• বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা
  • " />

     

    দায় কি শুধুই মুশফিকের?

    দায় কি শুধুই মুশফিকের?    

    বিদায়ী ঘন্টাধ্বনিটা কি মুশফিকুর রহিম শুনেই ফেলেছেন? খুব শিগগিরই অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হবে- ঢাকা থেকে নয় হাজার কিলোমিটার দূরের ব্লুমফন্টেইনে সেই সমাপনী হাওয়া মুশফিকের কানে নিশ্চয় পৌঁছেছে। ব্লুমফন্টেইন টেস্ট শেষে অবশ্য বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়কের কথা থেকে আভাস পাওয়া গেল, মনে মনে তিনি নিজেও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ‘সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন’, ‘নিজের সেরা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন’, এসব মনে করিয়ে দেওয়ার পর মুশফিক যখন বললেন সিদ্ধান্তটা বোর্ডের, তাহলে কি মাথার কাছাকাছি নেমে আসা অদৃশ্য খড়্গটা তাহলে দেখেই ফেলেছেন? কিন্তু সম্পূরক প্রশ্নটা সাথে সাথেই চলে আসছে, মুশফিককে সরিয়ে দিলেই কি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে? দায় কি শুধুই তাঁর?
     

     

    উত্তরটা মুশফিকই আজ সংবাদ সম্মেলনে দিয়ে দিয়েছেন কিছুটা। ‘দল ভালো করলে কৃতিত্ব ম্যানেজমেন্টের, আর খারাপ করলে দোষ অধিনায়কের’- খেদটা ভালোভাবেই বোঝা গেছে। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সফলতম অধিনায়ক তিনি, দশটি জয়ের সাতটিই এসেছে তাঁর নেতৃত্বে। সেটার কতটা কৃতিত্ব তাঁর কাছে গেছে, আর কতটা টিম ম্যানেজমেন্ট বা বোর্ডের, সেই প্রশ্ন মুশফিক রাখতেই পারেন।

    তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন চিহ্নটা এখন অনেক বেশি বড়, কিন্তু সেটা যে আগে ওঠেনি এমন নয়। একটা সময় বাংলাদেশের তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক ছিলেন। ২০১৩ সালে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছিলেন, ২০১৫ বিশ্বকাপে মুশফিকই থাকবেন অধিনায়ক। পরের বছরেই অবশ্য তা বদলে যায়, দায়িত্ব পান মাশরাফি। এরপর থেকে সীমিত ওভারে বাংলাদেশের ক্রিকেটে মুশফিক আর অধিনায়কত্ব পাননি। কিন্তু এরপর টেস্ট অধিনায়কত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল বেশ কয়েক বার।

     

     

    ২০১৫ সালে ওয়ানডেতে যখন বাংলাদেশের নিজেদের চেনানোর শুরু, টেস্ট ক্রিকেটের পাথুরে চত্বরে হাঁটতে গিয়ে তখনও প্রতিনিয়রত রক্তক্ষরণ হতো বাংলাদেশের। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা টেস্টে টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে কম তোলপাড় হয়নি। শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাট পিচে ম্যাচটা বড় ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। সেবার ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির সাফল্যে ঢাকা পড়ে যায় সাদা পোশাকের ওই হোঁচট।

    সে বছর সেই অর্থে মুশফিককে নিয়ে আর প্রশ্ন ওঠেনি। কাকতালীয়ভাবে এরপর যেবার উঠেছে, সেবারের ম্যাচটা বাংলাদেশের জন্য ছিল ইতিহাস গড়ার। গত বছর নিজেদের মাঠে ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো হারিয়েছিল মিরপুরে, অথচ তৃতীয় দিনের ওই রোমাঞ্চকর দুপুরে মুশফিক আদতে অধিনায়কই ছিলেন না। তামিমের সঙ্গে সাকিব মিলেই সাজিয়েছিলেন ইংল্যান্ড-বধের ছক। জয়ের মৌতাতে মুশফিকের প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকাটাও সেবার চলে গিয়েছিল আড়ালে।

    কিন্তু সাফল্য অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়, ব্যর্থতা সেসব নিয়ে আসে প্রকাশ্যে। তত দিনও মুশফিক নিজের ভূমিকা বা অধিনায়কত্ব নিয়ে মুখ খোলেননি প্রকাশ্যে, সমালোচনা আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টাই করেছেন বরাবর। এই বছর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম টেস্টে এসে হলো ব্যতিক্রম, উইকেটকিপিং নিয়ে প্রশ্নের সময় খেদের সুরেই জানালেন, দলে তাঁর ভূমিকাটা ওপর মহলই ভালো বলতে পারবেন। তখনই প্রশ্ন উঠল, টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে দ্বন্দ্বটা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে কারণে তাঁকে মুখ খুলতে হয়েছে প্রকাশ্যে।

