• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    থিয়েরি অঁরি: ফ্রান্সের 'ঘরের শত্রু বিভীষণ'

    থিয়েরি অঁরি: ফ্রান্সের 'ঘরের শত্রু বিভীষণ'    

    ৪ জুন, ২০১৮। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নিজেদের ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত বেলজিয়াম দল। মাঝমাঠ থেকে পাস বাড়ালেন কেভিন ডি ব্রুইন। যাকে দিলেন; তার ঠিক পেছনেই আছেন থমাস মুনিয়ের, পাশে আরেক ডিফেন্ডার ইয়ান ভার্টনহেন। মুনিয়ের চার্জ করতে যাবেন, এমন সময় ডানপায়ের অবিশ্বাস্য এক টাচে তাকে নাটমেগ করলেন টেকো মাথার সেই 'ফুটবলার'। মুনিয়ের পেছনে তাকানোর আগেই জোরাল শটে পরাস্ত করলেন থিবো কর্তোয়াকে। মাঝমাঠ থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন ডি ব্রুইন। "ইয়েস তিতি!" চিৎকারটা বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই গোলদাতাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন সবাই। মুচকি হাসলেন তিনি। থিয়েরি 'তিতি' অঁরি, অবসরের বছর চারেক পরও যিনি হারাননি গোল করার স্বভাবসুলভ ক্ষুরধার ক্ষমতা।

    এককালের সেই দুর্ধর্ষ অঁরি এখন আর প্রতিপক্ষকে মাঠে ঘায়েল করেন না, করেন ডাগআউট থেকে। আগে করতেন পায়ের জাদুতে, এখন করেন নিজের ফুটবলীয় মস্তিষ্কের সাহায্যে। ব্রাজিল বধে ডি ব্রুইনের গোলটায় সবচেয়ে আবেগী উল্লাস ছিল তারই। অবশ্য অঁরির এই বুনো উদযাপনের দেখা মিলছে ২০১৬ থেকে প্রতিনিয়তই, যখন থেকে বেলজিয়ামের সহকারী কোচ হয়ে এসেছেন। কিন্তু আগামীকাল খুব সম্ভবত লুকাকুদের গোলেও এমন উদযাপনের দেখা মিলবে না তার। কারণ? বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যে মাতৃভূমি ফ্রান্সের মুখোমুখি হচ্ছেন অঁরি! সেই ফ্রান্স, যাদের হয়ে ১২৩ ম্যাচে করেছেন ৫১ গোল। সেই ফ্রান্স, যাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা এখনও তিনিই। সাক্ষী ছিলেন ফুটবলে ফ্রান্সের সেরা সময়ের, জিতেছেন বিশ্বকাপ এবং ইউরো। সব মিলিয়ে এক অম্লমধুর আবেগই অপেক্ষা করছে অঁরির জন্য।

     

     

    দেশের বিপক্ষে ম্যাচের আগে অঁরির মানসিক অবস্থা কীরকম- এ নিয়ে শেষ নেই জল্পনা-কল্পনার। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিছুই জানতে দেননি অর্ন্তর্মুখী অঁরি। সংবাদ সম্মেলনে আসার জোর আবেদনেও সাড়া দেননি একবারও। কোচ হয়ে আসার পরই বলেছিলেন, "আমাকে নিয়ে যেন মাতামাতি না হয়। কারণ বেলজিয়াম মানেই লুকাকু-ডি ব্রুইনরা, থিয়েরি অঁরি নয়। আর কোচ হয়ে আসা কেউ খেলোয়াড়ি জীবনে কী করেছে, তা  বড় কথা নয়। কোচ হিসেবে আমি এখনও নস্যি।"  গত ২ বছরে সংবাদমাধ্যমের সামনে এসেছেন মাত্র ১বার, তাও বেলজিয়ামের এক স্থানীয় সংবাদপত্রে। নিজেকে আড়ালে রাখার কাজটা করেছেন খুব ভালোমতোই। কিন্ত চাইলেও কি আড়ালে থাকা যায়??

