• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    বিশ্বকাপ জেতার জন্য যা করতে হয়...

    বিশ্বকাপ জেতার জন্য যা করতে হয়...    

    বিশ্বকাপ জিততে হলে কী করতে হয়? গোপন ফর্মুলাটাই বা কী? মার্কো মাতারাজ্জিকে অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০৬ বিশ্বকাপে সেই ঢুঁশ তো ভুলে যাওয়ার নয়। তবে তার আগে নিজে পেনাল্টি দিয়েছিলেন, আবার গোলও করেছিলেন। বিশ্বকাপ জিততে কী করতে হয়, সেটা শোনাচ্ছেন সাবেক এই ইতালিয়ান ডিফেন্ডার


     

    একজন ফুটবলারের কাছে বিশ্বকাপ জেতার অনুভূতি সবসময়ই আলাদা। আমরা সবাই ছোট থেকে এই স্বপ্ন দেখি। সেটা যখন সত্যি সত্যি হয়ে যায় সেই অনুভূতিটা এতোটাই অবিশ্বাস্য, সারা জীবন আপনাকে তা আচ্ছন্ন করে রাখবে।

    বিশ্বকাপ জেতাটা সহজ নয় মোটেই। এখন পর্যন্ত মাত্র ৮টি দল তা করতে পেরেছে। আমি খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি সেই বিরলপ্রজদের মধ্যে আমার নামও আছে।

    অনেকেই আমার কাছে জানতে চায়, ২০০৬ সালে কীভাবে জিতেছিলাম আমরা? কারণ অনেকই ছিল, তবে একটা ছিল সবার চেয়ে বড়, আমরা একে অন্যের জন্য লড়েছিলাম, আমরা ছিলাম একটা সত্যিকারের দল। এই একতাটাই ছিল আমাদের গোপন ফর্মুলা।

    দলের সবাইকেই একতাবদ্ধ থাকতে হবে। কারও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের চেয়ে এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ফোকাসটা ঠিক রাখতে পারাও জরুরি, যেটা ২০০৬ সালে আমরা করতে পেরেছি। আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো, শুধু একদল ফুটবলারের চেয়েও বেশি কিছু। এটাও কিন্তু অনেক সাহায্য করেছিল।

    দুই বছর ধরে আমরা একসাথে খেলেছি। আমরা একে অন্যকে খুব ভালোভাবে জানতাম, সেটা অনুশীলনে হোক বা অনুশীলনের বাইরে। আমরা খুবই কাছাকাছি ছিলাম, সবার স্বপ্নই ছিল একই। আসলে তো এটা ছিল পুরো দেশের স্বপ্নই।

    আসলে এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করাটা খুব জরুরি সবাই যেন নিজেদের আপন মনে করি। এমনকি যারা দলের বাইরে থাকে তাদের জন্য আরও বেশি। ইতালি ২০০৬ বিশ্বকাপ জিতেছিল কারণ যারা খেলেছে আর যারা খেলেনি সবাই ছিল এককাট্টা। কখনোই কোনো সমস্যা হয়নি, ওই নীল জার্সিটার জন্য সবকিছু করতে সবাই প্রস্তত ছিল। আপনি তারকা কি না তাতে কিছু আসে যায় না। আর সবাই বলতে আমি আক্ষরিক অর্থেই সবাইকে বুঝিয়েছি।

    এই মানসিকতাই দলীয় সংহতিটা আরও শক্ত করতে সাহায্য করে। যেটা ২০০৬ সালের সেই কুখ্যাত ক্যালসিওপলি কেলেঙ্কারির (যে কেলেঙ্কারির জন্য জুভেন্টাস নেমে গিয়েছিল সিরি বি তে) সময় হয়েছিল। প্রচারমাধ্যম, এমনকি মানুষজনও চেয়েছিল যেন ফ্যাবিও ক্যানাভারোকে এজন্য বাদ দেওয়া হয়। ক্যানাভারো ছিল আমাদের অধিনায়ক, আর একজন অধিনায়ক সব প্রশ্নের উর্ধ্ব। আমরা তাই ওর পাশে ছিলাম, সম্মান করেছিলাম, এবং সেটা আমাদের আরও সংহত করেছে।

