• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    শোকই যখন কুয়েন্তেরোর শক্তি

    শোকই যখন কুয়েন্তেরোর শক্তি    

    প্রসঙ্গটা সব সময় এড়িয়েই যেতে চান হুয়ান ফার্নান্দো কুয়েন্তেরো। মনে করিয়ে দিতেই বলেন, ‘দয়া করে এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না। এই ব্যাপারটা আমি মনে করতে চাই না।’ কিন্তু কী এমন হয়েছে, যার জন্য টাইমমেশিনে চড়ে অতীতের ওই সময়ে ফিরে যেতে চান না কলম্বিয়ার এই প্লেমেকার?

    কুয়েন্তেরোর নামটা এখন আপনার কাছে চেনা লাগতে পারে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটাই হতে পারত তাঁর। জাপানের সঙ্গে দারুণ ওই ফ্রিকিকে যে গোল করেছেন, সেটা এবারের আসরের মনে রাখার মতো গোলের একটি। কিন্তু দল হেরে যাওয়ায় খুব বেশি হইচই ফেলে দিতে পারেননি। কাল পোল্যান্ডের সঙ্গে গোল পাননি, তবে প্রথম দুইটি গোলের উৎস ছিলেন। হামেস রদ্রিগেজকেও কখনো তাঁর পাশে ম্লান মনে হয়েছে। দারুণ সব রক্ষণ এরা পাসে মধ্যমাঠের প্রাণভোমরা তো তিনিই ছিলেন!

     

    অথচ কুয়েন্তেরো এই ২৫ বছর বয়সেই জীবন নামের মুদ্রার দুই পিঠই দেখে ফেলেছেন। কলম্বিয়ার মেদেইনে এমন একটা সময়ে জন্ম, যখন মাফিয়া লর্ড পাবলো এসকোবারের ত্রাসের রাজত্ব সেখানে চলছে দোর্দন্ড প্রতাপে। আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই, প্রতিদিন নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষ। কলম্বিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মাফিয়াদের যুদ্ধটা তখন কুরুক্ষেত্রের মতোই তুঙ্গে। কুয়েন্তেরোর বাবা যোগ দিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীতে। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা সংঘর্ষের পর একদিন তিনি হারিয়ে গেলেন। আরও অনেকের মতোই আর কখনোই ফেরেননি।

    কুয়েন্তেরোর বয়স তখন মাত্র ২। বাবার সেই স্মৃতি তাঁর মনে নেই, তবে এরপর সারাজীবন খুঁজে চলেছেন তাঁকে। কুয়েন্তেরোর ফুফু এখন এমন একটা সংস্থার প্রধান, যারা ওই সময়ে নিখোঁজদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করে। ভাইকে খোঁজার কম চেষ্টা করেননি তাঁরা, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি তাতে।

    কুয়েন্তেরোর যুদ্ধটা অবশ্য থেমে থাকেনি। খুব অল্প বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল, ফুটবলই তার জীবনের ধ্রুবতারা। নয় বছর বয়সেই স্থানীয় একটা ক্লাবে অনূর্ধ্ব ১২ বছর বয়সীদের দলে সুযোগ পেয়ে যায়। সেখানের আবার কোচকে পরামর্শও দেয়, তাকে কীভাবে খেলানো দরকার। সবাই বুঝে গিয়েছিল, কলম্বিয়া সম্ভবত একজন নতুন রত্ন পেয়ে গেছে।

    এরপরের গল্পটা হতে পারত, এলাম দেখলাম আর জয় করলামের। সাফল্যের একের পর সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু কুয়েন্তেরোর পথটা এতো ফুলে ফুলে সাজানো ছিল না। কলম্বিয়ার অনূর্ধ্ব ১৭ দলে যখন সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায়, তখনই বাধা হয়ে দাঁড়াল নতুন একটা ব্যাপার। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির ফুটবলারকে যে দলেই নিতে চাইছিলেন না কর্তারা!

    তবে কুয়েন্তেরোকে শেষ পর্যন্ত নিতে বাধ্য হলেন তারা। সেই সিদ্ধান্ত যে একদমই অন্যায্য ছিল না, ২০১৩ সালে অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে তার প্রমাণ দিলেন। বলতে গেলে কলম্বিয়াকে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ফ্রিকিক থেকে করছিলেন দারুণ সব গোল। এল সালভাদরের সঙ্গে ২৫ গজ দূর থেকে করা গোলটা পরে টুর্নামেন্টের সেরা হয়েছিল। পরের বছরেই যোগ দেন পোর্তোতে, লিগ অভিষেকের এক মিনিটের মধ্যেই গোল করে আভাস দিলেন, এখানেও এসেছেন অনেক কিছু জয় করার জন্য।

    কিন্তু এবারও বাধা হয়ে দাঁড়াল তাঁর খেলার ধরন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে প্রেসিং তখন বড় একটা প্রভাবক, গতি এখানে নিয়ন্তা। কিন্তু কুয়েন্তেরোর খেলার ধরন যে লাতিন আমেরিকার সেই ক্লাসিক ১০ নম্বরের মতো। নিজে দৌড়াতে পারেন না তা নয়, তবে বলকেই বেশি দৌড়াতে পছন্দ করেন। রক্ষণ এলোমেলো করে দেওয় সব পাস দিতে পছন্দ করেন, চেষ্টা করেন ছড়ি ঘোরাতে। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে সেই সুযোগটাও পাচ্ছিলেন না খুব একটা।

    এরপর আবার শুরু সিড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার। পোর্তো থেকে ধারে খেলতে যান ফ্রান্সের লিগ ওয়ানে রেনেতে, কিন্তু সেখানেও পারলেন না থিতু হতে। গত বছর কলম্বিয়াতেই আবার ফিরে যেতে হয়, স্বদেশী ক্লাব ইন্দিপিয়েন্তে থেকে আবার ধারে আসেন আর্জেন্টিনার রিভার প্লেটে। এর মধ্যে মুটিয়েও গিয়েছিলেন কিছুটা, প্রশ্ন উঠেছিল অনেক। তবে বিশ্বকাপে তাঁর ওপর আস্থা রেখেছিল হোসে পেকেরম্যান।

    বিশ্বকাপে আলো ছড়িয়েছিলেন চার বছর আগেই। সেবার আইভরি কোস্টের সঙ্গে তাঁর গোলেই নিশ্চিত হয়েছিল কলম্বিয়ার। তবে শেষ পর্যন্ত হামেস রদ্রিগেজ কেড়ে নিয়েছিলেন সব আলো। এবার হামেসের সঙ্গে তিনিও আছেন পাদপ্রদীপে। এবার নিশ্চয় কুয়েন্তেরো আর থামতে চাইবে না। অনেক হোঁচট খেয়েছেন, এবার শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা।