সর্বকালের সেরা ফুটবল দলটির গল্প
পোস্টটি ২২৫৬৬ বার পঠিত হয়েছেসর্বকালের সেরা ফুটবল দল কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হবে। ২০০৬ এর পর ফুটবল দেখা শুরু করা কাউকে এই প্রশ্ন করলে সে হয়তো ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরোজয়ী স্পেনকে বেছে নিবে। আবার কোনো বার্সা সমর্থককে জিজ্ঞাসা করলে সে হয়তো পেপ গার্দিওলার হেক্সাজয়ী বার্সাকে বেছে নিবে। ফুটবলের পুরানো ইতিহাসের ব্যাপারে ভালো ধারণা আছে এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করলে সে হয়তো ১৯৫৪ বিশ্বকাপের হাঙ্গেরিকে বেছে নিবে। আবার সুন্দর ফুটবলের পূজারিকে জিজ্ঞাসা করলে সে হয়ত ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিলকে বেছে নিবে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষক কিন্তু সর্বকালের সেরা দল হিসেবে ১৯৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিলকেই বেছে নেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত ভালো ভালো দল বাদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা কেনো '৭০ এর ব্রাজিলকে বেছে নেন? '৭০ এর ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ের ৪৭ বছর পূর্তিতে সেটা নিয়েই আজ আলোচনা করা হলো।
এবার আসি '৭০ এর ব্রাজিলের প্লেয়িং স্টাইলের ব্যাপারে, '৭০ এর ব্রাজিলের খেলায় 'বিউটিফুল ফুটবল' ধরে রাখার প্রত্যয় সবসময়ই ছিল। ফলনির্ভর ফুটবল না খেলে দর্শকদের মনে আনন্দের যোগান দেওয়ার ব্যাপারটা সেই ব্রাজিল সবসময়ই মাথায় রাখত। আর এটা করতে তাদের সাহায্য করেছিলো প্লেয়ারদের পজিশনের ফ্লুয়েডিটি। আগেই বলেছিলাম সেই ব্রাজিলের প্লেয়াররা নিজেদের মধ্যে প্রচুর পজিশন সোয়াপ করতো, এই হয়তো পেলেকে স্ট্রাইকার হিসেবে দেখা গেলো এই হয়তো মিডফিল্ডে, তোস্তাওকে কিছুক্ষণ পেনাল্টি বক্সে দেখা যায় তো কিছুক্ষণ লেফট উইং এ ,রিভেলিনো কখনো উইঙ্গার কখনো প্লেমেকার আর দলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো রাইটব্যাক নাকি রাইট উইঙ্গার এটা তার খেলা দেখে ঠাওর করা বেশ মুশকিল ছিল। আর রাইট উইঙ্গার জায়ারজিনহো সুযোগ পেলেই কাটইন করে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে যেতো। একেতো প্লেয়ারদের ভার্সেটাইল পজিশন তারউপর তাদের ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স - সবমিলিয়ে এই ব্রাজিল দলটাকে এমন দুর্দান্ত করেছিলো ওই বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে এই দল হারতে পারে এটা কখনোই মনে হয় নি। ডিফেন্ডিং এ এই দলটা অতটা শক্তিশালী ছিল না কিন্তু যেই দলের অ্যাটাকিং লাইনআপ এতটা শক্তিশালি তারা ১-২ টা গোল খেলেও যে কোনো ক্ষতি নেই তা বলাই বাহুল্য। দলের অন্যতম বড় শক্তি ছিল ভার্সেটাইল রুপে পেলের আবির্ভাব। আগের আসরগুলোতে পেলে ট্রেডিশনাল স্ট্রাইকারের রোল প্লে করলেও এই বিশ্বকাপে নিজের স্ট্রাইকিং এবিলিটির সাথে প্লেমেকিং সেন্স দিয়ে দলের গেম বিল্ডাপে বড় ভূমিকা রাখেন আর এভাবে দুইটা ভিন্ন বিশ্বকাপে ভিন্ন অবতারে সফল হয়ে পেলে নিজেকে নিয়ে যান সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের উচ্চতায়। পেলের সাথে জায়ারজিনহো রিভেলিনোদের ড্রিবলিং পাওয়ার সাথে তোস্তাওর চতুরতা সবমিলিয়ে ব্রাজিলের অ্যাটাকিং লাইনআপের কেমিস্ট্রি অন্যপর্যায়ে চলে গিয়েছিলো।
