গতিময় হ্যাটট্রিক বৃত্তান্ত

গেল শনিবার গ্রানাডার বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আট মিনিটের মধ্যেই হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, এখনকার সময়ে এহেন কীর্তি অভাবনীয়ই বৈকি। তবে দ্রুততম হ্যাটট্রিকের অতীত ইতিহাস বলছে ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত সময়টায় ঘটে গেছে বেশ কিছু অসম্ভব দ্রুতগতির হ্যাটট্রিক, যার মধ্যে একটি এখনও জায়গা দখল করে আছে ‘গিনিস বুক অব রেকর্ডস’-এ।
২০০১ সাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত দ্রুততম হ্যাটট্রিক ছিল জিমি ও’কনরের ১৩৩ সেকেন্ডব্যাপী এক হ্যাট্রিক। ষাটের দশকের সেই সময়টায়(১৯৬৭) ম্যাচ সম্প্রচারের চলটা একেবারেই আনকোরা, মূলত বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচই সম্প্রচারিত হতো তখন। তবে ও’কনরের ভাগ্য বলতে হবে, শেলবোর্ন ও বোহেমিয়ার মধ্যকার আইরিশ লীগের ঐ ম্যাচটা সম্প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিল একটি টেলিভিশন চ্যানেল। আর সেই ‘ফুটেজ’ দেখেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় ও’কনরকে।
মজার ব্যাপার হল, এটা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দ্রুততম হ্যাটট্রিক ছিল না। ফুটবল ইতিহাসের দ্রুততম হ্যাট-ট্রিকটি হয়ে গিয়েছে তারও তিন বছর আগেই, সে গল্প আসছে একটু পর। ও’কনরেরটা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেও ১৯৭৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বে দ্রুততম হ্যাটট্রিক নায়ক ধরা হতো আর্জেন্টাইন ফুটবলার এডোয়ার্ডো ম্যাগলিওনিকে, যদিও সেটা অনানুষ্ঠানিকভাবে। ১৯৭৩ সালের ১৮ মার্চ নিজ দেশের ক্লাব ইন্ডিপেন্ডিয়েন্ট-এর হয়ে ১১১তম সেকেন্ডে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিলেন ম্যাগনিওলি। জিমনেসিয়া এসগ্রিমার বিপক্ষে ম্যাচটা শেষ করে ড্রেসিং রুমে ঢুকতেই একজন সাংবাদিক এগিয়ে আসেন তাঁর দিকে আর একটু কৌতুক করেই বলে ওঠেন, “সবসময় ঝামেলা পাকাও তুমি।” এরপর রেকর্ডের ব্যাপারটা তাঁকে খুলে বলতেই বিস্ময়ে থ হয়ে যান ম্যাগনিওলি; “আমি ভেবেছিলাম ১৫ মিনিট লেগেছে ওটা হতে, কিন্তু সে আমাকে বলে যে, দু’মিনিটেরও কম সময়ে ওটা করেছি আমি, বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমার।”
জিমি ও’কনরের আনুষ্ঠানিক রেকর্ডটা ভেঙ্গে দেন এমন একজন খেলোয়াড়, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ঐ হ্যাটট্রিকের গোল তিনটাই যার সারাজীবনের সঞ্চয়। মিশরীয় ফুটবলার আবদুল হামিদ বাসিওনি দেশের হয়ে খেলার সুযোগই পেয়েছেন মাত্র ১৪ ম্যাচ, তাঁরই মধ্যে একটা ছিল ২০০১ সালে নামিবিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের সেই ম্যাচ। ৮-২ গোলে জেতা ম্যাচের ১১৭ সেকেন্ডের মাথায় পূর্ণ হয় বাসিওনির হ্যাটট্রিক, ফিফা বিশ্বকাপের কোন ম্যাচে এখনও পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে দ্রুতগতির। আর চূড়ান্ত পর্বের হিসাব মাথায় নিলে রেকর্ডটা লাজলো কিসের, ১৯৮২-র বিশ্বকাপে এল স্যালভাদরের বিপক্ষে তাঁর হ্যাটট্রিকটা হতে অবশ্য সময় লেগেছিল ‘সুদীর্ঘ’ সাত মিনিট।
এবারে আলোচ্য বিষয়ের মূল নায়কের কাছে আসা যাক, তাঁর নাম টমি রস। আজ থেকে ৫০ বছর আগের(১৯৬৪) একটি ম্যাচে মাত্র ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করেছিলেন এই স্কটিশ ফুটবলার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, ২০০৪ সালের আগ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দূরে থাক, ফুটবল দুনিয়ার আলোচনাতেই ছিল না তাঁর নাম। রেকর্ডের দাবি করে অপমানিতও হয়েছেন অনেকবার। ১৭ বছর বয়সে করা কীর্তির স্বীকৃতি রস পেলেন জীবনের সায়াহ্নে এসে। বহু তদন্ত, বিপরীত দলের গোলরক্ষক ও রেফারির বিবৃতি গ্রহণ এবং গবেষণার পর মাত্র বছর দশেক আগে ‘গিনিস বুক অব রেকর্ডস’-এ ঠাই পায় তাঁর নাম।
দশ বছর আগে দেওয়া সাক্ষাতকারে তাঁর রেকর্ডটা ভাঙ্গা প্রায় অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছিলেন রস। সঙ্গত কারণও আছে এ মন্তব্যের পেছনে। আধুনিক ফুটবলে গোল উদযাপন হয় বিশেষ বিশেষ ভঙ্গিমায়, একটু বেশি সময় নিয়ে, যাতে করে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করা মুখের কথা নয়। ফলে পেশাদার ফুটবলে এই রেকর্ড ভাঙ্গাটা হয়তো কার্যত অসম্ভবই। তবে অপেশাদার খেলায় তো আর এত উদযাপন হয় না, সেই সুযোগেই কিনা, বছর দুয়েক আগে ৭০ সেকেন্ডের মাথায় হ্যাটট্রিক পূর্ণ হয়েছে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত একটি শৌখিন প্রীতি ম্যাচে। এই কীর্তি রেকর্ড বইয়ে জায়গা করে নেয় কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র ও ছবি-সৌজন্যঃ ফিফাডটকম