• ফুটবল

গুনার নরদাল- ক্যালসিও ইতিহাসের প্রথম বিদেশি গ্রেট

পোস্টটি ২৩৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০১৭ সালে ফ্রান্সেস্কো টট্টি রোমাতে ২৫ বছর কাটানোর পর সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সিরি-এ যেভাবে এই রোমা কিংবদন্তির অসাধারণ ক্যারিয়ারকে সম্মান জানিয়েছিলো তা বিশ্বব্যাপী বেশ প্রশংসাই কুড়িয়েছে। জিয়ালোরোসিদের হয়ে ৭৫০ টির বেশি ম্যাচ খেলে ৩০০ টিরও  বেশি গোল করেছিলেন। এটি ছিলো টট্টির জন্য এক অবিশ্বাস্য অর্জন কারণ তিনি রোমায় ট্রেকোয়ার্টিস্তা ভূমিকা পালন করেছিলেন। যার কারণে তিনি গোল করার চেয়ে গোল তৈরিতে বেশি যুক্ত থাকতেন।

 

পারমার বিপক্ষে ২২৬তম গোল করে টট্টি সিরি আ'র ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হয়ে ওঠেন এবং এর মাধ্যমে  মিলানের কিংবদন্তি গুনার নরদালকে ছাড়িয়ে যান। গুনার নরদাল, একজন মিলান কিংবদন্তি যার সিরি-এ ইতিহাসের অনন্য অর্জনগুলোকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।

 

১৯৪৯ সাল নাগাদ, সিরি-এ ছিল ফুটবলের আধুনিক যুগের শীর্ষ লীগগুলোর মধ্যে একটি। পশ্চিমে উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা, পূর্বে হাঙ্গেরির ম্যাজিক ম্যাগিয়ার্সের মতো দূরবর্তী অঞ্চলের বিদেশী তারকাদের নিয়ে আসা হয়েছিল ইতালিতে। ইতালির পেশাদার খেলার বিকাশে সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও ইতালীয় খেলায় এই খেলোয়াড়দের গভীর প্রভাব ছিল।

 

উরুগুয়ের ইত্তোর পুরিসেলি ১৯৩৯ ও ১৯৪১ মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন এবং হাঙ্গেরিয়ান সুপারস্টার ইস্তভান নায়ার্স ইন্টার মিলানে ছয় বছরে ১৩৩ গোল করেছিলেন। বিদেশী প্রতিভারা ইতালির সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে জায়গা করে নিতে লড়াই করেছিল। ১৯৩০ এর দশকে জিউসেপ মেজা থেকে শুরু করে ভ্যালেন্টিনো মাজোলা (যিনি ১৯৪৯ সালের মে মাসে সুপারগা এয়ার বিপর্যয়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন) এবং ১৯৪০-এর দশকে মহান সিলভিও পিওলা। কিন্তু ১৯৪৮ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের পর মিলান সুইডেনের একটি ছোট, অপেশাদার ক্লাবের একজন খেলোয়াড়কে ইতালিয়ান ফুটবলের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী নতুন অধ্যায় লেখার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে আর অন্য কেউ নয়, আমাদেরই মিলান কিংবদন্তি গুনার নরদাল।

 

গুনার নরদাল অলিম্পিকে সুইডেনকে স্বর্ণপদক জেতানোর পাশাপাশি সাতটি গোল করে টুর্নামেন্টের টপ স্কোরার নির্বাচিত হন। নরদাল তার উল্লেখযোগ্য প্রতিভাকে পেশাদার খেলায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর অর্থ হলো সুইডেনের কেবল অপেশাদার খেলোয়াড়দের মাঠে নামানোর নীতির কারণে নরদালের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার অকালে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তার দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্বকারী ৩৩টি খেলায় ৪৩ গোল করে সুইডেনের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে এখনো অবস্থান করছেন গুনার নরদাল।

 

১৯৪৯ সালের ২২ শে জানুয়ারী মিলানে যোগদানের মাধ্যমে, নরদাল প্রথম সুইডিশ খেলোয়াড় হিসেবে বিদেশী লীগে খেলার জন্য দেশ ত্যাগ করেছিলেন। নরদাল তুলনামূলকভাবে অপরিচিত খেলোয়াড় হিসেবেই মিলানে এসেছিলেন। তার দুর্দান্ত স্কোরিং রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও অপেশাদার হিসাবে নরদাল তার ফর্ম যুক্তিযুক্তভাবে ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক লীগে টেনে আনতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমের শেষের দিকে এসে সকল সন্দেহ দূর করে দেন তিনি। নরদাল প্রথম মৌসুমেই মিলানের জার্সিতে ১৫ ম্যাচে ১৬ টি গোল করেছিলেন। তার পরিমার্জিত স্পর্শের সাথে ভয়ঙ্কর আকার এবং উভয় পায়ের মারাত্মক ফিনিশিং এর জন্য রোসোনেরি ভক্তরা তাকে 'ইল ক্যানোনিয়ার' (দ্য গানার) বা 'ইল বিস্টোন' (দ্য বাইসন) বলে ডাকতেন।

 

নরদালের দুর্দান্ত ফর্মের কারণে মিলান তাকে দুই বছরের নতুন চুক্তিতে সাইন করে এবং নরদালের সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক দলের দুই সতীর্থ ফরোয়ার্ড গুনার গ্রেন এবং ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার নিলস লিডহোমকে দলে নিয়ে আসেন। একসাথে, তারা 'গ্রে-নো-লি' নামে পরিচিত ছিল এবং ১৯৫১ সালে স্কুডেত্তো জয়ী মিলান দলের মেরুদণ্ড ছিলো এই ত্রয়ী। ১৯৫৫ সালে গ্রেন ফিওরেন্টিনায় চলে যাওয়ার পরেও লিডহোম এবং নরদাল তাদের কৌশল পুনরাবৃত্তি করতে থাকে।

 

কিংবদন্তি অনুসারে লিডহোমের বিশাল প্রভাব সত্ত্বেও তখন থেকে ঠিক দুই বছর আগে সান সিরোতে নরদালের বিস্ময়কর গোল-স্কোরিং পারফরম্যান্স “গ্রে-নো-লি” ত্রয়ীকে প্রথমবার শিরোনামে নিয়ে আসে। মিলানের হয়ে ২৫৭টি খেলায় নরদাল ২১০টি গোল করেন এবং ক্যাপোকানোনিয়ার খেতাব অর্জন করেন। তিনি সান সিরোতে কাটানো সাড়ে ছয় মৌসুমের মধ্যে রেকর্ড পাঁচবার সিরি-এ'র সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন।

 

১৯৫৮ সালে নরদাল যখন ইতালিয়ান ফুটবল ছেড়ে চলে যান তখন তিনি ২৯১ ম্যাচে ২২৫ গোল করেছিলেন। যার ম্যাচ প্রতি গোল করার অনুপাত ছিল ০.৭৭, যা আজকের দিনে অতুলনীয়। সিরি-এতে নরদালের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে বিদেশী খেলোয়াড়দের কাছে সিরি-এ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কারণ ক্লাবগুলি পরবর্তী বিদেশী সুপারস্টারের সন্ধান করছিলো এবং খেলোয়াড়রা নতুন পরিবেশে খেলার সন্ধানে ইতালির দিকে যাত্রা করছিলো। ইতালি তখন ফুটবলের বৃহত্তম বেতন প্যাকেজ সরবরাহে স্পেনের সাথে প্রতিযোগিতা করছিলো।

 

১৯৫৭ সালে কিংবদন্তি ওয়েলশ স্ট্রাইকার জন চার্লস লিডস ইউনাইটেড থেকে জুভেন্টাসে যোগ দিয়েছিলেন, যার ফলে চার্লস বিদেশে খেলা প্রথম ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন ছিলেন এবং বিয়ানকোনেরির হয়ে তার প্রথম মৌসুমে লিগের শীর্ষ গোলদাতা হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৯ সালে নরদালের আগমনের পরে পরবর্তী ১৬টি মৌসুমের মধ্যে ১৪টিতে ক্যাপোকানোনিয়ারের উপাধিটি একজন অ-ইতালীয় নেটিভকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও ১৯৪৯ সালের মে মাসে সুপারগা বিপর্যয় ইতালিয়ান ফুটবলকে বিধ্বস্ত করেছিলো, যা ইতালির অনেক সেরা তরুণ প্রতিভার জীবন কেড়ে নিয়েছিলো।

 

নরদালের অগ্রণী প্রজন্মকে অনুসরণ করে দুর্দান্ত বিদেশী প্রতিভার আধিক্য দেখা যায় সিরি এ-তে। অনেকটা সফলতার সাথেই তারা তাদের নাম তৈরি করেছেন ইতালীয় ফুটবলে। মিশেল প্লাতিনি জুভেন্টাসের কালো এবং সাদা পোশাক পরে পরপর তিনটি ক্যাপোকানোনিয়ার এবং ব্যালন ডি'অর শিরোপা জিতেছেন। এছাড়া মার্কো ভ্যান বাস্তেন, রুড গুলিট, জ্বালাতান ইব্রাহিমোভিচ এবং মহান দিয়েগো ম্যারাডোনার মতো তারকারাও খেলেছেন সিরি-এতে। ইতালির শীর্ষ বিভাগে খেলার সময় সকলেই যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুমগুলি উপভোগ করেছিলেন এবং এটা বলা যেতে পারে যে তারা সকলেই নরদালের বিস্ময়কর কৃতিত্বের জন্য কৃতজ্ঞতার সাথে ঋণী।

 

তাই রোমার প্রিয় পুত্র যখন তার ২২৫ গোলের মাইলফলক অতিক্রম করেছিলো তখন এমন একজন ব্যক্তির কথা স্মরণ করুন যার অসাধারণ প্রতিভা আন্তর্জাতিক সুপারস্টারদের ইতালিতে যাওয়ার পথ তৈরি করেছিলো এবং ফলস্বরূপ ফুটবলকে সত্যিকারের বৈশ্বিক ঘটনা হয়ে ওঠার দিক চালু করতে সহায়তা করেছিলো।

 

একজন ক্ষুদে মিলান ভক্ত হিসেবে সর্বদা আপনাকে কুর্নিশ জানাই গুনার নরদাল।