• বুন্দেসলিগা
  • " />

     

    একজন 'অজাতশত্রুর' গল্প

    একজন 'অজাতশত্রুর' গল্প    

    ১.

    চমক জন্ম দেওয়ায় এফএ কাপের জুড়ি মেলা ভার। ০৬-০৭ মৌসুমে এমনই এক অঘটনের দ্বারপ্রান্তে ছিল ক্ষুদে লুটন টাউন। লিভারপুলের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও একটা সময় ৩-২ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল বেডফোর্ডশায়ারের ক্লাবটি। সত্তর মিনিটের মাথায় মধ্যমাঠে বল পেলেন বাদামী চুলের একজন, নাম জাবি আলোনসো। ৪০ গজ দূর থেকে চিপ করলেন লুটন কিপারকে। কেনিলওয়ার্থ স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকরা বিস্ফারিত নয়নে দেখলেন, কিপারের মাথার ওপর দিয়ে বল জড়ালো জালে। লজ্জাজনক অবস্থা থেকে সমতায় ফিরলো ‘অল রেড’রা।

     

    ৩-২ এ পিছিয়ে পড়েও ৪-৩ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল লিভারপুল। ৯০ মিনিটে কর্নার পায় লুটন। সমতাসূচক গোলের লক্ষ্যে লিভারপুল ডিবক্সে যোগ দেন লুটনের কিপারও। কর্নার থেকে ক্যারাঘারের ক্লিয়ারেন্সে বল পেলেন আলোনসো। বাঁ-প্রান্তে ততক্ষণে পাসের জন্য চেঁচাচ্ছিলেন জেরার্ড। দুপাশে দুজন থাকলেও নিজেদের অর্ধ থেকে বাঁ পায়ে শট নিলেন তিনি। আকাশে দুহাত উঁচিয়ে জেরার্ডসহ আবারো হতভম্ব হয়ে গেলেন উপস্থিত সবাই। প্রায় ৭০ গজ দূরের সেই শট জালে জড়াতেই সতীর্থদের উদযাপনের মাঝে হারিয়ে গেলেন এই স্প্যানিয়ার্ড। জেরার্ড, রিসেদের বুনো উল্লাসে কেবল এক গাল হেসেই মাঠ ছাড়লেন তিনি।

     

     

    ২.

    জাবি আলোনসোর পুরো ক্যারিয়ারের ‘হাইটলাইট’ বোঝাতে এই এক মূহূর্তই যথেষ্ট। । কৈশোর থেকেই নেতৃত্বের ছাপটা তার মাঝে দেখেছিলেন ভিসেন্তে দেল বস্ক। এইবারে ধারে খেলার সময়ই পাকা জহুরীর মত হীরে চিনে ফেলেছিলেন এই স্প্যানিশ কোচ। বন্ধু জন টোশাককে (তৎকালীন রিয়াল সোসিয়াদাদ কোচ) বলেছিলেন, “ছেলেটার বয়স মাত্র ২০! এত অল্প বয়সে এত পরিণত খেলা খুব কমই দেখেছি। তোমরা কিভাবে ওকে ধারে পাঠিয়েছো?!”। দেল বস্কের কথায় যেন নড়ে বসলেন টোশাক। মধ্যমাঠে ঝানু মিডফিল্ডারের অভাবটা এমনিতেই বেশ ভোগাচ্ছিল সোসিয়াদাদকে। দেরী না করে আলোনসোকে কেবল ফিরিয়ে এনেই ক্ষান্ত দেননি এই ওয়েলশ কোচ, অধিনায়কের গুরুদায়িত্বটাও চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার কাঁধে। আলোনসোর অধিনায়কত্বে লিগে ঐ মৌসুমে রানারআপ হয়েছিল সোসিয়াদাদ, একবিংশ শতাব্দীতে যা এখনো তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

     

    সোসিয়াদাদের সেই যুবক এরপর চষে বেড়িয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা, বুন্দেসলিগা। এত দ্রুত খেলার ধরনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন, এক সংবাদ সম্মেলনে টোশাক বলেছিলেন, “প্রশ্ন এটা নয় যে আলোনসো নতুন কোনো লিগে মানিয়ে নিতে পারবে কি না, প্রশ্নটা হওয়া উচিত ওই লিগ আলোনসোর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা”...

