• অ্যাশেজ ২০১৭-১৮
  • " />

     

    'আলি আলি কুক.. আলি কুক....'

    'আলি আলি কুক.. আলি কুক....'    

    স্টুয়ার্ট ব্রড যেন বড়দিনের একটা উপহার পেয়েছেন। বাচ্চাদের মতো করে লাফিয়ে উঠলেন, দুই হাত ওপরে তুলে। 

    এমনিতেই ব্রড এলবিডাব্লিউয়ের আবেদনের বদলে উদযাপন শুরু করে দেন, বা আবেদনই করেন উদযাপন করতে করতে। এখানে অবশ্য তিনি ব্যাটসম্যান, তাও আবার নন-স্ট্রাইক প্রান্তে। স্ট্রেইট ড্রাইভটা বোলার জ্যাকসন বার্ড যখন পা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন, ব্রড তখন ক্রিজ আগলে রাখতে ব্যস্ত। বল বার্ডের পায়ে আটকালো না, আম্পায়ারকে ছাড়িয়ে গেল। ব্রড বুঝে গেলেন, এ বলের ভাগ্যে চার ছাড়া কিছু নেই। ব্রড বুঝে গেলেন, তার উদযাপনের উপলক্ষ্যটা এসে গেছে। তিনি উপহারটা পেয়ে গেছেন। অ্যালেস্টার কুকের ক্যারিয়ারের পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরিটাই যেন ব্রডের উপহার। অস্ট্রেলিয়ানরা হাততালি দিতে ব্যস্ত, বার্মি-আর্মি আর ইংলিশ সমর্থকরা শুধু নন, উঠে দাঁড়িয়েছে গোটা এমসিজিই। স্টুয়ার্ট ব্রড সেই অভিনন্দন-স্রোতে একটা ঢেউ তুলেছিলেন শুধু।

    অ্যালেস্টার কুকের এমন ইনিংস আপনাকে দারুণ একটা অনুভূতি দেবে। স্টুয়ার্ট ব্রডকে যেমন দিয়েছে। 

    ****

    বার্মি আর্মিদের প্রথম দেখেছিলাম মিরপুরে। ২০১০ সালে, বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্টে। ইংল্যান্ডের পতাকায় বিভিন্ন কিছু লেখা, মূলত অঞ্চলের নাম, টিভিতে অবশ্য এসব দেখেছি আগেই। বিউগলে প্যাঁ-পোঁ চলে,আর চলে গান। বার্মি আর্মি ছাড়াও অনেক ইংলিশই দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, খেলা দেখতে। মূলত টেস্ট। 

    মিরপুরে শেষ ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্টের দ্বিতীয় দিন এমন একজনের দেখা পেয়েছিলাম। প্যারি হার্মিস্টন নামের ভদ্রলোক টেস্ট দেখেন ১৯৬৪ সাল থেকে। জিওফ বয়কটের প্রথম সেঞ্চুরি ছিল ওভালে, অ্যাশেজে। সেই ম্যাচটা মাঠে গিয়ে প্রথম দেখা টেস্ট ছিল হার্মিস্টনেরও। 

     

     

    মেলবোর্নে হার্মিস্টন আছেন কিনা, জানা নেই। থাকলে বার্মি-আর্মিদের বাইরে হলেও তাদের গানের সঙ্গে গলা মেলাতেই পারেন। ক্রিকেটারদের জন্য গান বানানো থাকে বার্মি-আর্মিদের। তাদের ওয়েবসাইটে এসব গানের কথা, সুরও দেয়া আছে। সিরিজ অনুযায়ী বদলায় এসব, বদলায় ঘটনাক্রম অনুযায়ী। এবার অ্যাশেজের অ্যালেস্টার কুকের জন্য আছে আলাদা একটা গান। 

    কেসি ও সানশাইন ব্যান্ডের বিখ্যাত ‘বেবি গিভ ইট আপ’ এর সুরে- 

    ইউ ফ্লিউ আউট টু ইন্ডিয়া
    হোয়েন ইয়োর কান্ট্রি নিডেড ইউ
    সেঞ্চুরি অন ডেব্যু, হোয়াট আ ফাইন্ড
    না না না না না না না না না
    আলি আলি কুক, আলি কুক, আলি আলি কুক
    না না না না না না না না না না না….

    এই আলির অর্থ আরবান ডিকশনারিতে লেখা আছে এমন, 'এক বিরল প্রজাতি। দারুণ ব্যক্তিত্ব, তবে বেশিরভাগ লোকের চোখেই তা এড়িয়ে যায়। খুব ভালভাবে খেয়াল করতে হয়। স্মার্ট, বুদ্ধিমান। চিন্তাভাবনার ধরনটা আলাদা, প্রগাঢ়। পৃথিবী সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনাগুলোও অদ্ভুত। যে বিষয়ে তার আসক্তি আছে,  তা অনেক গভীরভাবে শেখে। সে যতটুকু জানে বলে আপনার ধারণা, আদতে সে জানে তার চেয়েও বেশি। জীবনের কঠিন মুহুর্তে সে থামে না। একজন আলির কারিশমা থাকে। সে নিপাট ভদ্রলোকও বটে।'


    'ইউ আর আ লিজেন্ড, কুকি!' 

