• অ্যাশেজ
  • " />

     

    অ্যাশেজে এ কী রোমাঞ্চ!

    অ্যাশেজে এ কী রোমাঞ্চ!    

    সোফিয়া গার্ডেন, কার্ডিফ, ওয়েলস।

     

    অ্যাশেজের প্রথম টেস্টের প্রথম সেশনেই ধুঁকছে ইংল্যান্ড। ৪৩ রানেই নেই ৩ উইকেট। অনেক ভরসার প্রতীক জো রুট ক্রিজে, রানের খাতা খোলেননি তখনও। মিচেল স্টার্কের অফস্ট্যাম্পের বাইরে ফুল লেংথের বলটা ড্রাইভ করতে গেলেন। এজ হয়ে পেছনে ক্যাচ উঠলো। ব্র্যাড হ্যাডিন ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, গ্লাভস থেকে বেড়িয়ে গেল বলটা। জো রুটের ‘প্রাণ’টাও ফিরে এলো যেন। সেই ফিরে পাওয়া ‘প্রাণ’ দিয়েই যে অস্ট্রেলিয়ার ‘প্রাণ’টা সংহার করবেন এই ইয়র্কশায়ার ব্যাটসম্যান, তখন কে জানতো!

     

    ব্র্যাড হ্যাডিন কি জানতেন!

     

    ২০১৫ এর অ্যাশেজ যে ‘অদ্ভূতুড়ে’ কান্ডকারখানা নিয়ে হাজির হবে, তা-ই বা জানতো কে!

    *

    দুঃস্বপ্নের এক বিশ্বকাপ শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। প্রথম টেস্টে জ্যাসন হোল্ডারের বীরত্বে ড্র মানতে হলো, দ্বিতীয় টেস্ট জয়ে যেন স্বস্তির সুবাতাস বইলো কিছুটা। তৃতীয় টেস্টে সে সুবাতাস মিলিয়ে গেল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫ উইকেটে হেরে সিরিজ ড্র করলো ইংল্যান্ড। উইজডেন ট্রফিটা রয়ে গেল তাদের কাছেই, তবে বিষণ্ন মুখে যেন তা নিলেন অ্যালেস্টার কুক!

     

    বিশ্বকাপের পর অস্ট্রেলিয়াও গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। দুই টেস্টের সিরিজ জিতলো ৯ উইকেট ও ২৭৭ রানে ম্যাচ জিতে। অ্যাডাম ভোজেস ‘বুড়ো’ বয়সে ভেলকি দেখালেন, ইংল্যান্ডগামী অস্ট্রেলীয় দলের জায়গাটাও পাকাপোক্ত করলেন সঙ্গে সঙ্গে।

     

    *

    ইংলিশ ক্রিকেটের ‘ঝড়’টা তখনও থামেনি। পিটার মুরসের দ্বিতীয় মেয়াদের চাকরীটা বছরখানেকের বেশী টিকলো না। কেভিন পিটারসেনকে যেন ডেকে এনে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিল ইসিবি। পল ফারব্রেস দায়িত্ব নিলেন, কিউইদের সঙ্গে প্রথম টেস্টটাও দাপটের সঙ্গে জিতে নিল ইংল্যান্ড। জো রুটের স্বপ্নের ফর্ম চলতেই থাকলো। অ্যালেস্টার কুক দেখা পেলেন বহু প্রতীক্ষিত সেঞ্চুরির। বেন স্টোকসে ফ্রেডি ফ্লিনটফ খুঁজতে থাকা ইংল্যান্ড হেরে বসলো আবার পরের টেস্টেই!

     

    স্টিভ স্মিথের ব্যাটটাও চওড়া হয়েছে ওদিকে, আরও। ক্যারিবীয় সমুদ্র অবশ্য স্মিথকে এক রানের ‘আক্ষেপ’ উপহার দিল, ১৯৯-এ আউট হয়ে যে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবলটা মিস করলেন তিনি! রায়ান হ্যারিসেরও ফিরে আসার কথা ছিল অ্যাশেজ দিয়েই, হেলমেটে বল লেগে ‘কনকাশন’ এ ভোগা ওপেনার ক্রিস রজার্সেরও। কার্ডিফে রজার্স ফিরলেন, ফেরা হলো না হ্যারিসের। ক্রিকেটকেই যে বিদায় বলে দিলেন চোটের সঙ্গে লড়াই করতে থাকা এই পেসার!

     

    ‘নাটক’ এর তখন শুরু কেবল।

     

    *

    কার্ডিফের সকালে ৪৩ রানেই ৩ উইকেট হারানো ইংল্যান্ড যেন ফিরিয়ে আনছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হওয়ার স্মৃতিটাই। সেই একই দুর্দশা ফিরে আসছিল আবার। তারপরই হ্যাডিন সেই ক্যাচটা ফেললেন, জো রুট খেললেন সহজেই না ভোলার মতো এক ইনিংস। সঙ্গে ‘ব্যাটসম্যান’ মঈন আলীকে ‘স্পিনার’ হিসেবে খেলানোর টোটকাটাও কাজে লাগলো ইংল্যান্ডের। ‘ফেবারিট’ অস্ট্রেলিয়া হেরে বসলো চারদিনের মধ্যেই! অস্ট্রেলিয়ায় আগের অ্যাশেজে যিনি রীতিমত আগুন ঝড়িয়েছিলেন, সেই মিচেল জনসনই ‘ছায়া’ হয়ে রইলেন নিজের, অপেক্ষাকৃত ধীরগতির উইকেটে! ম্যাচে ১৮০ রান খরচায় নিলেন মাত্র দুটি উইকেট। ধীরগতির উইকেট বানাও, জনসনকে ‘কাবু’ করে রাখো- ইংল্যান্ডের মন্ত্রটা যেন সহজ!

     

     

    তবে হোম অব ক্রিকেটে এই মন্ত্রে কাজ হলো না। নিজেদের পাতা ফাঁদে যেন নিজেরাই ধরা দিল ইংলিশরা। লর্ডসের উইকেটটা হলো আরও ধীরগতির, টসে জিতে ব্যাটিংয়ের পুরো ফায়দা নিল অস্ট্রেলিয়া। নিজের শেষ সিরিজটা রাঙ্গিয়ে যাওয়ার মন্ত্রে রজার্স পেলেন সেঞ্চুরি। আর ক্যারিবীয় সমুদ্রের দুঃখটা যেন লন্ডনের বাতাসে মিলিয়ে দিলেন স্মিথ, পেয়ে গেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি!

     

    স্মিথ-রজার্সের প্রথম ইনিংসের জবাবটা ঠিক জুতসই করে দিতে পারলেন না কুক-স্টোকসরা। কার্ডিফের জয়ী দল লর্ডসে হেরে বসলো ওই চারদিনেই!

     

    অপেক্ষা তখন এজবাস্টনের। সেই ‘এপিক’ এজবাস্টনের!

     

    *

    প্রথম টেস্টের পর হ্যাডিন ‘পারিবারিক কারণ’ দেখিয়ে সরে গিয়েছিলেন। তবে ফিরে আসার পরেও এজবাস্টনে নামা হলো না তাঁর। আগের টেস্টে অভিষিক্ত পিটার নেভিলকেই রেখে দিল অস্ট্রেলিয়া। রায়ান হ্যারিস বিদায় বলেছিলেন সিরিজের আগেই, হ্যাডিনকেও কি বিদায় বলে দিল অস্ট্রেলিয়া?