     

    ৩.

    বছর দশেক পরের কথা। সময়ের সাথে চেহারায়ও এসেছে পরিবর্তন। আগেকার ‘ক্লিন শেভড’ আলোনসোর এখন চোয়ালভর্তি লালচে চাপ দাঁড়ি, চুলেও পাক ধরতে শুরু করেছে বলে। ১৬-১৭ মৌসুমের মাঝামাঝিতে ঘোষণা দিলেন, বুটজোড়া তুলে রাখবেন মৌসুম শেষে। চলতি মে মাসের ২০ তারিখে বায়ার্নের হয়ে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে নেমেছিলেন জাবি আলোনসো।ম্যাচে বায়ার্নের প্রথম গোলের উৎস তিনিই। ৮১ মিনিটে যখন আঞ্চেলত্তি তাঁকে উঠিয়ে নিচ্ছিলেন, ‘জাবি! জাবি!!’ গর্জনে তখন মূহূর্মূহূ কেঁপে উঠছিল আলিয়াঞ্জ অ্যারেনা। মাত্র তিন মৌসুম খেললেও বিদায়বেলায় কাঁদিয়েছেন অসংখ্য বায়ার্ন সমর্থকদের।

     

    আলোনসোর মাহাত্ম্য এখানেই। ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানী- ইউরোপসেরা তিন লিগে খেললেও নিন্দুক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কপালের ফেরে নিজের শেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচটা খেলেছিলেন সাবেক ক্লাব রিয়ালের বিপক্ষেই। দ্বিতীয় লেগে বদলি হওয়ার সময় প্রিয় ‘মিডফিল্ড জেনারেল’কে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলে সমগ্র বার্নাব্যু,যা থামেনি ম্যাচ শেষেও!

     

    ৪.

    সদা হাস্যোজ্জ্বল, মিষ্টভাষী আলোনসোর ক্যারিয়ারে সাফল্যের পাশাপাশি ছিল বিতর্কের কালো অধ্যায়। রিয়ালে পাঁচ বছর কাটিয়ে বায়ার্নে যোগ দিয়ে ক্যাসিয়াসের বদলে নয়্যারকেই সেরা গোলরক্ষক হিসেবে বেছে নেন তিনি। এমনকি একসময়ের সতীর্থ রোনালদোর বদলে নয়্যারের হাতেই ব্যালন ডি’অর দেখতে চান- মিডিয়ায় এমনটা বলায় বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে।

     

    এই ঘটনার পর স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কা জানায়, ১১-১২ মৌসুমে লিগ জয়ের পর থেকেই আলোনসোর সাথে মাদ্রিদ সতীর্থদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। মূল কারণ হিসেবে গোল বা শিরোপা উদযাপনে আলোনসোর নির্লিপ্ততাকেই চিহ্নিত করে মার্কা। এমনকি এ নিয়ে ক্যাসিয়াসের সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কথাও জানায় তারা। মার্কার এমন স্পর্শকাতর অভিযোগ অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন ক্যাসিয়াস, মরিনহো। এমনকি নয়্যারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তে চটেননি রোনালদোও। আলোনসোর ক্যারিয়ারে‘কালো অধ্যায়’ বলতে গেলে কেবল এটিই। ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম ‘জেন্টেলম্যান’-এর উপাধি কেন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করে- তা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না।

    ৫.

    এমন গুঞ্জনের পরও রিয়ালের সাথে সখ্যে এতটুকু ছেদ পড়েনি আলোনসোর। গত মৌসুমে রিয়াল একাদশ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন রামোস, মদ্রিচ, রোনালদোদের। ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের হয়েই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত লিগ জিতেছিলেন তিনি। এখনো ছুটিতে প্রায়ই আসেন মাদ্রিদ শহরে। এমনকি গত মৌসুমে বুন্দেসলিগায় শীতকালীন ছুটিতে রিয়াল-এইবার ম্যাচ দেখতে বার্নাব্যু এসেছিলেন আলোনসো।

     

    ফ্রেইবুর্গের সাথে শেষ ম্যাচের আগে রামোস, মার্সেলোরা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন প্রিয় সতীর্থকে। সেই সাথে মাদ্রিদ সমর্থকদের কমিউনিটি ‘আল্ট্রাস সার’ও শুভকামনা জানিয়েছিল আলোনসোকে।

     

    ৬.

    প্রায় দুই দশকের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে জিতেছেন প্রায় সবই। একই ম্যাচে অবসর নেওয়া বন্ধু লামের চেয়ে আলোনসোর আক্ষেপের তালিকাটা বেশ ছোটই। গোধূলীবেলায় এসে জানিয়েছেন, লিভারপুলের হয়ে ইংলিশ লিগ জিততে না পারাটাই সবচেয়ে বেশি পোড়ায় তাকে। এর সাথে দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে ’১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়া এবং বহিষ্কারাদেশের কারণে রিয়ালের ‘লা ডেসিমা’ ফাইনাল খেলতে না পারা। জার্মান সংবাদপত্র ‘বিল্ড’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “রিয়ালের হয়ে সব জেতার পর নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চাচ্ছিলাম। বায়ার্নের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলে ভাল লাগতো, কিন্তু আমি যথেষ্ট খুশি”।

     

    মাদ্রিদের পর বায়ার্নেও পাশে পেয়েছেন আঞ্চেলত্তিকে। প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে কার্লো বলেন, “ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের মূল কাজ হল খেলা বোঝা এবং ঐ অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। আলোনসোর অন্যতম শক্তি ছিল, খেলাটাকে সে নিজের পছন্দের গতিতে নিয়ে আসতে পারতো”। রসিকতা করে আলোনসোকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনী’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন এই ইতালীয়ান কোচ।

     

    আলোনসোর ঠান্ডা মাথার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল ফাইনাল। তিন গোলে পিছিয়ে পড়া লিভারপুল সমতায় ফিরেছিল তার পেনাল্টি থেকেই (মিস করলেও ফিরতি বল ঠিকই জালে পাঠিয়েছিলেন)। শুটআউটেও দিদাকে পরাস্ত করেছিলেন।

     

    ৭.

    গিপুজকোয়ার সেই ছোকড়ার নামে একসময় বিশ্ববাসীর মুখে মুখে ফিরবে- এমনটা খুব সম্ভবত ভাবেননি আলোনসো নিজেও। যাওয়ার বেলায় তাই আক্ষেপ ভুলে সুখস্মৃতি গুলোকেই পুঁজি করে বিদায় জানিয়েছেন ‘দ্যা বিউটিফুল গেম’কে। ক্যারিয়ারজুড়ে একাধিকবার পরিবার সঙ্গ দিতে না পারার আক্ষেপের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। মেয়ে অ্যান তো বাবাকে রীতিমত নির্দেশই দিয়ে রেখেছে, এখন থেকে প্রতিদিন তাকে স্কুল আনা-নেওয়া করতে হবে। ব্যস্ততার কারণে ছেলে জনের সাথেও সময় কাটানো হয়ে ওঠেনি মন মত। ২০০৯-এ গাঁটছাড়া বেঁধেছিলেন স্ত্রী নাগোরের সাথে। অবসরের পর স্বামীর কাছে সন্তানদের মত দাবি রেখেছেন সহধর্মিণীও। অবসর সময়টা পুরোপুরি পরিবারের জন্য রাখলেও ফুটবলটা একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছেন না আলোনসো। কোচ হওয়ার ইচ্ছাটা অনেক আগেই পোষণ করেছেন। কোচ হিসেবেই ফুটবলে ফিরবেন- নিশ্চিত করেছেন শেষ ম্যাচের পরেও। খেলোয়াড় আলোনসো যেমন ছিলেন, কোচ আলোনসো নিশ্চয় সেই কীর্তি ছুঁতে চাইবেন!