    ****
     

    অ্যালেস্টার কুক জানতেন, স্টাম্পের সামনে মৃত্যু ঘটেছে তার। মিচেল স্টার্কের ফুললেংথের বল বুঝে উঠতে পারেননি, মিস করে গেছেন। আম্পায়ার যখন মৃত্যু সংকেত দিচ্ছেন, কুক মাথা নীচু করে স্টাম্পের সামনে নিজের গার্ডটা পা দিয়ে আরেকবার আঁকছেন। অভ্যাসবশতই হয়তো। হাঁটা দিলেন, রিভিউ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে গার্ড পড়ে রইল সেভাবেই। পার্থে ইংল্যান্ড এসেছে ০-২ এ পিছিয়ে থেকে, চোখ রাঙাচ্ছে অ্যাশেজ খোয়ানোর হুমকি। 

    কুক আরেকবার ব্যর্থ দ্বিতীয় ইনিংসে। ফর্মে থাকা কুক বলটা সহজেই মিড-অনে খেলতে পারতেন, কিন্তু এই কুক সেটা শুধু বোলার হ্যাজলউডের দিকেই ঠেলে দিতে পারলেন। 'জীবনে কঠিন সময়ে সব কিছুই কঠিনতর'- এর নিয়ম মেনে হ্যাজলউড নীচু হয়ে নিলেন দারুণ এক ক্যাচ। ৬ ইনিংস মিলিয়ে কুকের রান ৮৩, শেষ ১০ ইনিংসে নেই ফিফটি। অদ্ভুত এক দুর্ভিক্ষ চলছে যেন, কুকের কাছে যা ছিল অপরিচিত। 

    ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান জানেন, নির্বাচকদের সমর্থন আছে। তবে কাজের কাজটা তো করতে হবে! দেখাতে হবে, তার দেওয়ার মতো বাকি আছে কিছু। সেই কিছুটা করতে হবে মেলবোর্নেই, নাহলে সিডনিতে হয়তো ওপেনিংয়ে তার জায়গা নামবেন আরেকজন। 

     

     

    মেলবোর্নের ফ্ল্যাট উইকেটে কমে এলো পেস। ‘টু-পেসড’ উইকেটে যা হয়। এই অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের জন্য যা ছিল নিয়মিত ঘটনা, সেই ব্যাটিং ধ্বস নেমে এলো অস্ট্রেলিয়ার ওপর। ইংল্যান্ডের ফিরে আসার সময়টা আসলে পার্থেই পেরিয়ে গেছে সিরিজের ফল হিসেবে। তবে দুইটি টেস্ট বাকি, যা নির্ধারণ করবে সামনের গতিপথ। আর বাকি কুকের কিছু করে দেখানোর। তিনি কেন চ্যাম্পিয়ন, তিনি কেন সুপারস্টার, তিনি কেন ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রানের মালিক, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার। 

    কুকের টাইমিং ছিল এমন...

    হ্যাজলউড প্রথম বলটা করলেন অফস্টাম্পের বেশ বাইরে। কুক প্রথম রান নিলেন তৃতীয় বলে গিয়ে, দ্বিতীয় বলে তার আউটসাইডেজ গিয়েছিল পয়েন্টে। টাইমিংটা ঠিক হয়নি তখনও, তিনি তখনও এ সিরিজে ৮৩ রান করা ধুঁকতে থাকা ওপেনার। জ্যাকসন বার্ডের পরের ওভারটা মেইডেন দিলেন। কুক খেললেন ৯ বল। এই সিরিজে ১৩ বল খেলে একবার আউট হয়েছেন, ১৬ বল খেলে একবার। সর্বনিম্ন ১০ বল, ব্রিসবেনে প্রথম ইনিংসে। মেলবোর্নে নিজের ১০ম বলে হ্যাজলউডকে ফ্লিকে চার লং লেগ দিয়ে। দারুণ টাইমিং। কুক ফিরে আসার একটা ইঙ্গিত দিলেন। হ্যাজলউডের শর্ট বলে এরপর পুল, এরকম শর্ট বলেই ব্রিসবেনে দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যাচ দিয়েছিলেন। সেই শঙ্কাটা কাটলো শুধু। 

    কামিন্সকে এরপর কাভার ড্রাইভ। স্ট্রাইড, মাথার পজিশন ঠিক জায়গায় রেখে কুক যখন এমন শট খেলেন, বুঝতে হয়, এটা অন্য কিছুর ইঙ্গিত। পরে এই কাভার দিয়েই ইনিংসের সবচেয়ে বেশি রান করলেন তিনি।

