মাথায় হাত পড়ে প্যারিস, মার্শেইর অলিগলির কোটি মানুষেরও। অভিকর্ষের টানে ফেরত আসেন গোলরক্ষক। তার আগেই অবশ্য দম আটকে জ্বলতে থাকা রোম প্রাণ ফিরে পায়।
একটা ক্ষণ। সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। এই ক্ষুদ্র একটা মুহুর্তের ইতিহাস হয়ে থাকার সাধ্য নেই। ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপ জয়ের তকমাটা তো এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে ওই দল আর ট্রফিটা। সাথে আলাদা করে একজন। ওই মুহুর্তটা যিনি নিজের করে নিয়েছিলেন।
জিয়ানলুইজি বুফন। জিজি নামে চেনে যাকে সবাই। জন্মের আগেই খেলোয়াড় হওয়ার নিয়তি লেখা ছিল যার কপালে!
২
পুরো পরিবারটাই যেন একটা খেলার দল! মা তিনবারের সেরা ইতালিয়ান চাকতি নিক্ষেপকারী। বাবাও ছিলেন অ্যাথলেট। দুই বোনের দু’জনই ভলিবল খেলতেন ইতালির হয়ে। মামা-চাচা পর্যন্ত ঘাঁটলে পরিবারের স্টেডিয়ামমুখী সদস্যের সংখ্যাটা কেবল বাড়ে।
বুফনও যে বড় হয়ে খেলাটাই পেশা হিসেবে নেবেন তাতে সন্দেহ ছিল না। ১০ বছরের ছোট্ট বুফনকে তাই ভর্তি করিয়ে দেয়া হল ফুটবল একাডেমিতে। গোলকিপার নয়, বুফন খেলা শুরু করলেন মিডফিল্ডার হিসেবে।
বছর দুই বাদে জিজি আবিষ্কার করেন নিজের ‘আইডল’। ইতালিতে চলা বিশ্বকাপের সময়। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের গোলকিপার থমাস এনকোনোকে দেখে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন বুফন! মিডফিল্ডার নয়, গোলকিপারই হবেন তিনি!
গোলকিপার বুফনের সাথে জুভেন্টাস জড়িয়ে আছে আত্মার মতো। দেখে মনে হয় মালদিনি, জানেত্তি, জাভি, গিগসদের মতো বোধহয় এই ক্লাবের সাথেই নাড়ির সম্পর্ক বুফনের। জুভেন্টাসের সাথে বুফনের সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। তবে বুফনের শুরুটা কিন্তু জুভেন্টাসে নয়!
১৯৯৫ থেকে ২০০১ পর্যন্ত পার্মার গোলবার সামলে তবেই জুভেন্টাসেই পাড়ি জমিয়েছিলেন বুফন। সেখানে ভেরন, ক্রেসপো, থুরাম, ক্যানাভারোদের সাথে মিলে কোপা ইতালিয়া আর উয়েফা সুপার কাপ জিতেছিলেন জিজি।
জুভেন্টাসের তখনকার গোলকিপার এডউইন ভ্যান ডার সার ফুলহ্যামে পাড়ি জমালে এক নম্বর জার্সিটা ফাঁকাই হয়ে যায় ক্লাবের। অবশ্য নতুন কাউকে খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। আগের বেশ কয়েক মৌসুম ধরে দারুণ ধারাবাহিক বুফনকেই চাই জুভের। তাতে বিশ্বরেকর্ড গড়তেও তাদের সমস্যা ছিল না।
গোলকিপারের দলবদলের বিশ্বরেকর্ড গড়ে পার্মা থেকে জুভেন্টাসে যোগ দেন বুফন ২০০১ সালে। এক নম্বর জার্সিটা সেই থেকে নিজের দখলে। তারপরের গল্পটা সবার জানা। জুভেন্টাস আর জিজি যেন এক আত্মা, এক ক্লাব। একে অন্যের পরিপূরক।
সাফল্যের এই গল্পের ভেতর কিন্তু বুফনের একটা কালো সময়ও আছে! সময়ের ওই নামকরণটা অবশ্য বুফনের নিজেরই করা।
৩
জুভেন্টাসে যোগ দেয়ার পর দুই মৌসুম পার হয়ে গেছে। দু’বারই সিরি-আ ট্রফিটা গেছে বুফনদের ঘরেই। মিলিয়ন ডলার খরচ করে তাঁকে দলে ভেড়ানোর প্রতিদানটাও বুফন দিয়েছেন ভালোভাবে। ঠিক আগের বছর ইতালির হয়ে বিশ্বকাপে খেলছেন প্রতিটি মিনিট। সবই ঠিকঠাক! কিন্তু কোথায় কী যেন নেই বুফনের!