    এরপর ঘটনা ঘটতে লাগল খুব দ্রুত। পর দিনই বিসিবি সভাপতি জানালেন, সমস্যাটা মুশফিকেরই। মাশরাফি বা অন্য কারও বেলায় তা হয় না। আর মুশফিকের ভূমিকা নিয়ে সিদ্ধান্তটা তাঁরই নেওয়ার কথা, তাও মনে করিয়ে দিলেন। এমনকি চট্টগ্রামে নিজে চারে না এসে নাসিরকে এগিয়ে আনার জন্য সমালোচনাও করলেন।

    সেই যে চির ধরা পড়ল, সেটা বিশাল ফাটল হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে। পচেফস্ট্রুমে প্রথমে বল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হলো। ব্লুমফন্টেইনে আবার টসে জিতে বোলিং নিলেন, এবার আরও এক প্রস্থ সমালোচনা হলো। এর পরেই ফাটালেন বোমা, প্রথম দিন শেষে নিজেই চলে এলেন সংবাদ সম্মেলনে। বোলারদের অনুপ্রাণিত করতে পারছেন না, টসে জেতাটাই তাঁর ভুল ছিল এসবের পর জানালেন, কোচদের কথা অনুযায়ী তাঁকে ডিপে ফিল্ডিং করতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠল, মুশফিক কি অধিনায়ক হিসেবে শুধুই কাঠের পুতুল? বিসিবি সভাপতি এর পরেই বললেন, মুশফিকের টসে জিতে বল করার সিদ্ধান্ত তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। অথচ মুশফিক আজ জানিয়েছেন, বোর্ড থেকে কেউ তাঁকে ফোনই দেয়নি।

    সবকিছুই আভাস দিচ্ছে, কোথাও একটা সুর কেটে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকের এমন প্রকাশ্যে অন্দরমহলের খবর জানানোটাও হয়তো অধিনায়কোচিত নয়। সেজন্য মাশুলটাও দিতে হতে পারে খুব শিগগিরই। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র সমাধান? মুশফিককে সরিয়ে দিলেই রাতারাতি বদলে যাবে টেস্ট দল?

    দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন খেলেছে, তাতে সমস্যাটা যে অনেক গভীরে, সেটা বলাই বাহুল্য। পুরো সিরিজে দ্বিতীয় সারির আফ্রিকান বোলিংয়ের সামনেই দাঁড়াতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা, আর বোলাররা লাইন লেংথ ঠিক রাখতেই খেই হারিয়েছেন। সেই দায়ও কি মুশফিকের ঘাড়ে বর্তাবে? এই বছরে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান মুশফিকেরই, সামনে থেকে উদাহরণ তৈরির নিজের কাজটা অন্তত ঠিকঠাকই করছেন। কিন্তু বাকিদের ব্যর্থতার দায় যতটা তাঁর, তার চেয়েও অনেক বেশি কি নির্বাচক-কোচের নয়? ব্যর্থতার জন্য মুশফিককে সরে যেতে হলে দলের নীতিনির্ধারকেরা সে দায় এড়াবেন কী করে?

    সাধারণত ম্যাচের আগে ও শেষে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়কের আসাটা অলিখিত একটা রীতি। কোচেরাও সেই দায়িত্ব অনেক সময় ভাগাভাগি করেন। কিন্তু এই সিরিজেও বাংলাদেশ দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে সংবাদমাধ্যমের সামনে এলেন না কেন? দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সাফল্যের সময় শুধু প্রকাশ্যে আসতে পারলে ব্যর্থতার সময় কেন নয়?

     


    অথচ টস জয়ের চেয়ে অন্য অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা বেশি হওয়া উচিত ছিল। এমন উইকেটে লম্বা সময় ব্যাট করার মানসিক দক্ষতা কয়জন ব্যাটসম্যানের আছে, বোলারদেরই বা কোথায় পিছিয়ে আছে, সেসব নিয়ে আলোচনাই বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মুশফিকের অধিনায়কত্ব-ইস্যুতে দরকারি অনেক কিছু চলে যাচ্ছে আড়ালে। সমস্যা যখন শেকড়ে, ডাল কেটে দিলেই কি তার সমাধান হয়?

    আপাতত হয়তো মুশফিককে বলির পাঁঠা বানিয়ে সেসব ভুলিয়ে দেওয়া হবে। তবে তাঁর জায়গায় যে-ই আসুক, অমোঘ নিয়মে একই চক্রে পড়তে হবে তাঁকেও।  মুশফিককে সরিয়ে দেওয়া হবে সাময়িক একটা টোটকা, কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যখন ভূত, অসুখ সারাবে কে?