• ফুটবল

অন্য ক্রুয়েফ

পোস্টটি ১২৩৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

‘ফুটবল এক ধরনের আর্ট। ফুটবল স্কুলগুলো ডাচ আর্টিস্টদের সম্মিলিত শিল্পকর্ম’— ডাচ কোচেস অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে কথাটি। একটা তুলনাও টানা হয়েছে, ‘আমাদের কোচরা আধুনিক যুগের রেঁমব্রান্ট।’

বেশ অদ্ভুতুড়ে তুলনা। তাই না? ১৭ শতকে ডাচদের একটা সোনালি যুগ ছিল। রেঁমব্রান্ট তখন ডাচ ইতিহাসে তো বটেই, গোটা ইউরোপীয় চিত্রশিল্পেরই রাজপুত্তুর। কিন্তু চিত্রশিল্পের সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্ক কী? তাও আবার ‘আধুনিক রেঁমব্রান্ট’!

ডাচদের ফুটবল ইতিহাসে দুটি ভাগ আছে। ইয়োহান ক্রুয়েফ এ দুটি পর্বের সেতুবন্ধ। ক্রুয়েফ পূর্ববর্তী ডাচ ফুটবল ছিল একেবারেই সাদামাটা নির্ভেজাল। প্রাগৈতিহাসিকও বলতে পারেন। ’৭৪ বিশ্বকাপে রাইনাস মিশেলের সঙ্গে জুঁটি বাঁধলেন ক্রুয়েফ। ডাচ ফুটবল পেয়ে যায় নতুন দিশারীকে। মাঠে কারো কোনো পজিশন নেই! সবাই ডিফেন্ডার, সবাই মিডফিল্ডার, আবার সবাই স্ট্রাইকার! প্রতিপক্ষের পায়ে বল গেলে মাঠ ছোট করে ফেল। কিন্তু বল দখলে নেয়ার পর সেই মাঠকেই বড় বানাও— এসব কৌশলের সম্মিলনে যে চেহারা দাঁড়ায়, সেটাই ‘টোটাল ফুটবল’। ক্রুয়েফ ছিলেন তার কেন্দ্রবিন্দু। বিটলসে যেমন ছিলেন জন লেনন!

অতীত ও আধুনিকতাকে একসূত্রে গেঁথে নতুন কিছু উদ্ভবের রেওয়াজটা ডাচদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমন ধরুন টিউলিপের জন্ম তুরস্কে। কিন্তু ‘নেদারল্যান্ডস’ ভেবে অনেকেই ভুল করেন। ডাচদের হাতে টিউলিপের আরো কিছু শাখা-প্রশাখার সৃষ্টিই হয়তো এ ভুলের নেপথ্য কারণ। রটারডাম শহরে গাড়ির চেয়ে কালো রঙের সাইকেলের সংখ্যা বেশি। অথচ শুনলে অবাক হবেন, কালো রঙের ওই সাইকেলগুলো সর্বপ্রথম তৈরির দাবিদার ইংল্যান্ড। নারীদের জন্য বানানো হয়েছিল! ডাচরা মানিয়ে নিতে পারেনি। তাই ফুটবলের মতো সাইকেলেও ‘ইমপ্রোভাইজেশন’-এর আঁচড় পড়েছে।

এবার আসি, আর্জেন্টিনার গল্পে।

ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনা। কোনো মিল খুঁজে পেলেন কি? ফুটবলে লিগ প্রথা প্রচলনের আঁতুড়ঘর এ তিন দেশ। এর মধ্যে আর্জেন্টিনায় প্রচলন ঘটে সবার শেষে। উনিশ শতকের শেষের দিকে রেলপথ নির্মাণের জন্য আর্জেন্টিনায় পা রেখেছিল ব্রিটিশরা। তাদের হাত ধরেই আর্জেন্টিনার মাঠে গড়ায় লিগ। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এ দেনা শোধ করতে না পেরেই হয়তো ‘নাকের বদলে নরুন’ দেয়ার চেষ্টা— আর্জেন্টাইন ক্লাব ফুটবলে আজো কিছু ক্লাবের গা দিয়ে বিলেতি গন্ধ বেরোয়— নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ, রিভারপ্লেট, বোকা জুনিয়র্স। তবে বাঙালির পাত থেকে ইতিহাসের এ কচকচানি তুলে রাখাই ভালো। কারণ বাঙালি ফুটবলপ্রেমী আর্জেন্টিনাকে মন সঁপেছে দিয়েগো ম্যারাডোনার জাদুতে। লিগের ইতিহাসে নয়। ম্যারাডোনা, তার পর বাতিস্তুতা এবং পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকজন কথিত ‘নতুন ম্যারাডোনা’র হাত ঘুরে সে দায়িত্বটা এখন চেপেছে লিওনেল মেসির কাঁধে।