ছয়টা ম্যাচের মধ্যে দুইটা ম্যাচে ব্রাজিল গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়েছিলো একটা চেকস্লোভাকিয়ার কাছে গ্রুপর্বের প্রথম ম্যাচে আরেকটা সেমিফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে। বলা বাহুল্য ব্রাজিলের বিপক্ষে এগিয়ে যাওয়ার পর দুই দলই ডিফেন্সে শক্তি বাড়িয়ে লিড ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সেই ব্রাজিলের অ্যাটাকিং ফায়ারপাওয়ারের শক্তি এতটাই বেশী ছিল যে ওই বাঁধার দেয়াল ধোপে টিকে নি। চেকস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে তো প্রথমে গোল খেয়ে পরে এক হালি গোল দিয়েছিলো!!! আর সেমিফাইনালের মতো হাই প্রেশার ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে প্রথমে গোল খেয়ে পরে তিনটা গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে ব্রাজিল। অর্থাৎ ওই ব্রাজিল গোল হজম করলেও তাতে সমস্যা হয় নি অ্যাটাকিং ফোর্সের কারণে। ওই বিশ্বকাপে ব্রাজিল ১৯ গোল করার বিপরীতে খেয়েছিলো ৭ গোল!!!! অর্থাৎ ব্রাজিল প্রতিম্যাচে গড়ে ৩+ গোল করেছিলো। একনজরে ওই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রতিটি ম্যাচের ফলাফল
গ্রুপ পর্ব
ব্রাজিল ৪-১ চেকস্লোভাকিয়া
ব্রাজিল ১-০ ইংল্যান্ড
ব্রাজিল ৩-২ রোমানিয়া
কোয়ার্টার ফাইনাল
ব্রাজিল ৪-২ পেরু
সেমিফাইনাল
ব্রাজিল ৩-১ উরুগুয়ে
ফাইনাল
ব্রাজিল ৪-১ ইতালি
এরমধ্যে দুইটা ম্যাচের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। প্রথমটি ইংল্যান্ড বনাম ব্রাজিলের ম্যাচটি। এর আগের আসরের শিরোপা ইংল্যান্ডই জিতেছিলো আর ওই আসরে ইংল্যান্ডের দলটাকে '৬৬ এর দলের চেয়েও বেশি ব্যালান্সড লাগছিলো। কিন্তু শুরু থেকেই ব্রাজিলের লাগাতার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ববি মুরের মতো সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার দলে থাকলেও সেই ডিফেন্স বারবার খেই হারাচ্ছিলো ব্রাজিলের কাছে কিন্তু ব্রাজিলের সব আক্রমণ একাই আটকে দিচ্ছিলো সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার গর্ডন বাঙ্কস, এরমধ্যে পেলের একটি হেডার অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকিয়ে দেন বাঙ্কস যেই সেভটিকে "সেভ অফ দ্য সেঞ্চুরি" বলা হয়। শেষপর্যন্ত ৫৯ মিনিটে ডেডলক ভাঙ্গতে পারে ব্রাজিল আর সেই ডেডলক ভাঙ্গার আক্রমণটা ছিল পিউর ম্যাজিকাল। তোস্তাও প্রথমে তিন তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে স্পেস তৈরি করে বলটি পেলের দিকে বাড়িয়ে দেন আর পেলে অসাধারণভাবে বলটা রিসিভ করে টার্নব্যাক করে বাড়িয়ে দেন জায়ারজিনহোর দিকে। জায়ারজিনহোর বুলেট শট একদম টপ অফ দ্য নেটে হিট করে। এই গোলের মাধ্যমে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হয়ে যায় আর তা হলো প্রতিপক্ষ যতই ডিফেন্স জমাট করুক, ব্রাজিলের ম্যাজিকাল অ্যাটাক সেই ডিফেন্স ভাঙ্গতে যথেষ্ট।
