ঈশ্বরের ক্রিকেট, শয়তানের অ্যাশেজ : পর্ব ১
১৮৭৭ সালে এমসিজিতে ২২ জন যে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন, তারা নিজেরাও জানতেন না সেটা। কোনটা টেস্ট, আর কোনটা নয়, সেটাই যে ঠিক ছিল না তখন। ক্ল্যারেনস মুডি নামে এক সাউথ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট লেখক ১৮৯৪ সালে তার বই 'সাউথ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট' এর এক অধ্যায়ে একটা তালিকা যুক্ত করলেন। তার মতে যেগুলো টেস্ট, সেগুলো জায়গা পেলো সেখানে। তবে মুডি কিন্তু লর্ডসের এমসিসি বা এমসিজির এমসিসি, কোনও জায়গাতেই কাজ করতেন না। বড় বড় সব ম্যাচের রেকর্ড ঘাঁটলেন, এরপর একাই সিদ্ধান্ত নিলেন কোনগুলো টেস্ট, কোনগুলো নয়। যেমন, যদি দুইটা ইংলিশ দল একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় খেলে, তবে তাদের একটিও টেস্ট নয়। অনেক কিছুর পর তিনি ঘোষণা করলেন, প্রথমট টেস্ট হয়েছিল ১৮৭৭ সালে। একজন 'সাধারণ' লেখক একটা খেলার মর্যাদা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, ব্যাপারটা অদ্ভুত শোনালেও তখন ছিল স্বাভাবিকই। যেমন অদ্ভুত প্রথম টেস্টে ডব্লিউজি গ্রেসের না খেলাটাও।
তবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম দুইটি টেস্ট ছিল বেশ ব্যবসাসফল। এবার ইংল্যান্ড যাওয়ার পালা অস্ট্রেলিয়ান উদ্যোক্তাদের। প্রথম টেস্ট অধিনায়ক জর্জ গ্রেগরি দায়িত্ব পেলেন দল গঠনের। দলে নাম লেখাতে দিতে হবে ৫০ পাউন্ড। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট পদ্ধতি তখন ইংল্যান্ডের ‘পেশাদার-ভদ্রলোক’ শ্রেণিবিন্যাসের মতো নয়। তবে ৫০ পাউন্ড ‘এন্ট্রি ফি’র মতো ব্যাপার ছিল।
দলটা ইংল্যান্ডে এলো। যে দলে নেই কোনও অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী।
১৮৭৮ সালে লর্ডসে গ্রেগরির অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি এমসিসি। ৪৭৪২ জন দর্শক। এমসিসির দলে ডব্লিউজি গ্রেস ছাড়াও ছিলেন আলফ্রেড শ, ফ্রেড মোরলির মতো সেরা দুই বোলার। অস্ট্রেলিয়াকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে নেমেছিলেন তারা, হোম অব ক্রিকেটে নাকানিচুবানি খাইয়ে দেবেন পুঁচকেগুলোকে।
ভেজা উইকেটে ব্যাটিং নিলেন গ্রেস। লেগসাইডে পুল করতে গিয়ে আউট হলেন, বোলার দৌড় শুরু করার পরপরই গ্রেগরি সেখানে ফিল্ডারকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এখনকার ক্রিকেটে এটা ‘নো’, চেতনা বিরোধী। তখন নিছক কৌশল। অস্ট্রেলিয়া যে পরে আরও অনেক কৌশল রপ্ত করবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! গ্রেসের উইকেটে দর্শকদের উচ্ছ্বাস দেখা গেল, দুর্লভ একটা দৃশ্য। সবকিছুর পরও, ‘তারা তো গ্রেসের খেলাই দেখতে আসতেন!’ তবে আন্ডারডগদের শুরুটা ভাল হয়েছে, দর্শকদের উচ্ছ্বাসের কারণ সেটাই।
স্কোর ২ উইকেটে ২৭, বোলিংয়ে এলেন স্পফোর্থ।
প্রথম বদলি বোলার আসতেন ওপেনিং বোলারদের একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতে। স্পফোর্থ এসেছিলেন ক্রিকেটকে চিরতরে বদলে দিতে।
ফ্রেডেরিক রবার্ট স্পফোর্থ ছিলেন সিডনির এক ব্যাংক কেরানি। বাবাও ছিলেন তাই, তিনি নিউ সাউথ ওয়েলসে এসেছিলেন ইয়র্কশায়ার থেকে। শুরুতে স্পফোর্থ ছিলেন ‘লব’ বোলার। পরে আরও অনেক অস্ট্রেলিয়ানদের মতো তিনিও সফরকারী ইংলিশ বোলারদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রাউন্ড-আর্ম ও ওভার-আর্ম বোলিংয়ে। একটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে পারতেন দিনের পর দিন। বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই করেছিলেন। বোলিং নিয়ে শুরুতে জানলেন, তারপর আয়ত্তে আনতে অনুশীলন করলেন অসংখ্যবার।
