• চ্যাম্পিয়নস ট্রফি
  • " />

     

    'মাশরাফি, মজা তো এখানেই হচ্ছে!'

    'মাশরাফি, মজা তো এখানেই হচ্ছে!'    

    হঠাৎ নেমে আসা বৃষ্টিটা থেমেছে আবার। দোয়েল চত্বরের পাশে, কার্জন হলের পাশ ঘেঁষা যাত্রী ছাউনিতে দুজন পুলিশ বসে। পেছনে একটা সুগন্ধীর বিজ্ঞাপনঃ ‘লিডারদের পারফরম্যান্স দীর্ঘস্থায়ী'। পাশেই মাশরাফির মুখটা ফুটে আছে। পুলিশ দুইজন হয়তো অপেক্ষা করছেন, দায়িত্ব শেষ হবে কখন তাদের।  

     

    ****

     

    মাশরাফি বিন মুর্তজা অপেক্ষা করছেন।

    একটা ব্রেকথ্রু প্রয়োজন। মোহাম্মদ শাহজাদ ও হাশমতুল্লাহ শাহিদির জুটিটা ভাঙ্গা প্রয়োজন। মাহমুদউল্লাহর কথাই ভেবে রেখেছিলেন, তাঁকেই আনবেন। মোসাদ্দেকের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করেই। ব্যাটিং অভিষেকেই দারুণ এক ইনিংস খেলে দলকে ভাল একটা স্কোর এনে দিয়েছেন। আত্মবিশ্বাস থাকার কথা তুঙ্গে। মোসাদ্দেক প্রথম বলেই হাশমতুল্লাহকে এলবিডাব্লিউ করলেন। তিনি হয়ে গেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই উইকেট পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশী।

    মোসাদ্দেকের উইকেটটাকে কী বলা যায়, ‘বিগিনারস লাক’?

    তাস পিটিয়েছেন তো? কোনো আড্ডায়, স্কুল ফাঁকি দিয়ে, কলেজ হোস্টেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরের এক কোণায়। যে বন্ধুটা নতুন খেলা শিখেছে, দেখবেন, কী ভাল ভাল কার্ড পড়ে তার হাতে। ‘বিগিনারস লাক’। ‘নবিশি ভাগ্য’। মোসাদ্দেক হোসেনের অভিষেকটা কি সেরকমই?

    আর মাশরাফির এই সিদ্ধান্তটাকে কী বলবেন? ‘হিসাব করে নেয়া ঝুঁকি’? বাজি? মোসাদ্দেকই কি ছিলেন মাশরাফির তুরুপের তাস সেদিন?

     

    ****

     

    মাশরাফি বিন মুর্তজা অপেক্ষা করেছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপটা চোখের সামনে হয়ে গেল। তিনি খেলতে পারলেন না। মাশরাফির কান্না অবশ্য সেদিন অপেক্ষা করতে চায়নি। চার বছর পর আরেকটা বিশ্বকাপে গেলেন মাশরাফি, অধিনায়ক হয়ে।

    মাশরাফি অপেক্ষা করে থাকলেন। রুবেল হোসেনের সেই জাদু ডেলিভারিটার অপেক্ষা। অ্যাডিলেড ওভাল। উড়ছেন রুবেল হোসেন। এপাশে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। যেন হারিয়ে যেতে চাইলেন সবুজের আশ্রয়ে। গোটা দল ঝাঁপিয়ে পড়লো একে একে। উঠে দাঁড়ালেন। পুরষ্কার বিতরণীতে মাথায় লাল-সবুজের স্কার্ফরুপী পতাকা। ‘আমার মনে হয়, রুবেল এখন অনেক “হ্যাপি”।’ রুবেলের সুখী হওয়ার কারণ আছে। সুখী হওয়ার কারণ আছে তো তারও। দেশ ছাড়ার আগে যে কোয়ার্টার ফাইনালের কথা বলে গিয়েছিলেন, তার অপেক্ষা যে ফুরোলো!

