• " />

     

    ভারতবধের তিন স্মৃতি

    ভারতবধের তিন স্মৃতি    

    ভারতের বিপক্ষে ২৯ ওয়ানডের মাত্র তিনটিতে জয় পেলেও প্রতিটি জয় ছিলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ! বেশ কিছু মিল আছে এই তিনটি জয়ে; তিনটি দলেই থাকা একমাত্র বাংলাদেশী খেলোয়াড় মাশরাফি, দলের পক্ষে সবচে বেশি উইকেটশিকারীও ছিলেন তিনি তিনটি ম্যাচেই; ২০০৪ সালে ষষ্ঠ ওয়ানডে খেলতে নামা একজন, ২০০৭ সালে পঞ্চম ওয়ানডে খেলতে নামা একজন আর ২০১২ সালে অষ্টম ওয়ানডে খেলতে নামা একজন করেছিলেন একটি করে হাফ সেঞ্চুরি। আমাদের বিজয় আর স্বাধীনতার মাস ডিসেম্বর-মার্চেই এসেছে এই জয় তিনটি।

     

    ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ঃ 

     

    বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে ম্যাচ;  মাইলফলকটিকে আরো রাঙিয়ে দিয়েছিলো ঘরের মাঠে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়। শচীন-দ্রাবিড়-হরভজন-ইরফান পাঠানকে এই ম্যাচে পায়নি ভারত। কিন্তু মাত্র ৮৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদেই ছিলো টাইগাররা। ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নামেন মাত্র ষষ্ঠ ওয়ানডে খেলতে নামা আফতাব আহমেদ। স্ট্রোকের ফুলঝুড়িতে করেন ৬৭ রান; সাথে কিছু মূল্যবান জুটিতে ছিলেন সাথী; শেষদিকে মাশরাফির ৩১ রানের ক্যামিওতে বাংলাদেশ ২২৯ রান তুলে স্কোরবোর্ডে! 

     


    গাঙ্গুলি-শেওয়াগ-যুবরাজ-কাইফ নিয়ে গড়া ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের কাছে টার্গেট খুবই মামুলিই ছিলো বলতে গেলে; কিন্তু সেদিন ছিলো অন্য বাংলাদেশ; প্রথম ওভারেই শেওয়াগের অফ স্টাম্প তুলে নেন মাশরাফি। চতুর্থ ওভারে প্যাভিলিয়নে ফেরেন যুবরাজ; এরপর ইনিংস মেরামত করতে থাকেন গাঙ্গুলি-শ্রীরাম। কিন্তু ফ্লাডলাইটের আলোতে প্রতিটা রান বাঁচাতে সর্বস্ব উজাড় করে দিচ্ছিলো বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা। মাশরাফির তালুবন্দী হয়ে ফেরেন গাঙ্গুলি; শ্রীরাম হাফ সেঞ্চুরি করলেও নষ্ট করেছিলেন অনেক বল; রানরেট বাড়ছিলো তরতর করে। এই সিরিজেই অভিষেক হওয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি মাশরাফির বলে অধিনায়ক সুমনের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন। রাজিন সালেহ-র সরাসরি থ্রোতে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠা কাইফ-ও ৪৯ রানে ফিরলেন সাজঘরে; আগারকার রফিকের বলে আফতাবের হাতে তালুবন্দি হয়ে মাঠ ছাড়লে ভারতের ২ উইকেট হাতে রেখে তখন দরকার ছিলো ৫৫ বলে ৫৮ রান।

     

    এরপর শেষ মরিয়া চেষ্টা চালালেন যোগিন্দর শর্মা-জহির খান। কিন্তু ঘরের মাঠে ৪০ হাজার দর্শককে নিরাশ করেনি সেদিন টাইগাররা। ১৫ রানের জয় পেয়ে শততম ওয়ানডে-টা আনন্দময় এক উপলক্ষ্যই করেছিলো বাংলাদেশ। অবশ্য একই দিনে এশিয়াতে মারাত্মক সুনামী আঘাত করায় আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়েছিলো।

    ব্যাটিংয়ে ক্যামিও ইনিংসের পর দুই উইকেট আর দুই ক্যাচ নিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ১৫ মাস পর ইনজুরি থেকে ফেরা মাশরাফি বিন মর্তুজা।

     

    ১৭ মার্চ ২০০৭ঃ

     

    ২০০৭ বিশ্বকাপ, পোর্ট অফ স্পেন। এবারের ভারতবধের নায়ক আবারও মাশরাফি; সাথে যোগ্য সহচর ছিলেন রাজ্জাক-রফিক-তামিম-মুশফিক-সাকিব। এই ম্যাচে হেরেই কার্যত বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়ে গিয়েছিলো আগের আসরের রানার্স আপ ভারতের; আর বাংলাদেশ চলে গিয়েছিলো সুপার এইটে।

    মিডিয়ার উস্ফালনে মাশরাফি সাংবাদিকদের বলেছিলেন-'ভারতকে ধরে দিবানি'; পরে সেই কথাটা বাংলাদেশ ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে গিয়েছে। ম্যাচটাও বাংলাদেশ খেলতে নেমেছিলো মানজারুল রানার মৃত্যুসংবাদ শুনে। 

     



     

    সবচে প্রিয় বন্ধুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে নিজের দ্বিতীয় ওভারেই আঘাত হানলেন মাশরাফি। প্রায় নিখুঁত অফ-কাটারে শেওয়াগের অফ-স্ট্যাম্প উপরে ফেলেন তিনি। বোলিং সহায়ক পিচে দ্রাবিড়ের টসে জিতে ব্যাটিং নেয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়ে আসে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কাছে; রানের জন্য রীতিমত সংগ্রাম করতে থাকে গাঙ্গুলি-শচীন-দ্রাবিড়-যুবরাজ-ধোনিদের নিয়ে গড়া বিখ্যাত ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ! মাশরাফির জোড়া আঘাতের পর রফিক-রাজ্জাক ৭২ রানেই ফিরিয়ে দেন প্রথম চার ব্যাটসম্যানকে। গাঙ্গুলি-যুবরাজ ইনিংস মেরামত করা শুরু করলেও রানের চাকা বাড়াতে পারছিলেন না একদমই। চল্লিশ ওভার শেষেও রান ছিলো মাত্র দেড়শোর আশেপাশে। রান বাড়াতে গিয়েই মাত্র ৪ ওভারের মধ্যে ২ রানে ভারত হারায় আরো ৫ উইকেট; শেষ উইকেট জুটিতে জহির খান-মুনাফ প্যাটেল ২৬ বলে ৩২ রান করে স্কোরবোর্ডে তুলেন ১৯১ রান। মাশরাফি চারটি আর রফিক-রাজ্জাক তিনটি করে উইকেট তুলে নেন। 



    একই পিচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেমন করে তা ছিলো ভাবনার বিষয়; কিন্তু শুরু থেকেই সব শঙ্কা ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিলেন ১৮ বছরের তামিম ইকবাল। জহির খান-আগারকার-মুনাফ প্যাটেলদের কোনরকম পাত্তা না দিয়েই একের পর এক স্ট্রোকপ্লেতে নিজের মাত্র পঞ্চম ওয়ানডেতে করেন সারাবিশ্বকে নিজের আগমনীবার্তা জানানো ৫৩ বলে ৫১ রানের দুর্ধর্ষ এক হাফ সেঞ্চুরি। জহির খানকে পরপর দু’ বলে সীমানাছাড়া করে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে ছয় হাঁকালেন, ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে ইথারে ভাসল ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তী ইয়ান বিশপের বিস্ময়মাখানো মুগ্ধতা, “ওহ হোহ হো, লুক অ্যাট দ্যাট! ইট বিলাইজ এ সেভেনটিন ইয়ার্স ওল্ড রিয়েলি! শোয়িং ভেরি লিটল রেসপেক্ট টু দি এল্ডার স্টেটসমেন...”



    তামিম-নাফিসের বিদায়ের পর আফতাব অল্প রানে প্যাভিলিয়নে ফিরলে দলের হাল ধরেন দুই তরুণ তুর্কী মুশফিক-সাকিব। ১০৭ বলে মুশফিকের অপরাজিত ৫৬ আর ৮৬ বলে সাকিবের ৫৩ রানই বলে দেয় সেই পিচে ব্যাটিং করাটা মোটেই সহজ ছিলো না। মুশফিকের সাথে ৮৪ রানের জুটি গড়ে সাকিব আউট হবার পর অধিনায়ক সুমনও বেশি রান করতে পারেননি; তবে আর বিপদ ঘটতে দেননি মুশফিক-আশরাফুল। ৯ বল বাকি থাকতে ৫ উইকেটের জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতবধের স্বাদ পায় টাইগাররা। 

    দুই মেডেনসহ ৩৮ রানে চার উইকেট তুলে নিয়ে আবারো ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হন মাশরাফি বিন মর্তুজা।

     

     

    ১৬ মার্চ ২০১২ঃ

     

    এশিয়া কাপ, মিরপুর, ঢাকা! কোনো মাইলফলক কিংবা বড় কোন আসরেই ভারতের বিপক্ষে জ্বলে ওঠে বাংলাদেশ। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না; শচীনের শততম সেঞ্চুরির দিনে ভারতকে আবারো ৫ উইকেটে হারায় টাইগাররা! ম্যাচশেষে ষোল কোটি লোকের গর্জনে এই অর্জন সেদিন চাপা পড়ে গিয়েছিল।

     



     

    শুরুতে গম্ভীরকে হারালেও খেলার রাশ টেনে নিয়েছিলো শচীন-কোহলির জুটি! কোহলির সাথে ১৪৮ রানের জুটির পর রায়নার সাথে ৮৬ রানের জুটি গড়েন শচীন; আর নিজে পৌঁছে যাচ্ছিলেন এক ল্যান্ডমার্কে! সাকিবের বলটাকে যখন স্কয়ার লেগে ঠেলে দিলেন, পুরো স্টেডিয়াম তখন হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সম্মান জানাতে, সেদিন পর্যন্ত করা ৪৭১৩ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির সবচে বিখ্যাতটি দেখার গৌরবময় অনুভূতি নিয়ে। শতকের শতক দেখার যে অপার্থিব দৃশ্য পৃথিবীতে আর কেউই কোনদিন দেখবে না হয়ত। 

    আশি রানের পরে খোলসে ঢুকে পড়া শচীন কিছুটা হলেও স্লথ করে দিয়েছিলেন রানের চাকা; রায়না-ধোনি শেষদিকে কিছুটা চেষ্টা চালালেও তিনশ' রান পেরোতে পারেনি ভারত; মাঝে ৪৭-তম ওভারে শচীন-রায়নাকে পর পর দুই বলে ফিরিয়েছিলেন মাশরাফি। অবশ্য বাংলাদেশের সামনে ২৯০ রানের বড়সড় এক টার্গেট দেয় ভারত। মাশরাফির দুই উইকেটের সাথে শফিউল-রাজ্জাক পান একটি করে উইকেট। 

    শুরুতে অবিবেচকের মত খেলে নাজিম উইকেট হারালেও তামিম-জহুরুল ঘামেভেজা শ্রমিকের মত অল্প অল্প করে ইনিংসের ভিত গড়া শুরু করলেন। দু'জন মিলে ১১৩ রান যোগ কররার পর নিজের ৫৩ রানের মাথায় বিচ্ছিন্ন হলেন অষ্টম ওয়ানডে খেলতে নামা জহুরুল। এরপরেই টিম ম্যানেজমেন্ট নিলেন ম্যাচের সবচে বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটি- ইনফর্ম নাসিরকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দিয়ে চারে পাঠানো। বিতর্কের পর দলে ফেরা তামিম স্বভাববিরুদ্ধ দৃঢ়তার পর যখন ৭০ রান করে ক্রিজ ছাড়লেন, তখন দরকার ৯৭ বলে ১৩৪। এরপর শুরু হল সাকিবের ক্যামিও; ৩১ বলে ৪৯ রানের সাথে পাওয়ারপ্লেতে ৪৬ রান নিয়ে দলকে জয়ের ঘ্রাণ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন বিতর্কিত এক স্টাম্পিংয়ে আউট হয়ে। বাকি কাজটুকু সারলেন মুশফিক; তিন চার আর তিন ছক্কায় ২৫ বলে অপরাজিত ৪৬ রানের ইনিংসের মাধ্যমে; নাসির-ও এর ফাঁকে করে নিয়েছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। আর, রিয়াদের ম্যাচজয়ী বাউন্ডারিটা সীমানার দড়ি ছোঁয়ার আগেই পর্দার সামনের দর্শকরা পৌঁছে গেল রাস্তায়। 

    ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ক্যামিও ইনিংসের জন্য ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হন সাকিব আল হাসান।