     

     

    খাটে না। আরও ভাল করে বললে, খাটতে দেননি লুকাকুরাই। 'প্লেয়ারস ট্রিবিউন'-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অঁরির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন লুকাকু নিজেই, "ছোটবেলায় তার খেলা দেখার জন্য আমাদের বাসায় টিভি ছিল না। আর এখন আমরা তার থেকেই শিখছি। তিতি যেভাবে আমার ক্যারিয়ারে সাহায্য করেছেন, তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।" শুধু লুকাকু নন; বেলজিয়ামের অন্য দুই স্ট্রাইকার বাতশুয়াই, বেন্টেকেরাও নিজেদের রুমে অঁরির পোস্টার সাঁটাতেন। নিজের সহকারীকে নিয়ে যারপরনাই সন্তুষ্ট বেলজিয়ান কোচ রবার্তো মার্টিনেজ, “তিতিকে যেদিন প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল, সেদিন ছেলেদের অভিব্যক্তি দেখার মত ছিল। একজন সমর্থক নিজের প্রিয় খেলোয়াড়কে দেখে যেরকম সম্মোহিত হয়ে যায়, খানিকের জন্য ঠিক তেমনই হয়ে গিয়েছিল এডেনরা। ও (অঁরি) যেভাবে আমাকে সাহায্য করছে, তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। বিশেষ করে ফরোয়ার্ডের যেভাবে সে গড়ে তুলেছে, তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। নিজের এরকম কিংবদন্তীতুল্য সত্তার পরও সে একেবারেই মাটির মানুষ। কখনও লাইমলাইটে আসতে চায় না। পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে থেকেই সে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে যাচ্ছে।”

    কালকের ‘হাই-ভোল্টেজ’ ম্যাচের আগে শুধু বেলজিয়াম না, ফ্রান্সেরও স্মৃতিকাতর ভালবাসার ভেলায় ভাসছেন অঁরি। ব্রাজিলকে হারানোর পরদিনই বিখ্যাত ফরাসী সংবাদপত্র ‘লেকিপ’ অঁরির ছবি প্রচ্ছদে দিয়ে শিরোনাম দিয়েছিল “লে আমি রেভোঁয়া”; বঙ্গানুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, “বন্ধু! দেখা হচ্ছে আবার!!” অবশ্য যে মানুষটা এতকিছু দিয়ে গেছেন, তাকে কি আর এক ম্যাচের দোহাই দিয়ে ঘরের শত্রু বিভীষণে পরিণত করা যায়? হোক তা বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। যায় না। আরও ভাল করে বললে, হতে দিচ্ছেন না ফরাসীরাই।

    অঁরিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই লেফটব্যাক লুকাস হার্নান্দেজ মনে করিয়ে দিলেন, “তিতি আমাদের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার খেলা টিভিতে দেখেই আমরা বড় হয়েছি। আমাদের ইউরো এবং বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে অন্যতম অবদান তারই। তবে আমার মনে হয় আমরা জিতলেও খুশিই হবেন তিনি। হাজার হোক, ফ্রান্স তো তার মাতৃভূমি!” রসিকতা করলেন স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরু, “আগামীকাল আমরা অঁরিকে দেখিয়ে দেব যে তিনি ভুল দল বেছে নিয়েছিলেন (হাসি)। কালকের ম্যাচটা তার জন্য আসলেই কিছুটা অদ্ভুত। তবে সত্যি বললে আমাদের দলেই তাকে চাই আমি। ফ্রান্সে আমার খেলতে পারার পেছনে অন্যতম ভূমিকা তার। এটা কখনোই আমি ভুলব না।”

     

     