    পরিবারেরও একটা বড় ভূমিকা আছে এখানে। আমাদের স্ত্রী-বান্ধবীরা ছিল অন্য একটা হোটেলে, আমাদের পাশেই ছিল ওরা। ম্যাচের পর ওদের দেখার সুযোগ ছিল আমাদের। ওরা শপিং করেনি, অন্য সব ওয়াগদের মতো ছিল না। আমাদের শিশুসন্তানদের খেলার জন্য পার্কে নিয়ে আসত। মাঠের মতো মাঠের বাইরের এসব ব্যাপারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

    তবে বিশ্বকাপের আগে শারীরিকভাবে ভালো অবস্থায় থাকা একদম জরুরি। আপনাকে প্রতি চার দিনে একদিনে মাঠে নামতে হবে, সেজন্য আপনার অবস্থা থাকতে হবে একদম নিখুঁত। ম্যাচের পর সামান্য একটু ঘাম ঝরানোর ব্যাপার থাকে, এক দুইটা সেশন অনুশীলন করতে হতো। এর পরেই আবার মাঠে ফেরা। দম ফেলার সময়ই ছিল না আসলে।

    এতসবের মধ্যেও খানিকটা সময় আসলে বের হয়েই যায়। সেটা সবাই যে যার মতো কাটায়। আমি যেমন প্লেস্টেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সেটা একা নিজের রুমে হোক, বা অন্য কারও রুমে। ফ্রান্সের সাথে সেই ফাইনালের দিন, সাড়ে পাঁচটার দিকে তখন ম্যাচ শুরুর কয়েক ঘন্টা বাকি। আমি ফ্রান্সেসকো টট্টি ও ভিনসেনজো ইয়াকুইন্তার সাথে গেম খেলছিলাম।

    বিশ্বকাপে প্রতিটা ম্যাচ উদযাপনের সুযোগ আসলে সেভাবে থাকে না। কোয়ার্টার বা সেমিফাইনালের দিকে গিয়ে হয়তো একটু সুযোগ হয়। তবে প্রতি ম্যাচের পরেই আপনাকে পরেরটার কথা ভাবতে হয়। ডর্টমুন্ডের সেমিফাইনালে জার্মানিকে হারানোর পরেই আমাদের ভাবনায় ছিল ফ্রান্স। জিগীষা বোধ হয় এটাকেই বলে।

    আর ম্যানেজার তো আছেই। ওরকম একজনকে পাওয়াটাও জরুরি। আমাদের কোচ, মার্সেলো লিপ্পি ছিলেন ঠিক তেমন একজন। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, ম্যাচের ওপরও তা প্রভাব ফেলত। সেটা করার জন্য আপনার ব্যক্তিত্ব ও সাহসটা সেরমকম হতে পারে। তাহলেই খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আপনি সম্মান পাবেন।

    মানসিক দিক দিয়ে আমি পরামর্শ দেব কখনো হতোদ্যম না হওয়ার জন্য। ফ্রান্সের সঙ্গে ওই গোলটা তো ভোলা যাবে না কখনো, তার আগে আমি একটি পেনাল্টি দিয়েছিলাম। আমি এখনো সেই হতাশাটা টের পাই। শুধু আশা করেছিলাম, জিদান ওটা মিস করবে। তবে আমি ঠিক করি, হাল ছাড়া যাবে না। সেজন্য নিয়তি আমার জন্য একটা গোল লিখে রেখেছিল হয়তো।

    বিশ্বকাপের পর জিজি রিভার সঙ্গে কথা হচ্ছি। রিভা ইতালিয়ান ফুটবলের একজন কিংবদন্তি, ৪২ ম্যাচে ৩৫ গোল ছিল তাঁর। আমাকে বলেছিলেন, ‘মার্কো, তোমার ওই একটা গোলের জন্য আমি আমার ১০০ গোল দিতে রাজি আছি।’ আমি এর পরে বুঝলাম, আমার গোল কতটা মূল্যবান। আর এটা সম্ভব হয়েছে অসাধারণ একটা দলের জন্য। ইতালির ওই দুর্দান্ত দলের জন্যই ওই আসরটা ছিল।

    (গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত)