কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা
‘মিড-অন’স দিয়ার….শুড বি টেকেএএএন! ওহ হি’জ ড্রপড’ইম! হ্যাজ হি কস্ট’এম দ্য ম্যাচ? তামিম ইকবাল হ্যাজ ড্রপড ইট, অ্যান্ড বাংলাদেশ হেডস গো রাউন্ড অল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, দে গো ডাউন।’
তামিমের চোখমুখের অভিব্যক্তির অনুবাদ করতে চাইলে নাসের হুসেইনের ওই কমেন্ট্রিই পারবে। ম্যাচটা কি ‘হারিয়ে’ই দিলেন তামিম? তাসকিন আহমেদকে তখন যেন কিছু ছুঁয়ে যাচ্ছে না আর। আবেগহীন এক রোবট হয়ে গেছেন, কী একটা ভাবলেন, আবার বোলিং করতে ফিরে গেলেন।
ঠিক সেভাবে মারতে চাননি ক্রিস ওকস। লং-অনে তামিম, হাত ওপরে নিয়ে ‘অ-এশীয়’ ভঙ্গিতে নিতে গেলেন ক্যাচটা। মুঠোবন্দি হলো না। দ্বিতীয়বার চেষ্টায়ও হলো না কিছুই। সব আক্ষেপ থ্রো করে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন, তাতে কি আর হয়! হাত দিয়ে ক্যাপটা ঠিক করলেন। অনেক মাইল দূরে এক ড্রইং রুমে মাথাটা হেঁট হয়ে এলো কয়েকজনের।
ওহ, তামিম! ওহ তামিম! আর সময় পেলেন না আপনি!
ফোনে টেক্সট তামিমভক্তের, ‘আমি মনে হয় মরেই যাব।’
হুসেইন মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন কমেন্ট্রিতে, মরে যাওয়ার কথা বলেননি নিশ্চয়ই!
****
ঢাকার রাস্তা সেদিন একটু অন্যরকম। আয়োজন করে খেলা দেখা হবে এক স্যারের বাসায়। জনাকয়েক বন্ধু, লোকাল বাসের পেছনের সিট, ঘুম ঘুম চোখ জানালায়। পাশের কারও হাতে স্মার্টফোন- ইমরুল আউট। এক ওভার পরে তামিম আউট। রোমাঞ্চের অর্ধেক উড়ে গেল বাসের ধোঁয়ার সঙ্গে।
সকালের নাশতার আয়োজন। পরোটা-সবজি-ডিমে ভুলে থাকা হতাশা। ওয়ানডে ম্যাচটা তো আর হুট করে শেষ হয় না, সকালবেলা তাই কিসের আভাস দেয় বোঝা শক্ত। সৌম্য ফেরেন, ফেরেন সাকিবও। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে উড়ে মিলিয়ে যায়, ম্যাচে বাংলাদেশের গতিপথের মতো। আদতে কই চলেছে বাংলাদেশ?
মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ কিছু একটা সুর তোলেন। মজলিস জমে উঠতে চায়। মিসফিল্ডে সিঙ্গেল চুরি করে সেঞ্চুরিটা হয়, ওপ্রান্তে ডাইভ দেন মুশফিক। মুশফিকের উল্লাসটা ক্যামেরায় ধরা পড়ে, হাত তুলে চিৎকার করছেন। সেঞ্চুরিটা আদতে কার, মুশফিক ধন্দে ফেলে দেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি, যার মালিক মাহমুদউল্লাহ।
মাহমুদউল্লাহর মুখে হাসি। নিভৃতে থাকা এক ছেলে হঠাৎ ভাল রেজাল্ট করে বসেছে যেন। আরেকটা সিঙ্গেল চুরি করতে গিয়ে রান-আউট মাহমুদউল্লাহ। গোটা ইনিংসেই দারুণ টাইমিং করতে থাকা মুশফিক আউট মিসহিটে। বাংলাদেশ ২৭৫। শেষের দিকে চেপে ধরেছিল ইংল্যান্ড, কিন্তু স্কোরটা লড়াই করার মতো। লড়াই তো হবেই।
****
দুপুর। সূর্য উত্তাপের আভাস দেয় মার্চে- ঠিক ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থায় ফেলার মতো শক্তি হয়না তখনও তার। মইন আলি সেই কখন রান-আউট হয়েছেন বলে বোধ হয়। এওইন মরগান আর জেমস টেইলর ছাড়া কেউ তাড়াতাড়ি ফিরতে চাননা। তারা যেন নাছোড়বান্দা অতিথি, বাড়ির কর্তার অস্বস্তিটা বুঝতে চাইছেন না ঠিক।
অলস দুপুর, বুক ধুকপুকানিতেও চোখ জড়িয়ে আসতে চায়। রুটকেও ফেরান মাশরাফি। নড়েচড়ে বসা। জস বাটলার আর ক্রিস ওকস ভন্ডুল করে দেন সব। তারা খেলতেই থাকেন। খেলতেই থাকেন। খেলতেই থাকেন। না, মহাকাব্যিক জুটি না, টেস্ট ম্যাচে দিনের পর দিন ব্যাটিং করে যাওয়ার মতো ব্যাপার না। তবে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের বিদঘুটে রুপটা ভেসে ওঠে ফার্স্ট ইয়ারে মডার্ন ফিজিক্সের কোর্স পড়া ছাত্রদের কাছে। এ যেন অনন্তকাল! এর যেন শেষ নেই!
শেষ হয়। বাটলার দোনোমনো করেন তাসকিনের বলে। মুশফিকের কাছে ক্যাচ দেন। চারপাশ থেকে ভেসে আসা উল্লাসে এই ড্রইংরুমের উল্লাসটা হারিয়ে যায়। ক্রিস জর্ডানকে রান-আউট দেন থার্ড আম্পায়ার। উঁচুতে ছিল ব্যাট। আদতেই ছিল? হ্যাঁ, বাংলাদেশীদের কাছে জর্ডানের ব্যাটটা উঁচুতে ছিল। কে কী বলল- তা ভাবতে বয়েই গেছে! জর্ডান যান।
কিন্তু থেকে যান ওকস। ব্রড আসেন, ছয় মারেন। এর চেয়ে এসে কেউ যদি বুকে শেল মেরে যেত- এতোটা বিঁধত না বোধহয়! এদের জুটি ভাঙে না, মাত্র ২২ রানের সেই জুটি, কিন্তু অপেক্ষাটা যেন ২২ বছরের!
ওকস তার আগেই তামিমকে সুযোগটা দিয়েছিলেন। তামিম কি ম্যাচটা হারিয়েই দিলেন!
ওহ, তামিম!
****
এ যেন রোলার কোস্টারে চেপে বসা। তামিমের ক্যাচ মিস নিয়ে আক্ষেপটা টেকে না। আগের ওভারে ছয়ের শিকার হওয়া রুবেল এবার নিজেই শিকারি। ফুললেংথ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বল, ব্রডের ফ্লিক ফাঁকি দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এলইডি বেইলস আর স্টাম্প। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই এলইডি লাইটের অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছে ল্যাবে বসে বসে। সার্কিট-টার্কিট মিলিয়ে এলইডি যখন জ্বলার কথা- তখন মিচিক করে এলইডির আলোটা যদি দেখা দেয় - তখনকার অনুভূতিটা অন্যরকম। কিন্তু সেটা নস্যি, স্টাম্পের এই এলইডির কাছে। শুধু এলইডি জ্বলে ওঠে না, ইতিহাস জ্বলে ওঠে যে এতে!
রুবেল এক হাত তুলে উল্লাস করেন। তবে উল্লাসটা ঠিক চূড়ান্ত নয়। সাকিবের আলিঙ্গনে জমা পড়ার আগে মাশরাফির অভিনন্দন পান। তবে কাজ বাকি। আরও একটা উইকেট আছে, আর ওপাশে আছেন ওকস। খচখচানি নিয়ে।
নাসের হুসেইন কমেন্ট্রিতে রেসিপি দিয়ে যান। ব্যাটসম্যান, বোলার দুইজনকেই। ইয়র্কারটা ঠেকিয়ে দেন অ্যান্ডারসন। হুসেইন রুবেলকে বলছেন ওকসকে স্ট্রাইক না দিতে। আর অ্যান্ডারসনকে বলছেন ম্যাচটা শেষ ওভারে নিয়ে যেতে।
‘ডোন্ট গো ফর হিরো…’, নায়ক হতে না করেন অ্যান্ডারসনকে।
‘গোজ ফর হিরো… বোল্ড’ইম, ফুল অ্যান্ড স্ট্রেইট… দ্য বাংলাদেশ টাইগারস হ্যাভ নকড দ্য ইংলিশ লায়নস আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ। ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ডেইজ ইন বাংলাদেশ ক্রিকেট হিস্টোরি…’
নাসের হুসেইন ইতিহাসের ঘোষণা দিচ্ছেন। রুবেল উড়ছেন। অ্যাডিলেডের আকাশে উড়ছেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালের দিকে উড়াল দিয়েছে বাংলাদেশ।
আর এদিকে একজন শুয়ে পড়েছেন। তিনি অধিনায়ক, তিনি নুয়ে পড়লেন আবেগের ভারে। আনন্দের ভারে। বাংলাদেশ দল সেখানে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো একে একে।
সেদিন হারিয়ে যাওয়ার মানা ছিল না। মাশরাফিতে ভর করে হারিয়ে যাওয়া যেত। রুবেলে ভর করা যেত। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক-তাসকিনে ভর করা যেত। নাসের হুসেইনের কন্ঠে হারিয়ে যাওয়ার রসদ ছিল।
তামিমের ওপরও চাইলেই ভর করা যেতো সেদিন।
এরা সবাই মিলে অদ্ভুত এক রোলার-কোস্টার তৈরি করেছিলেন সেদিন।