নব প্রজন্মের জন্ম দিয়েছিল যে ম্যাচ
পোস্টটি ১৯৫৩২ বার পঠিত হয়েছে১৭ মার্চ, ২০০৭। সময় সন্ধ্যা ৭ টা।
রাজধানীর পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালের বেডে শুয়ে তখন কান্না করছিলাম আমি। কান্নার কারণ দুটো। এক, বোধ শক্তি হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মত ডাক্তারের ছুরির নিচে যেতে হবে আমাকে আর একটু পরেই। আর দুই, চলমান বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচটাই আমার মিস করতে হবে এই অপারেশনের জন্য। অপারেশন থিয়েটারে যখন নেয়া হচ্ছিল আমাকে, খেলা শুরুর তখনো প্রায় ঘণ্টা খানেকের মত বাকি। তখনো জানতাম না আমি, পরের দিন সকালেই এই কান্না পরিণত হবে আনন্দের হাসিতে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোন জয় যদি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির ফাইনাল জয়। ওই জয় না এলে আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস আসে না, ওই জয় না এলে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এই অবস্থায় আসে না। কিন্তু এরপরে? এরপরে কোন জয়টা বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে? ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই জয়। আর কেউ একমত হবেন কিনা জানিনা, অন্তত আমি এমনটাই বিশ্বাস করি।
আকরাম-আমিনুল-হাবিবুলরা এদেশের ক্রিকেটের প্রথম সেনসেশন, এদের হাত ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেট হাঁটতে শিখেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অমিত সম্ভাবনার চারাটা প্রথম পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলেন এরাই। কিন্তু সেই চারা থেকে ফুল হয়ে ফুটে সৌরভ ছড়ানোর কাজটা করেছেন আজকের সাকিব-তামিম-মুশফিকরা। শুরুটা করেছিলেন মো: আশরাফুল, কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে ক্রিকেটকে ক্রেজ হিসেবে তৈরি করার কাজটা করেছে এই প্রজন্মটি। এদের দেখেই হাজার হাজার কিশোর আজ বিশ্বমঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখে। আর সোনালী এই প্রজন্মটির জন্ম দিয়েছিল অনেক পাওয়ার সেই ম্যাচ, ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো ম্যাচ।
চোখ বন্ধ করে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয় ছয়গুলোর কথা একবার ভাবুন। প্রথমে অবশ্যই আসবে ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির ফাইনালে শেষ ওভারে খালেদ মাসুদ পাইলটের সেই ঐতিহাসিক ছক্কা। এরপরেই কি আসছে না জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে লং অনের উপর দিয়ে মারা তামিম ইকবালের সেই ছক্কাটা? আসতেই হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে ভয়ডরহীন ক্রিকেটের ব্র্যান্ড চালু করে দিয়েছিল যে তামিমের ওই শটটা! বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান ইংলিশ কন্ডিশনে ইংলিশ পেসারদের চোখে চোখ রেখে বল নামের চর্মগোলককে বেঘোরে পিটিয়ে অনার্স বোর্ডে নাম লেখাতে পারেন, সেটাও বিশ্বাস করিয়েছেন এই নির্ভীক তামিম ইকবাল। তর্কযোগ্যভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানটির জন্মলগ্ন ঘোষিত হয়েছিল বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচেই।
বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড় কোন খেলায় বিশ্বসেরা হবেন, সাকিব আল হাসান আসার আগে কেউ কি সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পেরেছিলেন? সাকিব সেই কল্পনা বাস্তবে পরিণত করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারকে নিজের দলে পেতে কাড়াকাড়ি করছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা, এটাও প্রথম দেখা গেছে সাকিব আল হাসানের সৌজন্যে। বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারের নাম উচ্চারিত হচ্ছে সর্বকালের সেরাদের সাথে, সেটাও প্রথম সাকিবের সৌজন্যেই। এই সাকিব আল হাসানের বিশ্বমঞ্চে প্রথম নিজের উপস্থিতি জানান দেয়াও সেই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেই।
বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সলিড টেকনিকের অধিকারী, এমন ব্যাটসম্যানের তালিকা করতে বসলে মুশফিকুর রহিমের নামটা একেবারে উপরের দিকেই আসবে। বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানকে উইকেটে দেখলে নির্ভরতা পাওয়া যায়, এমন ব্যাটসম্যানের তালিকা করতে গেলেও মুশফিকের নাম বাদ দেয়ার কোন উপায় নেই। খালেদ মাসুদের বদলে সুযোগ পাওয়া 'মি: ডিপেন্ডেবল' মুশফিকেরও বড় মঞ্চে প্রথম অস্তিত্ব আবিষ্কার ওই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেই।
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নাক উঁচু ব্রিটিশদের কাছে প্রথম গ্রহণযোগ্য স্থান করে দিয়েছেন এই সাকিব-তামিম-মুশফিকেরা। এদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই আজ বিশ্ব দরবারে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখছেন সাব্বির-মোসাদ্দেকদের মত তরুণেরা। এই এক সোনালী প্রজন্ম জন্ম দেবে আরও অসংখ্য সোনালী প্রজন্মের। এই প্রজন্মের হাত ধরেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে, প্রথমবারের মত ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের ছয়ে উঠে এসেছে। কে জানে, হয়তো এই প্রজন্মের হাত ধরেই একদিন আসবে পরম আরাধ্য সেই বিশ্বকাপ, হয়তো আসবে র্যাঙ্কিং এর শীর্ষস্থানও।
আজ যে বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা ৬ দলের একটি, অংশ নিচ্ছে 'মিনি বিশ্বকাপ' খ্যাত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে, তার পেছনে এই সোনালী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অবদান কতটা, তা না বলে দিলেও চলে। এরাই দলের মধ্যে জয়ের বিশ্বাসের বীজ পুঁতে দিয়েছেন, বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন আমরাও জিততে পারি। এরাই হাসান, এরাই কাঁদান, আবার এরাই স্বপ্ন দেখান। নিজেরা স্বপ্ন দেখেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের মনে স্বপ্ন এঁকে দেন। এই সোনালী প্রজন্মের টুকরো টুকরো সাফল্য জোড়া লাগিয়েই আজ বড় সাফল্য এনে দিচ্ছেন মুস্তাফিজ-মিরাজের মত তরুণেরা। সাফল্য অর্জনের জন্য সক্ষমতার আগেও যেটা প্রয়োজন, সেটা হল বিশ্বাস। নিজেদের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস। ঠিক এই কাজটাই করেছেন সাকিব-তামিম-মুশফিকেরা। নিজেরা বিশ্বাস করেছেন, টিমমেটদের বিশ্বাস করিয়েছেন, দেশবাসীকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন। এদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটা এখানেই।
বাংলাদেশের কোন জয়ই ভুলে যাওয়ার মত নয়, সব জয়ই আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকবে। কিন্তু যেই প্রজন্মটি আমাদের অসংখ্য বার গর্বিত করে চলেছে, সেই প্রজন্মের জন্মগাঁথা লেখার জন্য ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচটা আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না। শুধু আমি কেন, কোন বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীই কি পারবেন ভুলে যেতে? পারার কথা না। আজকের সাকিব-তামিম-মুশফিকদের উত্থান যে ওই ম্যাচ দিয়েই!
- 0 মন্তব্য