     

    এজবাস্টন এলেই সেই ২০০৫ এর স্মৃতিটা ফিরে ফিরে আসে।

     

    তবে জিমি অ্যান্ডারসন ফিরিয়ে আনলেন তাঁর সেই চিরচেনা সুইং। ক্রিস রজার্স ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন এক প্রান্তে, অন্য প্রান্তে যাওয়ার আসার খেলায় মেতে উঠলেন আগের ম্যাচেই রানের পাহাড় গড়ার কারিগররা! ঝড়টা ফিরে আসছিল ইংল্যান্ডের দিকেও, সামাল দিলেন ইংল্যান্ডের সেই ‘বাড়তি’ অলরাউন্ডার- মঈন আলী। অসাধারণ কিছু শট খেললেও মঈনের ইনিংসটা ছিল ‘নড়বড়ে’, তবে তাঁর ৫৯ রানে ভর করেই গুরুত্বপূর্ন লিডটা পেয়ে গেল ইংল্যান্ড।

     

    অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের চিত্রনাট্যও প্রথমটার মতোই হচ্ছিল, এবার দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়ার্নার! আর অস্ট্রেলিয়াকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন স্টিভেন ফিন। তবে দাঁড়িয়ে গেলেন আরেকজন, পিটার নেভিল। মিচেল স্টার্ককে সঙ্গে নিয়ে দুইদিনের ভেতর অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় ‘ঠেকালেন’ তিনি। তবে অস্ট্রেলিয়া পারলো না, এজবাস্টন তাঁদেরকে এবার উপহার দিল তিনদিনেই পরাজয়!

     

     

    তিন নম্বরের গ্যারি ব্যালান্সকে বাদ দিয়ে ইয়ান বেলকে পাঠিয়েছিল ইংল্যান্ড, নেওয়া হয়েছিল জনি বেইরস্ট্রোকে। বেলও আস্থার প্রতিদান দিয়ে দুই ইনিংসেই ফিফটি করেছেন। 

     

    ২০০৫ এ এজবাস্টন টেস্ট শুরুর আগ দিয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিংয়ের প্রধান ভরসা। এবার ম্যাচের মাঝখানে চোট পেয়ে ছিটকে গেলেন প্রথম ইনিংসের নায়ক জিমি অ্যান্ডারসন। খেলতে পারবেন না পরের টেস্টে।


    ট্রেন্টব্রিজে কি তবে দেখা যাবে সেই এজবাস্টনের মতো কোনো নাটক!

     

    *

    চার, চার, তিন- অ্যাশেজের তিন টেস্টের রোমাঞ্চ শেষ এই কদিনের ভেতরই! ‘ফেবারিট’ অস্ট্রেলিয়াই এখন পিছিয়ে ২-১য়ে। বহুদিনের পরীক্ষিত সেনানী উইকেটকিপারকে বাদ দিতে হয়েছে তাদের। আর সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবার কথা যে অধিনায়কের, তিনিই যেন ভুলতে বসেছেন ব্যাটিং! ক্লার্ক নিজের ব্যাটিংয়ের দুর্দশা নিয়ে নিজেই বলেছেন, ‘আমরা যেন দশজনকে নিয়ে খেলছি এ সিরিজে!’

     

    ক্লার্কের ফর্ম কি ফিরবে? কুক কি পারবেন, ‘অধিনায়কোচিত’ এক ইনিংস খেলতে? জেমস অ্যান্ডারসনের জায়গায় কে আসবেন, লিয়াম প্লাঙ্কেট নাকি মার্ক ফুটিট? কেমন করবেন তিনি? দুই বছর পর টেস্ট খেলতে নেমেই ম্যাচসেরা হওয়া স্টিভেন ফিন কি ভেলকি দেখাবেন আরও? অস্ট্রেলিয়াই বা কাকে বাদ দিয়ে নেবে কাকে? গত সাত ম্যাচের জয়-পরাজয়-জ-প-জ-প-জ এর ধারাটা কি ভাঙবে ইংল্যান্ড?

     

    অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে ট্রেন্টব্রিজে।

     

    তিন টেস্টের পরতে পরতে হয়তো নাটক ছিল না, তবে এবারের অ্যাশেজই যেন এক নাটক! যার শুরুটা হয়েছিল ব্র্যাড হ্যাডিনের সেই ক্যাচ মিস দিয়ে।

     

    তখন কে জানতো!