    স্ট্রেইট ড্রাইভটা খেললেন আরেকটু পর। কাভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ, সঙ্গে কাট। কুক খেলতে লাগলেন একের পর এক। স্টিভেন স্মিথ দুইটা শর্ট কাভার আনলেন। কুক কাভার দিয়ে বাউন্ডারি বের করলেন এরপরও। কুক শর্ট মিড-অন পিচঘেঁষে আনলেন। কুক তাকে ফাঁকি দিয়ে স্ট্রেইট ড্রাইভে চার মারলেন। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে নিরাপত্তা নিয়েও আটকানো গেল না কাটগুলো। 

    কুক থামলেন না। সংক্ষিপ্ত নোটিশে ক্যারিবীয় থেকে মুম্বাই হয়ে নাগপুর, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন অভিষেকের জন্য। করেছিলেন সেঞ্চুরি। আবুধাবির তপ্ত গরমে প্রায় ১৪ ঘন্টা ব্যাটিং করে তৃতীয় দীর্ঘতম ইনিংস খেলেছিলেন টেস্টের, তার ক্রিজে থাকার অভ্যাসটা নতুন নয়। প্রকৃতিগতভাবেই তিনি ঘামেন না বলতে গেলে, মেলবোর্নের ৩০-৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও তাই তিনি দৌড়ালেন অবলিলায়। নিলেন দুই, তিন। আগেরদিন স্মিথের শেষ ওভারে ডাবলস নিয়ে ৯৯-তে পৌঁছেছিলেন। চার মেরে করেছিলেন সেঞ্চুরি। রাতে এসে ভর করেছিল আবেগ। এই সেঞ্চুরিটা যে অনেক সাধনার ফল! 

    তবে আবেগ সরিয়ে রেখে খেললেন এদিনও। স্ট্রেইট ড্রাইভের চারেই করলেন ডাবল সেঞ্চুরি। শর্ট বলে কাবু হলেন না, ভেতরের দিকে ঢোকা ফুললেংথে ধোঁকা খেলেন না, লায়নের স্পিন তাকে হড়কাতে পারলো না। দিনের শেষ বলের আগের বলেও কাভার ড্রাইভে মারলেন চার। 

    ****

    দিনের খেলা শেষ। কুক অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে একাধিক ডাবল সেঞ্চুরি করা তৃতীয় সফরকারি ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন। মাহেলা জয়াবর্ধনে, শিবনারাইন চন্দরপল, ব্রায়ান লারাকে ছাড়িয়ে গেছেন টেস্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায়। সংবাদ সম্মেলনে তখনও ‘আসলে কী বলবো জানি না। মনে হয় ব্রায়ান লারার জন্য একটু খারাপই লাগছে!’ বলে হাসির রোল তোলেননি।

    শর্ট কাভারে দাঁড়ানো স্মিথ প্রথম গিয়ে হাত মেলালেন। মার্শ, ব্যানক্রফট, ওয়ার্নার, পেইন, হ্যাজলউড- সবাই এগিয়ে এলেন। কয়েকবার গ্লাভস খুলতে গিয়েও থামতে হলো, আরেকজন যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মেলানোর জন্য! বার্মি আর্মিদের দিকে আরেকবার ঘুরে ব্যাটটা দেখালেন। গ্যালারিতে তখন হয়তো সুর উঠেছে, ‘আলি আলি কুক, আলি কুক……’ 

    অথবা কুকের জন্য বানানো বার্মি আর্মিদের আরেকটা গান। 

    ইটস ইংল্যান্ডস নাম্বার ওয়ান
    অ্যালিস্টার কুক
    পুট ইয়োর ব্যাট ইন দ্য এয়ার, প্লে দ্য হুক হোয়েন ইউ ডেয়ার
    অ্যান্ড উই উইল কাম অ্যান্ড চিয়ার ইউ অন...।


    ইসিবি ক্রিকেটের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে যাওয়া হলো। স্টুয়ার্ট ব্রড ‘বুম’ হাতে সাংবাদিকের ভূমিকায়। কথা বলবেন কুক। ইনিংসটা কেমন, কী করলে ব্রডরা উইকেট নিতে পারবেন, সেটা জানা হলো। শেষে ব্রড বললেন, ‘কুকি, ইউ আর আ লিজেন্ড।’ কুক সেই চিরায়ত হাসি নিয়ে ধন্যবাদ দিলেন। ব্রড জানেন, কুকের এমন ডাবল সেঞ্চুরিতে তিনি বা বার্মি আর্মি না, লাফিয়ে ওঠে আরও অনেকেই। রিকি পন্টিং বা মাইকেল ভন, মাইকেল স্ল্যাটার বা মার্ক নিকোলাস শুধু না, খুশী হন আরও অনেকেই। 

    কুক নিজের ব্যাটিং দিয়ে খুশী করতে পারেন অনেককেই। প্রত্যাবর্তনের দারুণ গল্প লিখে কুক হয়তো ব্যর্থতার হতাশা ভুলে ক্রিকেট বা জীবনে মেতে ওঠার বার্তাটাও দিতে পারেন অনেককেই!