ব্যাটসম্যানরা স্পফোর্থের চোখে মৃত্যুকে দেখতে পেতেন। আড়চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিতেন বটে, আবার তাকিয়েও দেখতেন সেই সাক্ষাত মৃত্যুকেই! থিয়েটারে বিদঘুটে আর ভয়ঙ্কর করে যে শয়তানকে সাজানো হয়, তিনি দেখতে ছিলেন তেমন। তবে তার কাজকারবার ছিল সত্যিকারের এক শয়তানের মতো।
দীর্ঘাকায় বাঁকানো নাকের ডগাটা ঠোঁটের ওপরে যেন ফণা তুলে আছে, জ্বলছে দপ দপ করে। গোঁফজোড়া রক্তের গন্ধে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে। রিচার্ড হজসন নামের এক পুরোহিত বলতেন, স্পফোর্থ যেন ঠিক জার্মান পৌরাণিক কাহিনী ‘ফস্ট’-এর সেই শয়তান। চুলের মাঝখানে সিঁথি, যেন দুইপাশে দুই শিং গজিয়েছে। হয়তো তার একটা লুকায়িত বিষদাঁত ছিল। হয়তো গায়ে জড়ানো ছিল অদৃশ্য আলখাল্লা।
স্পফোর্থ যত না ভয়ঙ্কর ছিলেন দেখতে, তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল তার বোলিং।
১০-১২ কদমের রান-আপটা অবশ্য সোজাসাপটা। তেঁড়েফুঁড়ে আসতেন না। ধীরলয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে আসতেন। ক্রিজে এসেই বদলে যেতো সব। অ্যাকশনটা ছিল দুর্ধর্ষ। হঠাৎ করেই যেন আগুনের গোলা ছুঁড়ে বসতেন শত্রুপক্ষের দিকে তাক করে। যেন চাচা চৌধুরির সাবু, তাও আবার রাগান্বিত অবস্থায়। সাবু রেগেছে, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটেছে বৃহস্পতিতে। স্পফোর্থ বল করতে এসেছেন, ব্যাটসম্যান ক্রিজেই পড়েছেন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে। অথবা তিনি যেন মাংশাসী বৃহদাকার প্রাণি। এদিক ওদিক থেকে বেড়িয়ে আছে শুঁড়। যে কোনও একটা থেকে বেরিয়ে আসবে বল, যে গতিতে এর আগে কোনও মানুষ বোলিং করেনি।
সেই শয়তানের ঝুলিতে অথবা আলখাল্লার ভেতরে লুকিয়ে ছিল ‘সোয়ার্ভ’। সুইং কথাটা তখনও আসেনি, বলের মুভমেন্ট বোঝাতে ছিল এই ‘সোয়ার্ভ’। সোজা বল সামলানোই দায়, আর আঁকাবাঁকা! স্পফোর্থ ব্যাংক কেরানি ছিলেন, পড়াশুনাও করতেন। বেসবল পিচিং নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন, ‘এরোডায়নামিকস’ বা ‘বায়ুগতিবিদ্যা’ নিয়েও জানাশোনার চেষ্টা করেছেন। ওভার-আর্ম বোলিংয়ের ধারণাই তখন নতুন, তার ওপর সুইং। সিডনি বার্নসরা পরে যে ‘মিডিয়াম পেসড স্পিন’ দিয়ে রাজত্ব করেছিলেন, সেটার পথ দেখিয়েছিলেন স্পফোর্থই। তিনি বলে বেড়াতেন, তার বল ভেতরে-বাইরে-ওপরে-নিচে সবদিকে সুইং করে। ব্যাটসম্যানরা ভাবতেন, নিশ্চয়ই জাদুটোনা করা হয়েছে নিরীহ বলটাকে। নাহলে এমন অদ্ভুতুড়ে আচরণের কোনও ব্যাখ্যা নেই।
পরে আবার স্লোয়ার আর দ্রুতগতির বল আয়ত্ত করেছিলেন। আকার-ইঙ্গিতে একই, কিন্তু একটা ধীরলয়ে আসে, আরেকটা আসে চোখের পলকে। যদি স্পফোর্থ বলতেন, তিনি শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে এসব শিখেছেন, ব্যাটসম্যানরা হয়তো সেটাই বিশ্বাস করতেন তখন!
২৭ মে ১৮৭৮ সালে লর্ডসের ভেজা উইকেটে সেই ‘শয়তান’ স্পফোর্থ হয়ে উঠেছিলেন দৈত্য। দানব।
প্রথম ওভারে দুই রান। সে ইনিংসে দিলেন আরও দুই। এর মাঝেই এমসিসি ২ উইকেটে ২৭ থেকে অল-আউট ৩৩ রানে। এমসিসির ব্যাটিং আত্মা খেয়ে নিল শয়তান। ৫.৩ ওভার, ৩ মেডেন, ৪ রান, ৬ উইকেট। শয়তানের বোলিং ফিগারটা সেই আত্মা খাদকের স্বীকৃতিপত্র।
অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিংয়ে অবশ্য লিড নিল শুধু ৮ রানের।
মাঠে শোরগোল উঠলো। গ্রেস সোজা করবেন শয়তানকে। গ্রেস ক্রিকেটের ঈশ্বর। অতুলনীয়, মহাশক্তিধর। তিনি ছিঁড়ে ফেলবেন স্পফোর্থকে, ধ্বংস করে দেবেন চিরতরে। এটা ঈশ্বরের খেলা, এটা ঈশ্বরের সম্পত্তি। এটা ক্রিকেট, এটা লর্ডস। এক ঔপনিবেশিক এসে অযাচিত যন্ত্রণা দেবে, সম্রাট সেটা মানবেন নাকি!
প্রথম বলে গ্রেস পরাস্ত। দ্বিতীয় বলে স্পফোর্থের চিৎকার, ‘বোল্ড’! এমসিসি হারলো এক দিনেই, নয় উইকেটে। শয়তানের অতল ঝুলিতে গেল ২০ উইকেটের ১০টি। একজন আঘাত পেয়ে মাঠের বাইরে । ক্রিকেটের পূণ্যভূমিতে হতচকিত হয়ে উঠলো শয়তানের গগনবিদারী চিৎকারে। ঈশ্বর প্রথমবার পরাস্ত হলেন শয়তানের কাছে।
গ্রেস নামের ঈশ্বর কিন্তু মোটেও দয়ালু ছিলেন না। বরং ছিলেন একগুঁয়ে, নাক-উঁচু, অহঙ্কারী, প্রবল প্রতাপশালী, আর ধুরন্ধর। সে সফরের মাঝপথে বিলি মিডউইনটার নামে এক ওপেনারকে ভাগিয়েও নিলেন! মিডউইন্টারের জন্ম ছিল বৃটেনে, গ্রেসের অনেক দলে তিনি আগেও খেলেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার সেবার খেলা মিডলসেক্সের সঙ্গে। চার্লস ব্যানারম্যানের সঙ্গে প্যাড-ট্যাড পরে প্রস্তুত মিডউইন্টার, গ্রেস তখন গিয়ে ১৫ মিনিটের কথ্য অত্যাচারে তাকে বাধ্য করলেন গ্লস্টারশায়ারের হয়ে খেলতে। গ্রেস চিৎকার করছিলেন, এমনকি অস্ট্রেলিয়ানরা পর্যন্ত তার ভাষায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! ‘মিডলসেক্সের সঙ্গে কচু করবে তোমরা’, ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে মিডউইন্টারকে বলছিলেন গ্রেস। তবে ঘুষের ব্যাপার-স্যাপারটা জোর করে নাকচ করেন না কেউই।
সফরের উদ্যোক্তা জন কনওয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার জোগাড়। হঠাৎ করেই তার ১২ জনের দল পরিণত হলো ১১ জনে। আরেকটা ক্যাবে তিনি গ্রেসদের ওভাল পর্যন্ত তাড়া করলেন, থ্রিলার সিনেমার দৃশ্যের মতো। সেখানে পৌঁছে গ্রেসের সঙ্গে একচোট তর্কও হয়ে গেল কনওয়ের, তবে ঈশ্বরকে বোঝাতে পারলেন না। মিডউইনটার থাকলেন চুপটি মেরেই। গ্রেসের গ্লস্টারশায়ার অবশ্য সে ম্যাচে সারের কাছে হারলো, আর অস্ট্রেলিয়া সহজেই হারিয়ে দিল মিডলসেক্সকে।
অস্ট্রেলিয়া সে সফরে বেশ কিছু সাফল্যই পেল। তবে হারলো সবচেয়ে মর্যাদার ম্যাচটিই, এমসিসির সঙ্গে। যে ম্যাচে দুই দলই চেয়েছিল জিততে। জয়ের উদ্দেশ্যটা অবশ্য ভিন্ন ছিল। একদল ঔপনিবেশিকদের উচিৎ শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। আরেকদল চেয়েছিল তাদের অধিপতিদের নামিয়ে আনতে। স্পফোর্থ বা বয়েল (যিনি ১৯ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন) যদি সেদিন খারাপ করতেন, সে সফরের আলাদা কোনও তাৎপর্য থাকতো না। শুধু দুই-চার পয়সা আয় হতো তাদের, সেই ৫০ পাউন্ড মূলধনে। কিন্তু যুদ্ধের দামামা ঠিকই বাজলো। তৈরী হলো এক লড়াইয়ের প্রস্তুতিকল্প।
সে লড়াইয়ে ইংল্যান্ড দলে পেল ঈশ্বরকে। অস্ট্রেলিয়ার দলে শয়তান।
তবে তখনও নিশ্চিত ছিল না, শুধু ক্রিকেট কেন, বিশ্বের যে কোনও খেলার ইতিহাসেরই অন্যতম এক তাৎপর্যপূর্ণ লড়াইয়ের জন্ম হতে যাচ্ছে বছর চারেক পর।
ঈশ্বরের ক্রিকেট, শয়তানের অ্যাশেজ : পর্ব ২
(জ্যারর্ড কিম্বার : টেস্ট ক্রিকেট, দ্য আন-অথোরাইজড বায়োগ্রাফি অবলম্বনে)
তথ্যসূত্রঃ
১। ইএসপিএন ক্রিকইনফো
২। অলআউট ক্রিকেট
৩। উইজডেন