২০০৩ গ্রীষ্মের শুরু। কী অজানা এক হতাশা চেপে বসে ২৫ বছরের এক টগবগে যুবকের ওপর। নিজের লাল ফিয়াট ৫০০ মডেলের গাড়ি চালিয়ে প্রতিদিন অনুশীলনে আসছেন। সতীর্থদের সাথে হাসি-ঠাট্টাতেও কম যাচ্ছেন না বুফন। উপরের বেশটা চিরচেনা বুফনের। কিন্তু ভেতরে বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে তাঁকে।
অবস্থা এতোটাই খারাপের দিকে গড়িয়েছিল যে মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল বুফনকে। ভেতরের কথাগুলো বলবার জন্য। গোলবারের নিচে একা দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা যখন সত্যিই একা হয়ে পড়ে তখন আর কি-ই বা উপায় থাকে?
সে কথাগুলো কী ছিল তা অবশ্য কখনও জানাননি বুফন। বিষণ্নতার ওই সময়টায় খেলা থেকে কয়েক মাসের জন্যে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভালো করেই জানতেন নিজেকে সরিয়ে নেয়া মানে, নিজের জায়গা হারানো। গোলকিপিং তো আর ছেলের হাতের মোয়া নয়। এখানে বিশ্রামের দরকার হয় না, বরং যতো বেশি অভিজ্ঞতা ততো দক্ষতা!
লড়াইটা তাই চালিয়েই যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বুফন। সেই শিক্ষাটা সম্ভবত নিজের ছোট্ট ক্যারিয়ার থেকেই পেয়েছিলেন। ইতালির জাতীয় দলে খেলার সময় হাত ভেঙে টলডোর কাছে জায়গা হারিয়েছিলেন বুফন। ইতালির গোলবার পাহারা দেবার গৌরবটা ফিরে পেতে নিজেকে প্রমাণ করেই আবার দলে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।
ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিনের জন্য মাঠের বাইরে গিয়ে কতো শত গোলকিপার আর কখনই দলের এক নম্বর জায়গাটা ফেরত পায়নি- তার ইয়ত্তা নেই। মনের বিরুদ্ধেই তাই খেলা চালিয়ে গেলেন বুফন। সাথে কাউন্সিলিং চললো সমান তালে।
বছরখানেক সময়ে আবারও ফিরে পাওয়া গেল সেই পুরোনো বুফনকে। এবার আগের চেয়েও পরিপক্ক তিনি। সাথে কঠিন আরও মনোবল।
‘কালো দিনগুলোর’ কল্যাণে পাওয়া মনোবলের একটা উদাহরণ পাওয়া যায় বুফনের কথা থেকেই। বিষণ্ণতা কাটার কিছুদিন পরই পর্তুগালে অনুষ্ঠিত ইউরোর প্রথম ম্যাচে ডেনমার্কের সাথে ড্র করে বসে ইতালি। বুফন নিজেই বলছেন 'ওই ম্যাচটা সবার জন্য ছিল ভয়ঙ্কর। কিন্তু গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে একা আমিই শুধু ঠিক ছিলাম'।
২০০৩-২০০৪ পর্যন্ত ওই একটা বছর বুফনের এতোটাই অপছন্দের যে তিনি মনেও করতে চান না দিনগুলোর কথা। তবে সেইদিনগুলোর শিক্ষাই হয়ত প্রস্তুত করিয়ে দিয়েছিল পরের বুফনকে। যে বুফন টাইব্রেকারের দিকে গড়াতে থাকা ডর্টমুন্ডের সেই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পঞ্চাশ হাজার দর্শকের সামনে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন পোডলস্কির নিশ্চিত গোল। আর তার তিনদিনের মাথায় প্রায় একইরকম অবস্থায় জিদানকে ঠেকিয়ে দিয়ে একাই নিজের দলকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ম্যাচে। ২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আর ফাইনালে বুফন অমন মুহুর্তের জন্ম না দিলে হয়ত এতোদিন তিন বিশ্বকাপেই আটকে থাকত ইতালির যাত্রা।
৪
বুফনের বুফন হয়ে ওঠার গল্পটা থেমে যেতে পারত ওখানেই। কিন্তু তা কি করে হয়! শুধুমাত্র ট্রফি আর ক্লিনশিটের পরিসংখ্যানে ইতিহাসের পাতায় হাসতে তিনি নারাজ! সাথে উদারতা, আনুগত্য আর ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে ভাস্বর হয়ে থাকলেন তিনি।
২০০৬ বিশ্বকাপ জয়ের দিনই জানা গিয়েছিল পাতানো ম্যাচ খেলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জুভেন্টাসকে নেমে যেতে হবে ইতালিয়ান ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরে। এই খবরের পর তুরিনের ওল্ড লেডিকে একা করে দিয়ে একে একে ক্লাব ছেড়েছিলেন ইব্রাহিমোভিচ, ক্যানাভারো, এমারসন, থুরামরা। বুফনের বয়স তখন ২৮। যে কোনো পজেশনের ফুটবলারের জন্যই নিজের ক্যারিয়ারের চূড়া বলা চলে ওই বয়সকে। আর গোলকিপারদের তো বয়সের শুরুই হয় ওখান থেকে!
আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোর ‘আ ট্রু জেন্টালম্যান নেভার লিভস হিজ লেডি’ কথার সাথে গলা মেলালেন বুফনও। সদ্যই বিশ্বকাপ জিতে এসে ইতালির দ্বিতীয়স্তরের দলের বিপক্ষে মাঠে নামলেন জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে চড়িয়েই। টাকা-পয়সা, খ্যাতি, ক্যারিয়ার, বড় ক্লাবের হাতছানি সব অবজ্ঞা করে।
ভালোবাসার কাছে সব তুচ্ছ।
৫
জুভেন্টাসকে নিয়ে পরের মৌসুমেই সিরি আ তে ফেরত আসলেন বুফন। সেবারও ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল ছাড়াই কাটল বিশ্বকাপজয়ী দলের গোলকিপারের। এক বছর পর ফুরোল সেই অপেক্ষাও।
শুরুর কয়েক বছর সুবিধা করতে না পারলেও সময়ের সাথেই বুফনের জুভেন্টাস ফিরেছে সেই পুরনো রূপে। ইতালিয়ান ফুটবলে একচ্ছত্র আধিপত্য এখন তাঁদের। শেষ পাঁচবারের সিরি-আ জয়ীদের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না অন্য ইতালিয়ান ক্লাবগুলো। ইতালির ফুটবলের প্রতিচ্ছবিই এখন জুভেন্টাস।
তবে আক্ষেপ একটা থেকেই গেল। দুনিয়ার সব শিরোপাই নতি স্বীকার করেছে বুফনের কাছে, এই এক চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাটাই ধরে দেখা হয়নি। সেটা কি বুফনের ব্যর্থতা নাকি চ্যাম্পিয়নস লিগের অপূর্ণতা?
৬
জুভেন্টাস, ইতালির প্রতিটি গোলের পর এখনও দুই বাহুতে ভর দিয়ে গোলবারের ওপর চড়ে বসে বুফন। তা দেখে কে বলবে বেলায় বেলায় এই লোকের বয়স আজ ৩৯ হল! এই বয়সে খেলা ফুটবলে বিরল কোনো ঘটনা নয়। তবে ক্যারিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধারায় খেলে যাওয়া আর একটা খেলোয়াড়ের নাম মনে করা কষ্টসাধ্যই। সে যুগের ক্যানিজারেস, অলিভার কান, ভ্যান ডার সার, ক্যাসিয়াস থেকে শুরু করে এই আমলের ডেভিড ডি গিয়া, নয়্যার, কর্তোয়া- সবার সাথেই তুলনা হয় বুফনের। সেরারা তাঁদের সেরা সময় পার করে ঝরে গেছেন, কেউ নতুন এসেছেন- এই পুরোটা সময়ই ডি-বক্সের ভেতর থেকে সবাইকে দেখে গেছেন বুফন; পিঠে নাম্বার ওয়ান লেখা জার্সিটি লাগিয়েই।
গ্লাভস জোড়া তুলে রাখার খুব বেশি সময় বোধ হয় বাকি নেই বুফনের। একবার মজা করেই বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ের হিসেবে ১২ বছর পর পর ইতালির ফাইনালে ওঠার একটা রীতি আছে! সেই হিসেবে ২০১৮ সালেও আমি মাঠেই থাকতে চাই!’
হয়ত নিছকই কথার ছলে বলেছিলেন কথাগুলো। কিন্তু বিশ্বকাপ যখন মাত্র এক বছর দূরে, বুফনের কথাটা সত্যি হলে ক্ষতি কী!