ব্রাজিলের ধ্রুপদী ফুটবলের চূড়ান্ত সুন্দর রূপ দেখা যায় ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে। ওই ম্যাচটি ছিল ফলনির্ভর ফুটবলের বিপক্ষে শৈল্পিক ফুটবলের লড়াই। একদিকে ইতালির ক্যাতেনেচ্চিও আরেকদিকে ব্রাজিলের জোগো বোনিতা, সবকিছু মিলিয়ে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ একটা ম্যাচের আশাতেই ছিল সবাই। কিন্তু সবার আশায় জল ঢেলে ম্যাচটি একপেশে হয়ে যায় ব্রাজিল নান্দনিক ফুটবলের চূড়ান্ত রূপ দেখালে। ফাইনালের ১৮ মিনিটে নিজের চেয়ে লম্বায় বেশ উঁচু ডিফান্ডারকে এরিয়ালে বিট করে হেডে গোল দিয়ে দলকে এগিয়ে নেন পেলে। এই গোলের পর ইতালি কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়্বে কারণ ইতালি সেদিন শুধুমাত্র ডিফেন্ডিং করবে এমন ট্যাকটিসেই নেমেছিলো। গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ায় আক্রমণে উঠতে বাধ্য হয় ইতালি কিন্তু ব্রাজিলের অ্যাটাকিং ফোর্সকে সামলানোর জন্য অতটা ডেস্পারেটলি আক্রমণে উঠতেও পারছিলো না ইতালি। অবশেষে তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে ক্লডোয়াল্ডোর একটা সিলি ব্যাকপাস, সেই ব্যাকপাস থেকে বল পেয়ে ৩৭ মিনিটে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান বনিনসেঙ্গা। অপ্রত্যাশিত গোল পেয়ে ইতালি পুরোপুরি ডিফেন্সিভ মুডে চলে যায়, ব্রাজিলের প্লেয়ারদের বলের জন্য প্রেস না করে ইতালির সব প্লেয়ার নিজেদের ডি বক্সে ডিফেন্ড করার জন্য বসে থাকে। একারণে ব্রাজিলের মিডফিল্ডাররা প্রচুর স্পেস পেয়ে যায় আর সেই স্পেস কাজে লাগিয়ে ৬৬ মিনিটে কিছুটা বামদিকে বাঁক নিয়ে ফার কর্ণারে বল জালে জড়ান জারসন। এই গোল খাওয়ার পর ইতালি পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে পড়ে। ৭১ মিনিটে ইতালির বিপদ আরেকটু বাড়িয়ে দেন জারসন, তার লং ফ্রি কিকে হেড করে আনমার্কড জায়ারজিনহোকে পাস দেন পেলে আর সেই পাস থেকে ইজি ট্যাপ ইন করে ব্রাজিলের তৃতীয় বিশ্বশিরোপা মোটামুটি নিশ্চিত করে ফেলে জায়ারজিনহো। তবে তখনো একটা ব্যাপার বাকি আছে আর সেটা হলো কেনো এই দলকে সর্বকালের সেরা দল বলা হয় তা পুরোপুরি প্রমাণ করা। সেটা প্রমাণের জন্য সর্বকালের সেরা টিম গোল করাকেই বেছে নিলো ব্রাজিল, ওই টিমগোলের বিল্ডাপে ব্রাজিলের আটজন ভিন্ন প্লেয়ারের টাচ ছিল আর সেই গোলটিতে অনেক বড় অবদান রাখেন ক্লডোয়াল্ডো যার ভুলেই কিনা ব্রাজিল প্রথমার্ধে গোল খেয়েছিলো। তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে স্পেস ক্রিয়েট করে কডোয়াল্ডো বলটি বাড়িয়ে দেন রিভেলিনোর দিকে, রিভেলিনো দেরী না করে বল জায়ারজিনহোর দিকে বাড়িয়ে দেন। জায়ারজিনহো তখন রাইট উইং থেকে লেফট উইং এ চলে এসেছে কারন ব্রাজিল জানতো ইতালি ম্যান টু ম্যান ডিফেন্ডিং করছে আর জায়ারজিনহো লেফট উইং এ চলে আসলে ইতালির লেফটব্যাক ফ্যাচেত্তিও লেফট উইং এ চলে আসবে এবং সেটাই হলো। জায়ার যখন পেলেকে পাস দিলো তখন পেলে দেখে ইতালির লেফটব্যাক লেফট উইং এ চলে আসায় রাইট উইং পুরো খালি আর সেই স্পেস কাজে লাগানোর জন্য পেলে বল বাড়িয়ে দেন কার্লোস আলবার্তোর দিকে আর কার্লোস আলবার্তোর বুলেট শট জালে জড়ালে বিশ্ব দেখতে পায় সর্বকালের সেরা টিম গোল। এই গোলের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে যায় ওই ব্রাজিল দলের প্রতিটি প্লেয়ারের অ্যাটাকিং এবিলিটি কতখানি বেশি ছিল।এই ম্যাচ জেতার সাথেসাথে বিশ্বকাপ জেতার সাথে সর্বকালের সেরা দলের লিস্টেও নিজেদের নাম লিখিয়ে নেয় '৭০ এর ব্রাজিল।
এবার আসি কেনো '৭০ এর ব্রাজিলই সেরা, কেনো অন্য কোনো দল নয়? সেরা হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা দুইটা ক্রাইটেরিয়া নিতে পারি একটা হচ্ছে সাফল্যের হার অন্যটা প্লেয়িং স্টাইল। '৭০ এর ব্রাজিলের সাফল্যের হার ছিল শতভাগ, তারা বিশ্বকাপের সবম্যাচ তো বটেই এমনকি বাছাইপর্বের সব ম্যাচও জিতেছিলো। তারমানে দাঁড়াচ্ছে টোটাল ১২ ম্যাচের মধ্যে ১২ টি ম্যাচেই জিতেছিলো '৭০ এর ব্রাজিল!!!!!! অস্বাভাবিক এই সাফল্যের ধারেকাছে নেই আর কোনো জাতীয় দল, '৯৮ এর ফ্রান্স মূলপর্বে সবম্যাচ জিতেছিলো ঠিকই তবে এরমধ্যে একটা ম্যাচ জিততে তাদের অতিরিক্ত সময়ে যেতে হয়েছিলো। বিশ্বকাপের সব ম্যাচ ৯০ মিনিটের মধ্যেই জেতার নজির আবারো গড়তে পেরেছিলো ব্রাজিলই সেটা ২০০২ সালে কিন্তু ওই ব্রাজিল দলের বাছাইপর্বের রেকর্ড মোটেও সন্তোষজনক ছিল না।
অদূর ভবিষ্যতে '৭০ এর ব্রাজিলের শতভাগ সাফল্যের হার কেউ হয়তো স্পর্শ করলেও করতে পারে কিন্তু '৭০ এর ব্রাজিলের মতো বিউটিফুল ফুটবল খেলে শতভাগ সাফল্য কি কেউ আর পাবে? যেখানে স্বয়ং ব্রাজিলই ১৯৮২ বিশ্বকাপের পর জোগো বোনিতাকে বিসর্জন দিয়েছে সেখানে আবারো বিউটিফুল ফুটবল দিয়ে শতভাগ সাফল্যের দেখা পাওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। তাই আরো বহুদিন সর্বকালের সেরা দলের তকমাটা ১৯৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিলের সাথে থাকবে সেটা অনুমান করাই যায়। আর সেটা হলেই যথার্থ হবে কারণ যারা সাফল্যের চিন্তা না করে শুধুমাত্র দর্শকদের আনন্দ দেওয়ায় জন্য বিউটিফুল ফুটবলের মাধ্যমে সবুজ গালিচায় এক মায়াময় অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে দর্শকদের বিমোহিত করার সাথেসাথে শতভাগ সাফল্যের দেখাও পেয়েছে সেই দলকে যুগের পর যুগ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ না করলে ফুটবলপ্রেমী হিসেবে আমরাই যে পাপের ভাগীদার হয়ে যাবো। যতদিন ফুটবল থাকবে ততদিন ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের প্রতিটি সদস্যকে শুধু ফুটবলার হিসেবেই না, একজন শিল্পী হিসেবেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হবে।
- 0 মন্তব্য