উপমহাদেশের সাফল্য কি ফ্লুক?
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউ যদি বলত, উপমহাদেশের তিনটি দল সেমিফাইনাল খেলবে, কয়জন সেটার পক্ষে বাজি ধরতেন? র্যাঙ্কিং-ইতিহাস কিছুই যখন ছিল না পক্ষে, কম কম লোকেরই অত বড় বুকের পাটা ছিল। অথচ সেই অভাবিত ব্যাপারটাই হয়ে গেছে ; বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবার খেলছে সেমিফাইনালে।
একটুর জন্য সেই ঘটনা শুধু অভাবিত নয়, অভূতপূর্বও হয়ে যেত। সেই ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপ থেকে শুরু, এরপর আইসিসির এতগুলো আসরে উপমহাদেশের তিনটি দলের সেমিফাইনালে ওঠার কীর্তি আছে একটি। ২০১১ বিশ্বকাপের সেমিতে খেলেছিল ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা- সেটাও নিজেদের মাঠেই। ঘরের বাইরে উপমহাদেশের পতাকা আর কখনো এতোটা পতপত করে ওড়েনি।
অথচ এক ভারত ছাড়া বাকিদের নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার সুযোগ ছিল কমই। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান তো র্যাঙ্কিংয়ের ছয়, সাত ,আটেই পড়ে আছে। বাংলাদেশ গত দুই বছরে অনেকটা উন্নতি করেছে বটে, তবে বড় কোনো আসরের সেমিফাইনালে তো কখনোই খেলা হয়নি। পাকিস্তানের ওয়ানডে দল অনেক দিন ধরেই চলতে শুরু করেছে উল্টোপথে, আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে সর্বশেষ সেমিফাইনালে খেলার ঘটনাও সেই ২০১২ সালের। এর পর বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সবখানেই তাদের অংশ নেওয়া মানেই ব্যর্থতার গল্প। শ্রীলঙ্কা ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল বটে, তবে সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনের পরের যুগের এই দলটাকে যেতে হচ্ছে অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান ক্রিকেটেও গত বেশ কিছুদিন ধরে ম্যাচ পাতানোর ছায়া, একটা সময় তো চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কাতেই ছিল। সেই তুলনায় বাংলাদেশ দলের যাত্রাটা অনেক বেশি মসৃণ।
অথচ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানও উঠে গেল সেমিতে। নিজেদের হাত থেকে সুযোগ ফেলে না দিলে পাকিস্তানের জায়গায় থাকতে পারত শ্রীলঙ্কা। তাতে অবশ্য উপমহাদেশের রাজত্বের কোনো পরিবর্তন হতো না। অথচ টুর্নামেন্টে এই তিন দলের গ্রুপ পর্বের ম্যাচের পরেই অনেকে বলে ফেলেছিলেন, র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম পাঁচের সঙ্গে বাকিদের পার্থক্যটা একটু বেশিই। বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান কেউই নিজেদের প্রথম ম্যাচে তেমন একটা দাঁড়াতেই পারেনি। সেই কথা কদিন পরেই ফিরে এসেছে বুমেরাং হয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ভারতের জয়ের পরেই বিরাট কোহলির কাছে করা হয়েছিল প্রশ্নটি। এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে উপমহাদেশের এই সাফল্যের রহস্য কী? ভারত অধিনায়ক অবশ্য খুব স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি, ‘আমি ঠিক জানি না কেন উপমহাদেশের দলগুলো ভালো করছে। সবাইকে আমি কৃতিত্ব দেব, তারা সবাই ভালো খেলেছে। আমার মনে হয় খেলোয়াড়েরা চাপের সময় কী করতে হয় সেটার সঙ্গে আরও বেশি অভ্যস্ত হচ্ছে। আমরা এখন অনেক বেশি সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলছি, সেটাও একটা কারণ হতে পারে।’
তবে কোহলির শেষ কথাটা কিন্তু খুব একটা ধোপে টিকছে না। গত বছর ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা মিলে যেখানে খেলেছে ৫২টি ওয়ানডে; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড মিলে খেলেছে ৮২টি। এই বছরও উপমহাদেশের চার দল এখন পর্যন্ত খেলেছে ৩৮টি, আর অন্য চারটি দল এখন পর্যন্ত খেলেছে ৫৪টি। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা অবশ্য বছরখানেকের মধ্যে ইংল্যান্ডে ওয়ানডে খেলে গেছে, বাংলাদেশ তো খেলেছে সেই সাত বছর আগে। সেই স্মৃতি কারও জন্যই খুব একটা সুখকর নয়। একমাত্র ভারতেরই একমাত্র ইংল্যান্ড থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে ফেরার সুখস্মৃতি আছে।
কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ভালো করার কারণ কী? ইংল্যান্ডের উইকেট অবশ্য এবার শুরু থেকেই ব্যাটসম্যান বান্ধব। আইসিসির টুর্নামেন্টে উইকেট থাকে সেরকমই, পিচ অনেকটাই ফ্ল্যাট। কয়েকটা স্পেল বাদ দিলে সেভাবে ইংল্যান্ডের সেই চিরন্তন সুইংয়ের দেখাও মিলছে না। তিন দেশের সাফল্যের এটা হয়তো কারণ হতে পারে।
তবে র্যাঙ্কিং, অতীত ইতিহাস বলছে, এই সাফল্য ধরে রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সামনের বিশ্বকাপ এই ইংল্যান্ডে, আর দুই বছর বাদেই। সেখানে এই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে না পারলে এবারের ‘কীর্তিটা’ হয়তো ফ্লুক হিসেবেই থেকে যাবে।