    ফ্রান্স বা বেলজিয়াম- দুই দল থেকেই সমান ভালবাসা, শ্রদ্ধায় সিক্ত হচ্ছেন অঁরি। আর হবেনই বা না কেন? ফ্রান্সের হয়ে কী করেছেন তা সবারই জানা, আর বেলজিয়ামের হয়েও কোচ হিসেবে নিজের সামর্থ্যের জানান দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সেটপিসে বেলজিয়ামের এমন দক্ষ হয়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা অঁরিরই- এমনটা কায়মনোবাক্যে মানেন কম্পানিরা। সেই সাথে ফরোয়ার্ডদের ‘পজিশনিং’, কেবল গোল নির্ভর না হয়ে খেলা গড়ার দিকে মনোযোগী হওয়া- এসব দিকেও লুকাকু-বাতশুয়াইদের সাহায্য করেছেন তিনি। লুকাকু নিজেই জানিয়েছেন, অবসর সময়েও দেখা হলে ফুটবল নিয়েই কথা হয় দুজনের। কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও লুকাকুর ম্যাচের ভিডিও এবং নিজের খেলার সময়ের ভিডিও তুলনা করে বেলজিয়ান ফরোয়ার্ডকে ‘পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার’ হওয়ার পথে সাহায্য করছেন অঁরি। লুকাকু নিজেই বলেছেন, 'মনে হয় থিয়েরিই একমাত্র মানুষ এই বিশ্বে, যে আমার চেয়ে বেশি ফুটবল দেখেছে। আমরা সবকিছু নিয়ে তর্ক করি।' 

    এসবের বাইরেও বেলজিয়ামের প্রায় প্রতি ট্রেনিংয়েই প্রত্যেক ফরোয়ার্ডকে আলাদা করে পরামর্শ দিতেও দেখা গেছে তাকে। ব্রাজিলের সাথে লুকাকুকে উইংয়ে খেলিয়ে ডি ব্রুইনকে ‘ফলস ৯’ খেলানোর ‘মাস্টারস্ট্রোক’টার পেছনেও হাত আছে বেলজিয়ামের কোচের।

     

     

    কর্তোয়া, কম্পানি, ডি ব্রুইন, লুকাকু, হ্যাজার্ডদের দিয়ে গড়া বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম। তারকার ছড়াছড়ি পুরো দলে। প্রত্যাশা পূরণ করে ৩২ বছর পর চলে এসেছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও। কিন্তু এতশত অর্জনের পরও প্রায় প্রতি সংবাদ সম্মেলনেই উঠে আসে একজনের নাম। “তার উপস্থিতি দলের জন্য কেমন?” “একজন কোচ হিসেবে তিনি কেমন?”- প্রতিনিয়তই এসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে আসা হ্যাজার্ডরাও ক্লান্ত বা বিরক্ত হন না আর। এরকম একজন কিংবদন্তীকে দলে পাওয়াই তো বড় ব্যাপার। 

     

     

    আগামীকাল বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে মাঠে নামবে ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম। হ্যাজার্ড-লুকাকু-ডি ব্রুইন বনাম গ্রিযমান-এম্বাপ্পে-পগবা। ভারান বনাম কম্পানি। লরিস বনাম কর্তোয়া। কিন্তু সব ছাপিয়ে ফুটবলবিশ্বের চোখটা থাকবে একজনের দিকেই। টেকো মাথার, চাপদাড়ির সেই ‘হিটম্যান’; যিনি একসময় মাঠ কাঁপাতেন কালকের প্রতিপক্ষের হয়ে। ফুটবল যাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক অদ্ভুত দোলাচলে। মাতৃভূমিকে হারানোর জন্য কাল ট্যাকটিক্সের ছক কষবেন থিয়েরি অঁরি। কিন্তু স্মৃতিপটে ভেসে আসবে নব্বইয়ের দশকের সব সুখস্মৃতি। ফিরে আসবে কাজানে ডি ব্রুইনের গোলের পর তার বুনো উল্লাসও। মাতৃভূমির বিদায় দেখে কি নিজের আবেগটা সামলাতে পারবেন অঁরি?