লাতিন ফুটবল মানেই ছোট ছোট ফুল! অর্থাত্ ছোট ছোট পাসের পসরা। বল-প্লেয়ারদের ঐন্দ্রজালিক স্কিল। তার মাধ্যমে গোলমুখ খোলার একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। এ তিনটি বৈশিষ্ট্য একসূত্রে গেঁথে আর্জেন্টাইন ফুটবল যেন একটা আস্ত সুগন্ধির কৌটা! একদা তা বহন করেছেন ম্যারাডোনা। এখন মেসি। কিন্তু এ পরম্পরার শুরু করেছিলেন কে?

মারিও আলবার্তো কেম্পেস।

আর্জেন্টিনা ওই একবারই বিশ্বকাপ আয়োজক। ১৯৭৮। ফাইনালে স্বাগতিকদের প্রতিপক্ষ ক্রুয়েফবিহীন নেদারল্যান্ডস। জোড়া গোল করে আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন কেম্পেস। আর্জেন্টাইন ফুটবলে ব্যক্তিপূজার শুরুটা কি তখন থেকেই?

গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কবি-সাহিত্যিকদের শহর সাও পাওলোয় যে লড়াইটা হলো, সেটা ছিল বিশ্বকাপ ডাচ-আর্জেন্টিনা ‘ক্ল্যাসিক’-এর পঞ্চম যুযুধান। সব মিলিয়ে নবম। এর মধ্যে আর্জেন্টিনার সবেধন নীলমণি জয় ওই এক ম্যাচ— ’৭৮ ফাইনাল। কিন্তু ৩৬ বছর আগে ‘আলবিসেলিস্তি’দের সেই জয়কে অনেকেই আখ্যা দেন ‘কলঙ্ক’! ভ্রূ আকাশে তোলার আগে একটা গল্প শুনুন—

১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনায় সামরিক ক্যু সংঘটিত হয়; যার হোতা ছিলেন হোর্হে রাফায়েল ভিদেলা। প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা মার্টিনেজকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক বাহিনীর এ ঊর্ধ্বতন কমান্ডার। দেশজুড়ে শুরু হয় রক্তগঙ্গা। মানবাধিকার লঙ্ঘন তখন আর্জেন্টিনায় ডাল-ভাত। টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েক দিন আগে খুন হন বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান ওমর অ্যাকটিস। সবার ধারণা, বিশ্বকাপ আয়োজনে স্বৈরশাসক সরকারের এন্তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ মাধ্যমে মুখ খুলতে চেয়েছিলেন ওমর। প্রাণ হারানোটা তারই খেসারত। অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে কিছু কিছু দেশ একসঙ্গে জোট বেঁধে টুর্নামেন্ট বয়কটেরও হুমকি দেয়। নেদারল্যান্ডস ছিল এ জোটের সর্বাগ্রে! শেষ পর্যন্ত তারাই উঠে যায় ফাইনালে!

’৭৮ ঘিরে বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে পেরুর বিপক্ষে কমপক্ষে ৪-০ গোলের জয় না পেলে আর্জেন্টিনার ফাইনালে ওঠা হতো না। কঠিন এ ম্যাচটাই তারা জিতে নেয় ৬-০ ব্যবধানে। বছরখানেক পর পেরুর এক সিনেটর জানান, তাদের দেশ থেকে কিছু রাজনৈতিক বন্দি গ্রহণ করতে রাজি ছিল আর্জেন্টিনা। এর মূল্য হিসেবে আর্জেন্টিনার দাবি ছিল, পেরুকে বড় ব্যবধানে হারতে হবে!

উইকিপিডিয়া বলছে, আর্জেন্টিনার তত্কালীন সামরিক শাসকের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধই ক্রুয়েফের ’৭৮ বিশ্বকাপ বর্জনের মূল কারণ। ভুল। ওই বিশ্বকাপের ৩০ বছর পর মুখ খোলেন ডাচ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ সন্তান। এক রেডিও ইন্টারভিউয়ে ক্রুয়েফ জানান তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা— ১৯৭৭ সাল। ক্রুয়েফ তখন বার্সেলোনার প্রাণভোমরা। পরিবার নিয়ে থাকতেনও বার্সেলোনায়। বাছাই পর্বে দুর্দান্ত খেলে ডাচদের তিনি তুলে দেন বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে। ২৬ অক্টোবর বেলজিয়ামের বিপক্ষে বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচটি খেলে ডাচরা। আগের আসরে ‘কমলা বিপ্লব’ ঘটিয়েও ডাচদের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিতে পারেননি ক্রুয়েফ। এবার তাই আশায় বুক বেঁধেছিল সবাই। কিন্তু প্রতিপক্ষ ডিফেন্সকে ছত্রখান করার মতোই ডাচদের হূদয় বিদীর্ণ করে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে ক্রুয়েফ অবসরের ঘোষণা দেন সেই অক্টোবরেই!

কেন?

সবাই ভেবেছিল ক্রুয়েফকে খেলতে বাধা দিয়েছেন তার স্ত্রী ড্যানি কস্টার। বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছিলেন, ডাচ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে স্পন্সর নিয়ে বনিবনা না হওয়াই ক্রুয়েফের ’৭৮ বিশ্বকাপ বর্জনের নেপথ্য কারণ। বিপ্লবপন্থীরা ধারণা করে নেন, বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আর্জেন্টিনায়, আর সেখানকার শাসক যেহেতু স্বৈরাচারী— মাঠ ও মাঠের বাইরে চিরকালই বিপ্লবী ক্রুয়েফ তাই আসরকেই ‘না’ বলে দেন। কিন্তু ভুল।

বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক মাস আগে অপহরণের শিকার হয় ক্রুয়েফের পরিবার!

এটাই তার ’৭৮ বিশ্বকাপে না খেলার আসল কারণ। বার্সেলোনায় এক রাতে বন্দুকধারীরা ক্রুয়েফের ঘরে ঢুকে তার স্ত্রী ও সন্তানদের জিম্মি করে চেয়ারে বেঁধে ফেলে। ক্রুয়েফকেও বেঁধে রেখে তার মাথায় ঠেকানো হয় পিস্তল। অপহরণকারীদের দাবি সম্পর্কে কখনোই মুখ খোলেননি ক্রুয়েফ। শুধু কাতালুনিয়া রেডিওকে দেয়া সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপ খেলতে হলে একজন ফুটবলারকে ২০০ ভাগ ফিট থাকতে হয়। কিন্তু সে সময় আমাকে বাকিদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়েছে। ওই ঘটনার পরবর্তী চার মাস আমার বাসা গিজগিজ করত নিরাপত্তারক্ষীতে। পুলিশ আমার বাসায় ঘুমাত। শিশুরা স্কুলে যেত পুলিশের বেষ্টনীতে। ম্যাচ খেলতে দেহরক্ষী নিয়ে যেতে হতো। এসব ব্যাপার আমার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। আমরা সবকিছু থেকে পরিত্রাণ চেয়েছি। আর তাই বিশ্বকাপ না খেলার সিদ্ধান্ত নিই।’

অনেকেই মনে করেন, ’৭৮ বিশ্বকাপে ক্রুয়েফ খেললে মারিও কেম্পেসের জায়গায় আসরটির ‘মহানায়ক’ হিসেবে খোদাই করা থাকত ক্রুয়েফের নাম। অনেকে আবার ভিন্নমত পোষণ করেন। ক্রুয়েফের বয়স তখন মাত্র ৩১ বছর। কী ঘটতে পারত, এ প্রশ্নটাই এখন অবান্তর। শুধু ডাচদের ‘ইমপ্রোভাইজেশন’ অর্থাত্ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটা একবার ভেবে দেখুন। ’৭৪ বিশ্বকাপ খেলেই ক্রুয়েফ এখন ফিফার বিচারে পেলে, ম্যারাডোনার পর সর্বকালের সেরা তিন খেলোয়াড়ের একজন। পরের আসরটিতে খেললে ‘সর্বকালের সেরাদে’র তালিকায় কি ওলট-পালট ঘটত! বিতর্কটা তুলে রাখাই ভালো।

পরিবারকে একদণ্ড শান্তি দিতে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার আর কিংবদন্তিকুলের চূড়ামণি ছোঁয়ার সুযোগ বিসর্জন দিতে পারেন যিনি, তিনি তো এমনিতেই মহানায়ক!