    একসময় ফুরোলো টি-টোয়েন্টিতে তার যাত্রাও। 

    চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিরও আগে, শ্রীলঙ্কা সফর শেষে, সেদিনও সবাই অপেক্ষায়। মাশরাফি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়ে মুখ খুলবেন। কেন হঠাৎ করে অবসর নিলেন, সেটা প্রশ্ন বটে। কোচ-ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আদতে কোনো ‘দ্বন্দ্ব’ আছে কিনা, প্রশ্ন সেটাও। অপেক্ষায় ছিলেন বিমানবন্দরে থাকা সাংবাদিকরাও। সেখানেই মাশরাফি কথা বললেন, মুশফিক কথা বললেন, যে বোর্ড মাশরাফিকে অধিনায়ক বানানোর জন্য রীতিমতো পরিকল্পনা করে এগিয়েছিল একসময়; তার প্রেসিডেন্টও কথা বললেন। ‘মাশরাফি অধিনায়কত্ব ছেড়েছে, টি-টোয়েন্টি ছাড়ে নাই’, প্রেসিডেন্টের এমন কথা শুনে পাশ থেকে হেসে দিলেন মাশরাফি। মুখটা একটু ওপরের দিকে তুললেন।

    এর আগে বা পরে বললেন, ‘এখনও তো ওয়ানডে খেলছি। মজা হবে সেখানেই।’

     

    **** 

     

    মিরাজকে বোলিং করালেন ১ ওভার। সাকিবকে তাও না। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই ম্যাচে আদতে আশা নেই তখন। ২০ ওভারের আগেই বৃষ্টি নামার সম্ভাবনাও প্রবল। ম্যাচে ফল আনতে ২০ ওভার খেলার বাধ্যবাধকতা আছে। সেই ২০ ওভারের কোটা যদি পিছিয়ে দেয়া যায়, একটা পয়েন্ট মিললেও মিলতে পারে। স্লো ওভার রেটের কারণে নিষেধাজ্ঞার হুমকি আছে। বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের কথা আছে। আম্পায়ারদের তাড়া আছে। তবুও মাশরাফি অপেক্ষা করলেন। বৃষ্টির।

    একটা পয়েন্ট পেলেন মাশরাফি। ঝুঁকি নিয়ে। প্রকৃতির হাবভাব দেখে যেন খেললেন একটা জুয়াই। 

    মাশরাফি বিন মুর্তজা অপেক্ষা করছেন।

    তুরুপের তাসটা খেলবেন বলে। যাকে ঠিক করে রেখেছেন, তিনি অফস্পিনার। ক্রিজে ডানহাতিদের আনাগোণা, বাতাসটাও সমর্থন দিচ্ছে না। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে? নিউজিল্যান্ডের মিডল অর্ডার উইলিয়ামসন-টেইলরের পর ভঙ্গুর, তবে আছেন সব ‘বিগ-হিটার’। বামহাতি নিশাম এলেন। মাশরাফির সময় এলো, তুরুপের তাসটা চালিয়ে দেয়ার। মোসাদ্দেক হোসেন, মাশরাফির তুরুপের তাস। সেই নবিশি ভাগ্যের যাদুমন্ত্রের দিন ফুরিয়ে এসেছে, আগের ম্যাচে বাদ পড়া মোসাদ্দেক এদিন খেলতে নেমেছেন ১৭তম ওয়ানডে। এক ওভার সময় নিলেন মোসাদ্দেক। দ্বিতীয় ওভারেই এনে দিলেন জোড়া সাফল্য। খেলা জমে গেছে। পরের ওভারে আরেকটা আঘাত তার। তিন পাশায় তিন দান।  

     

    ****

     

    ৩৩ রানে ৪ উইকেট নেই। তামিম প্রতিদিন রান করবেন না। মুশফিকের টেকনিক মার খেয়ে যাবে। হরতন, রুইতন, ইস্কাপন, চিরাতনের দুইজন বাকি তখনও। সাকিব-মাহমুদউল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছিল। তবে মাশরাফি অপেক্ষা করলেন, দলের রান কখন ১০০ হয়। মাশরাফি বিশ্বাস করা শুরু করলেন।

    দুইজন ২০০ পেরিয়ে যাবেন, এটা ভাবতে পারেননি।

    সাকিব ফিফটির পর ব্যাট তুললেন না। কাজ বাকি। সেঞ্চুরি করে মাহমুদউল্লাহকে জড়িয়ে ধরলেন। ড্রেসিংরুম উদ্বেলিত। পেছনের সারিতে মাশরাফি হাততালি দিচ্ছেন। সেই মুখচ্ছবিটার বর্ণনা কেমন? সন্দেহ লেপ্টে আছে? যদি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে ব্যাটিং লাইন-আপ! নাহ। মাশরাফি আদতে করছিলেন অপেক্ষা। উদযাপনের অপেক্ষা।

    মোসাদ্দেক হোসেন থার্ডম্যানে চার মারলেন। যে মোসাদ্দেক শুরু হয়েছিল, শেষ হলো তাকে দিয়েই। ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মাশরাফি। হাত পাকিয়ে উল্লাসে মত্ত। যেন বাঁধ মানছে না আনন্দ! কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। মাশরাফির যেন খেয়ালই নেই! কোচ হয়তো অভিনন্দন জানাতেন।

    বাংলাদেশের কাজটুকু করে রাখলো বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিকে তাকিয়ে সবাই। মাশরাফি দুই দলকেই শুভকামনা জানালেন। এখন তারা দর্শক। আর অপেক্ষায় বাংলাদেশ। অপেক্ষায় বাংলাদেশীরা।

    ফিঞ্চ-স্মিথের জুটিটা ভাঙবে না? ম্যাজিক ডেলিভারিটা করছেন না কেন স্টোকস? আহা, সেই স্টোকস, কদিন আগেও যার ভূত ছাড়িয়েছে বাংলাদেশীরা। অস্ট্রেলিয়া আটকে যায়।

    আবার ভেড়ে সেই স্টোকসে। সঙ্গে মরগান। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যিনি বাংলাদেশে আসেননি। এই দুইজনের জুটি উচ্ছ্বাসে ভাসায় বাংলাদেশকে। স্টোকসকে করা সাকিবের ‘ব্যঙ্গ’ স্যালুট শোভা পায় ফেসবুকে। স্টোকসকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন সবাই! ক্রিকেট, কতো রঙ্গ দেখাতে পারে।

    মাশরাফির অপেক্ষা ফুরোয়। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের খবর নিশ্চয়ই রেখেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তিনি দলকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন সেমিফাইনাল।

    মাশরাফি হয়তো কোচকে পরে জড়িয়ে ধরেছেন। হয়তো কোচকে বলেছেন, ‘মজা হচ্ছে, কোচ!’

     

    ****

     

    মাশরাফি একটা ব্রেকথ্রুর জন্য অপেক্ষা করেন। তুরুপের তাসটা চালানোর ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। অপেক্ষা করেন বৃষ্টির, অপেক্ষা করেন সঠিক একটা মুহুর্তের।

    সেই মাশরাফি আর তার দল এখন অপেক্ষা করছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলতে। কতো দর্শক, কতো ভক্ত, কতো ক্রিকেটপ্রেমী অপেক্ষা করে ছিলেন এতোদিন। এমন একটা মুহুর্তের জন্য।

    সেই মুহুর্তশেষে যাই হোক, যেটাই ঘটুক; সবাই জানবেন, ‘মজা হবে’।

    আর হ্যাঁ।

    ‘লিডারদের পারফরম্যান্স দীর্ঘস্থায়ী’।